ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

রোয়ানুর আঘাত

প্রকাশিত: ০৪:০১, ২৫ মে ২০১৬

রোয়ানুর আঘাত

দুর্যোগ ডেকে আনে দুর্ভোগ। বাড়ে বিপত্তি। জীবননাশ শুধু নয়, সম্পদহানিও ঘটে বিস্তর। সব ল-ভ- করে দিতে পারে প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঘনঘটা। মৃত্যুকে টেনে নিয়ে আসা দুর্যোগ থেকে রক্ষা পাওয়া দুষ্কর কখনও-সখনও। এমনিতেই প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রতিরোধ করা সহজসাধ্য নয়। তবে আগাম সতর্ক হলেই প্রাণহানিসহ ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অনেকটাই হ্রাস পায়। ঘূর্ণিঝড়ের প্রতাপ এমনিতেই তীব্র থাকে। তাকে মোকাবেলার জন্য পূর্ব প্রস্তুতি জরুরী। আর তা নেয়া গেলে আক্রমণ থেকে অনেকটাই রক্ষা পাওয়া যায়। ঘূর্ণিঝড় প্রাকৃতিক বিপদ হয়ে আসে। অতীতে নানামাত্রার ঝড়ে অনেক বেশি প্রাণহানি যেমন ঘটত, তেমনি সম্পদহানিও হতো। যা থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় মিলত না। একালে প্রযুক্তির কল্যাণে ঝড়ের পূর্বাভাস মেলে এবং আঘাতের অঞ্চলগুলো পূর্বাহ্নেই চিহ্নিত করা যায়। স্যাটেলাইটের সাহায্যে ঝড়ের গতিপথ ও শক্তি নজরে রেখে আঘাত হানার সম্ভাব্য সময় ও স্থানও নির্ধারণ করে। সে অনুযায়ী পদক্ষেপ গ্রহণের উপায়ও উদ্ভাবন করা যায়। সে কারণেই প্রশাসনিকভাবে যেমন জনগণকে ঝড়-তুফান আবহাওয়ার সর্বশেষ তথ্য জানানো যাচ্ছে, তেমনি তাদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়া সম্ভব হচ্ছে। সে কারণে প্রাণহানি ও সম্পদহানির সংখ্যা ও পরিমাণ যতটা সম্ভব নিম্নমুখী করা সম্ভব হচ্ছে। এটা সরকারের কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণের সাফল্য হলেও নানা ত্রুটিবিচ্যুতির কারণে সেই সাফল্য এখনও পুরোপুরি ধরা দেয়নি। ঘূর্ণিঝড় সতর্কীকরণ এবং দুর্যোগ মোকাবেলায় বাংলাদেশ যথেষ্ট সক্ষমতা অর্জন করেছে বলা যায়। ভারত মহাসাগরে উৎপত্তি হওয়া নিম্নচাপ অন্ধ্রপ্রদেশের সাগরে ঘূর্ণিঝড়ের রূপ ধারণ করে। শনিবার দুপুরে বাংলাদেশের উপকূলবর্তী অঞ্চল অতিক্রমের মাধ্যমে স্থলভাগে প্রবেশ করে। ঘূর্ণিঝড়ও পূর্ণিমার যুগপৎ প্রভাবে উপকূলবর্তী এলাকার স্থলভাগে আঘাত হানে। এই সামুদ্রিক ঝড়টির নাম মালদ্বীপের ভাষায় রাখা হয় রোয়ানু। তাদের প্রদত্ত নামটির অর্থ নারিকেল ছোবরার রশি। তবে সেই রশি ‘বজ্র আঁটুনি ফসকা গেরো’তে পরিণত হওয়ায় আঘাতের মাত্রা ছিল কম। ঝড়টি এ দেশের উপকূলীয় অঞ্চল অতিক্রম করার আগেই কমপক্ষে ২৬ জনের প্রাণ কেড়েছে আর আহত হয়েছে প্রায় হাজারখানেক মানুষ। ঘরবাড়ি, গাছ ভেঙ্গে, পাহাড় ধসে, জোয়ারের পানির তোড়ে, নৌকাডুবিতে এই হতাহতের ঘটনা ঘটে। ঝড়ের সময় বাতাসের গতিবেগ কম থাকায় এবং বৃষ্টি ও ভাটার কারণে ঝড় কিছুটা দুর্বল হয়ে গেলে প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি কম হয়েছে। ঝড়ের প্রভাবে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে বিস্তীর্ণ এলাকা পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত, ফসলহানি এবং সড়ক যোগাযোগ ও বিদ্যুত ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়েছে। ভেসে গেছে মাছের ঘের, লবণের মাঠ, কাঁচা ঘরবাড়ি। বাঁধভাঙ্গা অরক্ষিত এলাকায় জলাবদ্ধতায় আটকে পড়েছে লাখ লাখ মানুষ। বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়ে ক্ষতির পরিমাণ বাড়িয়েছে। ঝড়, বন্যার দেশ হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশ, দুর্যোগ মোকাবেলা এবং ঘূর্ণিঝড় সতর্কীকরণের ক্ষেত্রে যথেষ্ট সক্ষমতা অর্জন করেছে। প্রাথমিক পর্যায়ে উপকূলবর্তী ১৪ জেলার ৫ লাখ মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নেয়া হয় সাড়ে তিন হাজার আশ্রয় কেন্দ্রে। যদিও এখনও উপকূলবর্তী এক কোটি মানুষের নিরাপত্তার ব্যবস্থা নামমাত্র। পর্যাপ্ত সাইক্লোন শেল্টার নেই। যা আছে, তাও রক্ষণাবেক্ষণ হয় না যথাযথভাবে। গবাদিপশুর আশ্রয়কেন্দ্র না থাকায় মানুষ তাদের ছেড়ে নিরাপদ স্থানে যেতে চায় না। তা অতীতের মতো এবারও দেখা গেছে। বিশেষত ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড় ও ২০০৭ সালের সিডরের ঘটনা থেকে কেউই শিক্ষা নেয়নি। ফলে জনসচেতনতা সেভাবে গড়ে উঠছে না। তাই প্রশাসনিক সক্ষমতা আরও বাড়ানোর পাশাপাশি জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে সমন্বিত পরিকল্পনা জরুরী। ঝড়পরবর্তী ত্রাণ প্রদান, পুনর্বাসন ও ক্ষয়ক্ষতি পূরণে যেন অনিয়ম, দুর্নীতি প্রশ্রয় না পায়। ক্ষতিগ্রস্তরা যেন যথাযথ সহায়তা পায়। সে জন্য তাদের পাশে দাঁড়ানো জরুরী। সরকার এবং জনগণ সমন্বিতভাবে এই কাজে এগিয়ে আসবেন এটাই প্রত্যাশা।
×