ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

দেশ ও মানুষ ছিল তাঁর কাব্যের ক্যানভাস

প্রকাশিত: ০৪:০১, ২৫ মে ২০১৬

দেশ ও মানুষ ছিল তাঁর কাব্যের ক্যানভাস

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অভিজ্ঞতা জ্যাঁ পল সার্ত্রকে অস্তিত্ববাদী দার্শনিক হিসেবে বিশ্বময় নতুন পরিচিতি এনে দিয়েছিল। আর প্রথম বিশ্ব যুদ্ধ কবি কাজী নজরুল ইসলামকে প্রস্তুত করেছিল কবি ও লেখক হওয়ার জন্য। তার প্রথম কবিতা এবং গল্প তিনি করাচির সেনা ছাউনি থেকে ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা’য় পাঠিয়েছিলেন। আগেও কবিতা লিখেছেন কিন্তু ছাপা হয়েছিল সেই প্রথম। মুজফফর আহমদ এর লেখা থেকে এ তথ্য পাই। কিন্তু নজরুল যুদ্ধে গেলেন কেন? যে যুদ্ধের পক্ষ প্রতিপক্ষ ইউরোপের দুই পরাশক্তি ব্রিটিশ সাম্রাজ্য ও জার্মানি। যে ব্রিটিশ ভারত পদানত করে রেখেছে এবং নজরুল তার বিভিন্ন লেখায় এ পরাধীনতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছেন। নজরুলের কিছু স্ববিরোধিতার এও একটি ধরে নেয়া যায়। তবে তার প্রচন্ড আবেগও এর পেছনে কাজ করতে পারে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরুর পর উনিশ’শ পনেরো ষোলোর দিকে পশ্চিম এশিয়ার রণাঙ্গন মেসোপটেমিয়ায় তুর্কি সেনাবাহিনী ব্রিটিশ সেনাপতিসহ গোটা ভারতীয় বাহিনীকে বন্দী করে। যুদ্ধে লড়ে ইংরেজ বাহিনীর তখন প্রচুর সেনা ক্ষয় হয়েছে। শুরু হয় ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ থেকে সৈন্য সংগ্রহ। যে বাঙালীদের সেনা সদস্য করতে তাদের তীব্র অনীহা ছিল এবার তাদেরকেও সেনাবাহিনীতে যুক্ত করার জন্য নানা ধরনের আকর্ষনীয় বিজ্ঞাপন দেয়া শুরু হয়। নজরুল হয়তো তাতে আকৃষ্ট হয়েছিলেন। তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় বলেছেন সে কথা- ‘শহরে তখন নিত্য নতুন পোস্টার পড়ছে। নানা রকম রঙ বেরঙের বড় বড় পোস্টার আঁটা হচ্ছে শহরের অলিতে গলিতে। কত বিচত্র ছবি, কত বিচিত্র তার ভংগী আর কত বিচিত্র তার ভাষা’। একটি বিজ্ঞাপনের উদ্বৃতি দিয়েছেন তিনি – ‘কে বলে বাঙালী যোদ্ধা নয়? কে বলে বাঙালী ভীতু? জাতির এই কলঙ্ক মোচন করা একান্ত কর্তব্য, আর তা পারে একমাত্র বাংলার যুব শক্তি। ঝাঁপিয়ে পড় সিংহবিক্রমে। বাঙালী পল্টনে যোগ দাও! দুর্নাম ঘুচুক’। দু’বন্ধুই উনপঞ্চাশ নম্বর বাঙালী পল্টনে নাম লিখিয়ে ছিলেন। কিন্তু মাতামহের নেপথ্য ‘কারসাজি’তে শৈলজানন্দ স্বাস্থ্য পরীক্ষায় ‘আনফিট’ হয়ে বাদ পড়েন। আর নজরুল চলে যান সেনাবহিনীর সঙ্গে। প্রচন্ড আবেগ থেকেই কিনা কে জানে অন্য এক আকাঙ্খাও লুকিয়ে ছিল তার মনের গভীরে। সে কথাও জানান শৈলজানন্দ- ‘ নজরুল যুদ্ধবিদ্যা শিখে এসে ভারত বর্ষে এক বিরাট সৈন্যবাহিনী গঠন করবে, তারপর