ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

লে. জেনারেল জিয়ার হত্যাকাণ্ড প্রশাসকের বয়ান

প্রকাশিত: ০৪:০৫, ২৫ মে ২০১৬

লে. জেনারেল জিয়ার হত্যাকাণ্ড প্রশাসকের বয়ান

(২২ মে চতুরঙ্গ পাতার পর) মনজুর বৈঠক শুরু করলেন in a rather extraordinary way. তার সহজাত সৌজন্যবোধ ও মন জয় করা হাসি অনুপস্থিত। জিয়াউদ্দিনের ভাষায়, ‘He was curt, and very abrupt.’ তিনি বসেই রইলেন। তাদের সঙ্গে হাতও মেলালেন না; শুধু চেয়ারের দিকে ইঙ্গিত করলেন। তারপর তার কথা শুরু করলেন। সেই অফিসারটি দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আর মনজুর আপন মনে কথা বলছেন। মনজুর শুরু করলেন এভাবে- “দেশের দেশপ্রেমিক সৈন্যরা বিপ্লব করেছে এবং দুর্নীতিপরায়ণ সরকারকে শক্তির সাহায্যে অপসারণ করা হয়েছে। দুর্ভাগ্যবশত ‘প্রাক্তন’ রাষ্ট্রপতি নিহত হয়েছেন।” রাষ্ট্রপতিকে হত্যার ব্যাপারে বিশদ কিছু বললেন না। শুধু জানালেন, এটি বিপ্লবের ফল। বার বার বলতে লাগলেন আগের সরকারের দুর্নীতির কথা এবং ‘hwo even the army was made corrupt with a venal chief at its head.’ মিনিট ১৫ কঠোর ভাষায় পূর্ববর্তী সরকারের অপকীর্তি বর্ণনার পর জানালেন, সাধারণ মানুষের স্বপ্ন কীভাবে পূরণ হয়নি এবং কীভাবে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ অপূর্ণ হয়ে গেছে। ‘It was high time that the patriotic forces came forward, and hence the revolution, he declared in a tense, but somewhat strained voice.’ মনজুরের বক্তৃতার রহস্যজনক দিক হলো, তিনি স্বীকার করলেন তিনি একজন নেতা নন এমনকি বিপ্লবী কাউন্সিলের সদস্যও নন। কিন্তু বিপ্লবী কাউন্সিলের সদস্য কারা তাও বলতে পারলেন না। নিজেকে শুধু পরিচয় দিলেন বিপ্লবী কাউন্সিলের মুখপাত্র হিসেবে। যা হোক, মুখপাত্র হিসেবে তার কিছু নির্দেশ আছে। এর মধ্যে প্রধান হলো- ঢাকার সঙ্গে স্থল, রেল, নৌপথে যোগাযোগ বন্ধ থাকবে; চট্টগ্রাম বন্দর থেকে কোন পণ্য চট্টগ্রামের বাইরে যাবে না; বিপ্লবী কাউন্সিলের নির্দেশ অনুযায়ী স্থানীয় সরকারের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কাজ করে যাবে। ঢাকার কর্তৃত্ব যতদিন আত্মসমর্পণ না করছে ততদিন এই নির্দেশ বলবত থাকবে। তিনি জানালেন, সম্পূর্ণ সেনাবাহিনী বিপ্লবী কাউন্সিলের পিছে আছে। এও জানালেন, ঢাকার সরকার বিপ্লবী কাউন্সিলের শর্ত মানছে না। তবে এসব প্রতিবন্ধকতা শীঘ্রই শক্তি প্রয়োগে কাটিয়ে ওঠা যাবে। বৈঠকের উপসংহারে জানালেন, আগামীকাল বেলা ১১টায় ডিসির রুমে তিনি স্থানীয় কর্মকর্তা ও সাংবাদিকদের সঙ্গে বৈঠক করবেন। ডিসিকে নির্দেশ দিলেন তার ব্যবস্থা করতে। আধঘণ্টার মতো মনজুর লেকচার দিলেন। কমিশনার আর ডিসি নীরবে বসে। জিয়াউদ্দিন ভাবছিলেন, মনজুর যে নির্দেশ দিলেন সেগুলো বাস্তবায়ন করবে কে। এসব ব্যাপারে তিনি কিছুই বললেন না। তার মনে হলো, তারা দুজন এখন জিম্মি। বক্তৃতা শেষ করে জিয়াউদ্দিনকে মনজুর জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী মনে হয় আপনার? এতক্ষণ তো কোন কথা বললেন না।’ সাহস সঞ্চয় করে জিয়াউদ্দিন বললেন, ‘স্যার, ক্ষমতাসীন সরকার যে নির্দেশ দেবে আমরা তা পালন করব।’ বুদ্ধিমান মনজুর বুঝলেন, এটি এড়িয়ে যাওয়ার উত্তর। প্রায় ধমকের সুরে ডিসিকে বললেন, ‘আপনাদের সবার মানসিকতা টিপিক্যাল সিভিল সার্ভিসের। ১৯৭৫ সালের নবেম্বরে যখন দেশ অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছে তখন আপনাদের শফিউল আজমও এ ধরনের উত্তর দিয়েছেন।’ একটু থেমে বললেন, ‘এখন কঠিন সময়, দেশ উদ্ধারে সবার পূর্ণ কমিটমেন্ট চাই।’ জিয়াউদ্দিন বলে ফেললেন, ‘আমরা সিভিল সার্ভেন্ট। সরকার যা বলবে তাই করব।’ মনজুর উত্তর দিলেন না। স্বস্তি পেলেন না, বিরক্ত হলেন তাও বোঝা গেল না। বৈঠক শেষ। কমিশনার ও ডিসিকে মনজুর দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিতে গিয়ে একটি ডেস্কের সামনে থামলেন। সেখানে একটি কোরান শরিফ। মনজুর বললেন, ‘আমি চাই আপনারা যাওয়ার আগে কোরান স্পর্শ করে যান।’ জিয়াউদ্দিন ভাবলেন, মনজুর বোধহয় চাচ্ছেন বিপ্লবী কাউন্সিলকে সমর্থন জানিয়ে কোরান স্পর্শ করে তারা যেন শপথ নেন। কিন্তু তিনি সে রকম কিছু বললেন না। এমনভাবে বললেন, যেন এটি স্বাভাবিক ব্যাপার। সবাই বের হওয়ার সময় কোরান স্পর্শ করে যায়। তারা কোরান স্পর্শ করলেন কিনা মনজুর তাও দেখলেন না। তারা দুজন কোরান স্পর্শ করলেন। জিয়াউদ্দিন দেখলেন সশস্ত্র অফিসারটি তীক্ষè চোখে দেখছেন, তারা কোরান স্পর্শ করছেন কিনা। তারা বেরুবার সময় মনজুর এবার তাদের সঙ্গে হাত মেলালেন। ॥ পাঁচ ॥ মনজুরের সঙ্গে আলোচনার পরও জিয়াউদ্দিনের মনে হয়েছিল, মনজুরের মতো বুদ্ধিমান মানুষ এ ধরনের ক্যু করতে পারেন না। তার সঙ্গে আলোচনাকালেও মনজুর বলেননি তিনি নেতৃত্ব দিচ্ছেন। এদিকে ঢাকা রেডিও থেকে চট্টগ্রামের বিদ্রোহীদের আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেয়া হচ্ছিল। অন্যদিকে, চট্টগ্রাম রেডিও থেকে এরশাদকে বরখাস্তের আদেশ দেয়া হয়েছিল। মানুষজন ততক্ষণে বুঝে ফেলেছেন এটি স্থানীয় বিদ্রোহ। অনেকে গৃহযুদ্ধের আশঙ্কায় শহর ত্যাগ করছিলেন। শহরজুড়ে আতঙ্ক। থমথমে ভাব। বেসামরিক প্রশাসন নিজের মতো চলছে। চট্টগ্রামের সঙ্গে টেলিযোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। বিনিদ্র রজনী যাপন করলেন জিয়াউদ্দিন। পরদিন তিনি অফিসে গেলেন। মনুজরের সঙ্গে বেলা ১১টায় বৈঠকের আয়োজন করতে। পাংশু মুখে সরকারী কর্মকর্তারা হাজির। সাংবাদিকদের দেখে মনে হলো না তারা বেশি উদ্বিগ্ন। মনজুরের জন্য সবাই অপেক্ষা করছেন। দুই ঘণ্টা পর খবর পাওয়া গেল। কমিশনার আর ডিসি গেলেন গাড়ি বারান্দায় মনজুরকে অভ্যর্থনা জানাতে। গাড়ির বহর নিয়ে মনজুর প্রবেশ করলেন। আগের দিন থেকে তাকে আলাদা লাগছে। চুল এলোমেলো তবে মুখের ভাব শান্ত। দোতলায় মনজুর উঠছেন। পাশে জিয়াউদ্দিন। মনজুর তার হাত ধরে বাংলায় বললেন, ‘কী, ভয় পাচ্ছেন?’ গতকালের কঠোর, চাঁছাছোলা গলার বদলে নমনীয় গলার স্বর শুনে চমকে গেলেন জিয়াউদ্দিন। ‘হ্যাঁ, ভয় তো অবশ্যই পাচ্ছি’, জানালেন জিয়াউদ্দিন। ‘ঘাবড়াবেন না।’ বললেন মনুজর, ‘সব ঠিক হয়ে যাবে।’ বৈঠকে মনজুর যা বললেন, জিয়াউদ্দিন জানিয়েছেন তা গতকাল তাদের আলোচনার মতোই। অস্পষ্ট; নিজেকে বললেন কাউন্সিলের মুখপাত্র। সাংবাদিকদের প্রশ্নোত্তরেও যুতসই কিছু বলতে পারলেন না। বক্তৃতার শেষে নিজের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ার কথা বললেন। ঘণ্টাখানেক পর মনজুর তার বহর নিয়ে ফিরে গেলেন। কর্মকর্তা ও সাংবাদিকরা ভয়ার্ত ছিলেনই, এবার আরও বিভ্রান্ত হলেন। জিয়াউদ্দিন লিখেছেন, মনজুরের আচরণ ও বক্তব্য তার কাছে সিজোফ্রেনিক মনে হচ্ছিল। বিকেলের দিকে দেখা গেল, আরও লোকজন শহর ছেড়ে গ্রামের দিকে রওনা হচ্ছেন। কেউ কোন সঠিক খবর বা দিকনির্দেশনা পাচ্ছিলেন না। বরং গৃহযুদ্ধের আশঙ্কা করছিলেন। পহেলা জুন দেখা গেল রাস্তাঘাট খালি, অফিস-আদালতে লোক নেই। রাত ১০-১১টার দিকে জিয়াউদ্দিন খবর পেলেন টিভি রিলে স্টেশন, রেডিও ও টেলিফোন অফিস থেকে সেনাবাহিনী ফিরে যাচ্ছে। পরদিন সকালে দরজায় সজোরে কড়া নাড়ার শব্দে জেগে উঠলেন। বেয়ারা জানাল মিলিটারি একাডেমির কমান্ড্যান্ট ব্রিগেডিয়ার হান্নান শাহ ফোন করেছেন। ব্রিগেডিয়ার শাহ তাকে জানালেন উৎফুল্ল কণ্ঠে, ‘বিদ্রোহ দমন করা হয়েছে। বিদ্রোহীরা পালাচ্ছে।’ ‘মনজুরের খবর কী? তিনিও কী পালিয়েছেন?’ হান্নান শাহকে জিজ্ঞেস করলেন ডিসি। ‘তিনি তার অনুগামীদের নিয়ে পালিয়েছেন’। ‘অন্যদের বা তার ট্রুপসের অন্যদের খরব কী?’ ‘তারা অনুগত সেনাদের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। এখানকার সবচেয়ে সিনিয়র আর্মি অফিসার হিসেবে আমি ডিভিশনের ভার গ্রহণ করেছি। রাষ্ট্রপতির অফিস আর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে জানান যে বিদ্রোহ দমন করা হয়েছে।’ তিনি জানালেন, আসলে এই খবরটি সেনাপ্রধানকে তারই জানানো উচিত। হান্নান শাহ রাজি হলেন। তিনি তখন কমিশনার ও পুলিশ কমিশনারকে বিদ্রোহ দমনের কথা জানালেন। খানিক পর ঢাকা-চট্টগ্রাম টেলিযোগাযোগও চালু হলো। ডিসির ফোন বেজেই চলল। জিয়াউদ্দিন লিখেছেন, ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারের একজন স্টাফ অফিসার ফোন করে শেষ দিনের ঘটনা জানালেন। (চলবে)
×