দেশ থেকে ইংরেজ তাড়াবে- তার এ গোপন মতলবের কথা আমাকে বলেছিল একদিন’। সতের বছরের কিশোরের পক্ষে এরকম কল্পনা অস্বাভাবিক নয়। শুধু মনে রাখা দরকার কিশোরটি এসেছিলেন বর্ধমান জেলার প্রত্যন্ত গ্রাম চুরুলিয়া থেকে এবং মনে রাখতে হবে তার আগমেনের পটভূমি সহ। তাহলেই বোঝা যাবে কাজী নজরুল ইসলামের ভেতরে পরাধীন দেশকে মুক্ত করার আকাঙ্খার তীব্রতা। শ্যামা সঙ্গীত লিখেছেন, লিখেছেন ইসলামী গান। সাহিত্যে কিংবা ব্যাক্তি জীবনে হিন্দু মুসলমান ঐক্যের তীব্র আকুলতা ছিল তার। সেকথা নতুন করে বলার কিছু নেই। ধর্মের নামে বারাবারিকে যে কোন ভাবে প্রতিহত করার চেষ্টায় কোন খাদ ছিল না। সীমবদ্ধতা হয়তো ছিল প্রচুর কিন্তু ভন্ডামি একেবারেই নয়। সাম্প্রদায়িক রাজনীতি আজ অচল হলেও বাড়ছে মৌলবাদী রাজনীতির চর্চা। এক সময়ে বামপন্থীরা যেভাবে ছাত্র-শ্রমিক-কৃষকদের মধ্যে সাংগঠনিক তৎপরতা চালাতেন, সেই আদলে কাজ করছে এখন কোন কোন সংগঠন। বামপন্থীরা শোষণমুক্ত সমাজের স্বপ্ন দেখাতেন এরা পারলৌকিক মুক্তির টোপ দেখিয়ে শ্রেণী বিভক্ত সমাজে মানবতার কথা বলে। বঞ্চনার বিরুদ্ধে সম্মিলিত প্রতিবাদের বদলে শ্রমিকদের নিয়তি নির্ভরতার তালিম দেয়। নারীদের নেকাবের আড়ালে লুকোতে লুকোতে প্রায় অদৃশ্য করে ফেলে। মধ্যবিত্ত তরুণদের সামনে জিহাদী আদর্শ তুলে ধরে তারুণ্যের শক্তি ক্ষয় করে। এরা নেপথ্যে কাজ করছে। নানান টানাপোড়েনের মধ্যেও ঠাণ্ডা মাথায় কাজ করছে। নজরুলের আবেগ-উচ্ছ্বাস একটু বেশি মাত্রায় থাকলেও মূলত তিনি ছিলেন গণমানুষের কবি। পরাধীন ভারতে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী জাতীয়তাবাদী সাহিত্যযোদ্ধা। তাঁর কাব্যে আরবী-ফারসী-উর্দু শব্দের ব্যবহার নিয়ে অনেক ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। সে সময়ের অভিজাত মুসলমানদের অনেকেই নিজেদের আরব, ইরান, তুর্কী থেকে আসা উচ্চ বংশীয় বলে মনে করতেন এবং ওসব দেশের সঙ্গে আত্মিক ঘনিষ্ঠতা অনুভব করতেন। তাদের চেতনায় নিজের দেশ সব সময়ই উপেক্ষিত থেকেছে। নজরুলের আরবী, ফারসী ব্যবহারে উল্লসিত হয়েছেন তারাই বেশি। কিন্তু নজরুল মননের পুরোটাই ছিল নিজের দেশ। নিজ দেশে বাস করে মনেপ্রাণে অন্য দেশের পূজারী হননি কখনও, স্বাধীনতার অর্থ তার কাছে ধরা দিয়ে ছিল সামগ্রিকতা নিয়ে। হিন্দু মুসলমানের খ-িত দৃষ্টি নিয়ে তিনি স্বাধীনতার অর্থ না খুঁজে সরাসরি সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। ‘বিদ্রোহী’ কবিতার নয় দশক সাড়ম্বরে উদযাপিত হলো দু‘হাজার বারোয় কিন্তু তাঁর চেতনার সেই সামগ্রিকতা কি ধরতে পেরেছি আমরা আজও? এক সময় সাম্প্রদায়িকতার দেয়াল তুলে ভারতবর্ষের হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে চরম বিরোধের ভিত্তিতে দেশ ভাগ করে নেপথ্যে হেসেছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ। তারপর ইতিহাসের নানা বাঁক পেরিয়ে আজ যে সময়ে এসে আমরা দাঁড়িয়েছি সেখানে সাম্রাজ্যবাদের প্রত্যক্ষ শাসন না থাকলেও পরোক্ষে তা আগের মতো বলা ভাল আগের চেয়ে বেশি চৌকসভাবে কাজ করছে। তারা যে সক্রিয় রূপেই আছে নানা কৌশলে সূক্ষ্মভাবে তা এতটাই আড়াল রাখে যে দৃষ্টিশক্তি প্রখর না হলে তা প্রায় দেখাই যায় না। বাংলাদেশের নাগরিক হয়ে আরব, ইরান, পাকিস্তানের স্বপ্নের বিভোরতা তো রয়েছেই তার সঙ্গে যোগ হয়েছে আরও নানা মাত্রা। যা একে অন্যের পরিপূরক হিসেবে কাজ করছে। ‘বিদ্রোহী’র শব্দের জৌলুস, দুরন্ত গতিতে ছুটে চলার আপাত প্রচ-তায় উদ্দীপ্ত হওয়া যায় সহজে কিন্তু জন্মভূমি ও তার ‘উৎপীড়িত’ মানুষের সপক্ষে থেকে যে লড়াই তিনি করে গেছেন তার উত্তরসূরি হওয়া কি যায় এত সহজে? সে পথ কঠিন এবং ত্যাগের। তার একটি পথরেখা থাকলেও তা মূল ধারা হয়ে উঠতে পারেনি আজও। দেশীয় রাজনীতি তাই ভিন্ন স্রোতে পাক খেতে খেতে বার বার ঘোলাটে হয়। সঙ্কীর্ণতার সীমানা পেরিয়ে মুক্তির শ্বাস নিতে পারে না। আর সেই বদ্ধ বাতাসে বেড়ে উঠছে তারা, যাদের বিরুদ্ধে নজরুলের কণ্ঠ উচ্চকিত থেকেছে সারা জীবন। বিদ্রোহের ছলে যে সব শব্দ তিনি উচ্চারণ করেছেন ছিয়ানব্বই বছর পর আজকের দিনে সে শব্দ উচ্চারণ করতে ঝুঁকি নিতে হয় অনেক। তিনি অনায়াসে বলতে পারেন, ‘আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান বুকে এঁকে দেই পদ-চিহ্ন;/আমি স্রষ্টা-সূদন, শোক তাপ-হানা খেয়ালী বিধির বক্ষ করিব ভিন্ন।/আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান বুকে এঁকে দেবো পদচিহ্ন!/আমি খেয়ালী বিধির বক্ষ করিব ছিন্ন ভিন্ন!’ আবেগের উচ্ছ্বাসে আরও বলেছেন, আমি বেদুঈন, আমি চেঙ্গিস,/আমি আপনারে ছাড়া করি না কাহারে কুর্নিশ।/আমি বজ্র, আমি ঈশান-বিষাণে ওঙ্কার,/ আমি ইস্রাফিলের সিঙ্গার মহাহুঙ্কার,/আমি পিনাক-পাণির ডমরু ত্রিশূল, ধর্মরাজের দ-,/ আমি চক্র ও মহাশঙ্খ, আমি প্রণব-নাদ প্রচ-!’ এ সব শব্দ উচ্চারণের ঝুঁকি বেড়েছে তাঁর সময়ের চেয়ে অনেক বেশি। ধর্মান্ধতার খড়গ্ তাঁর সময়েও উদ্যত ছিল, তবু এ উচ্চারণ তিনি করতে পেরেছিলেন। কারণ তিনি ছিলেন মুক্ত চিন্তার মানুষ। সাম্প্রদায়িকতা সঙ্কীর্ণ প্রাদেশিকতা তাকে আচ্ছন্ন করতে পারেনি। বৈষম্যমুক্ত সমাজের স্বপ্ন দেখেছিলেন তিনি। বলেছিলেন, ‘মহা বিদ্রোহী রণক্লান্ত/আমি সেই দিন হব শান্ত,/যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দনরোল আকাশে-বাতাসে ধ্বনিবে না,/অত্যাচারীর খড়গ্ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না/বিদ্রোহী রণক্লান্ত আমি সেই দিন হব শান্ত। এ মর্মবাণীই হোক আজকের সমাজ জীবনের অগ্রযাত্রার দিশারী।
×