ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

একই চিন্তা ... একই কাজ বারবার ॥ অবসেসিভ কমপালসিভ ডিসঅর্ডার

প্রকাশিত: ০৬:৩৪, ২৪ মে ২০১৬

একই চিন্তা ... একই কাজ বারবার ॥ অবসেসিভ কমপালসিভ ডিসঅর্ডার

মিসেস লায়লা একজন গৃহবধূ। ময়লা লাগার ভয়ে হাত দিয়ে টাকা পয়সা ধরেন না। কিন্তু না ধরেও তো থাকা যায় না, তাই ভুলক্রমে বা বাধ্য হয়ে হাত দিয়ে টাকা ধরে ফেলেন, তা একেবারে কচকে নতুন ব্যাংকনোট বা ছেড়াফাটা ময়লা টাকা যাই হোক না কেন এরপর শুরু হয় তার হাত ধোয়ার পালা- একবার দু’বার নয় কমপক্ষে দশ থেকে পনেরোবার তিনি সাবান-ডেটল ইত্যাদি দিয়ে বারবার হাত ধোবেনই ধোবেন। এতবার হাত ধোয়ার যে কোন দরকার নেই- এটা যে বাড়াবাড়ি তা তিনি নিজেও বোঝেন- চান না এতবার হাত ধুতে কিন্তু দশ বারোবার হাত না ধুয়ে তিনি থাকতেই পারেন না। এই ধরনের সমস্যাকে বলা হয় বাধ্যতাধর্মী চিন্তা ও আচরণ বা অবসেসিভ-কমপালসিভ ডিসঅর্ডার (ওসিডি)। কারও কারও সমস্যা কেবল চিন্তার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে- যেমন কারও মনে হতে পারে বাসা থেকে বের হওয়ার সময় তিনি বোধহয় দরজায় তালা দিতে ভুলে গেছেন। সারা দিন এই চিন্তায় তিনি কাতর হয়ে রইলেন- এটিকে বলা হয় অবসেসন। কারও কারও মধ্যে কেবল অবসেসন আবার কারও মধ্যে কেবল কম্পালসন থাকতে পারে তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় একই ব্যক্তির মধ্যে খুঁতখুঁতে চিন্তা। একই চিন্তা বা কাজ বার বার করার মাধ্যমে আক্রান্ত ব্যক্তি তার মনের উৎকণ্ঠা দূর করার চেষ্টা করেন। লক্ষণ ১. একই ধরনের চিন্তা, অনুভূতি বা অবয়ব বারবার মনের মধ্যে আসতে থাকে। এগুলো মনের মধ্যে অনধিকার প্রবেশ করে ফলে তৈরি হয় উৎকণ্ঠা আর তীব্র মানসিক চাপ। ২. আক্রান্ত ব্যক্তি এসব চিন্তা অনুভূতি বা অবয়বকে দমন করতে চান এবং সেজন্য একই কাজ বার বার করতে শুরু করেন। ৩. একই চিন্তা ও কাজ বারবার করার জন্য অনেক সময় নষ্ট হয় এবং তা দৈনন্দিন কর্মকা-কে ব্যাহত করে। ৪ শরীর নোংরা হওয়ার ভয়, অহেতুক সন্দেহ, কোন অমূলক শারীরিক সমস্যা নিয়ে চিন্তা, সবকিছুর মধ্যে নিখুঁত সামঞ্জস্য তৈরি করার ভাবনা, বিনা কারণে উত্তেজিত হয়ে যাওয়া, অস্বাভাবিক ও অতিরিক্ত যৌন চিন্তা ইত্যাদি অবসেসনের প্রধান লক্ষণ। ৫. কম্পালসনের লক্ষণের মধ্যে রয়েছে- বারবার একই জিনিস পরীক্ষা করা (দরজা বন্ধ কিনা তা অনেকবার দেখা), অসংখ্যবার হাত ধোয়া- বেশি সময় গোসলে থাকা, কোন কিছু বার বার গোনা (অনেকবার টাকা গুনে দেখা ঠিক আছে কিনা), একই প্রশ্ন বারবার করা, সবকিছু নিখুঁতভাবে সাজিয়ে রাখার চেষ্টা করা, প্রয়োজনীয় অপ্রয়োজনীয় সবকিছু সংগ্রহে রাখা অর্থাৎ পরে কাজে লাগতে পারে ভেবে নিতান্ত অপ্রয়োজনীয় বস্তুটিও ফেলে না দেয়া ইত্যাদি। গায়ে ময়লা লাগবে এই চিন্তায় কেউ কেউ ঘর থেকে বের হন না, কোথাও বেড়াতে গিয়ে বাথরুম ব্যবহার করেন না, গরমে পানি খান না। চামচ পরিষ্কার করার জন্য কয়েক ঘণ্টা চামচটি এক গ্লাস পানিতে ডুবিয়ে রাখেন। হাত ধুতে ধুতে হাতের চামড়ায় ইনফেকশন হওয়ায় ত্বক বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হন কেউ কেউ। ঘুমের সময় মনে হয় গ্যাসের চুলা নেভানো হয়েছে কিনা- দরজাটা বন্ধ করা হয়েছে কিনা- তাই শোওয়া থেকে উঠে একবার দুবার নয় বারবার রান্নাঘরে গিয়ে দেখতে থাকেন চুলা বন্ধ কিনা, অনেকবার দরজায় নব ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখেন ঠিকমতো সেটা লক্্ করা আছে কিনা। কেউ আবার সবকিছু নিখুঁতভাবে সাজাতে গিয়ে, অতিরিক্ত সময় নিয়ে ফেলেন। মৃদু অবসেসন বা কম্পালসন থাকলে চিকিৎসা না নিয়েও পারা যায় কিন্তু এগুলো যদি তার দৈনন্দিন কর্মকা-ের ওপর প্রভাব ফেলে- অপরের সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্ক নষ্ট করে দেয়, কর্মক্ষমতা কমিয়ে দেয় তবে অবশ্যই চিকিৎসা গ্রহণ করা প্রয়োজন। চিকিৎসা অবসেসন-কম্পালসনের জন্য সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা রয়েছে। মস্তিষ্কের নিউরোট্রান্সমিটারের তারতম্যের কারণে এ সমস্যা হয় বলে বিশেষ ওষুধের মাধ্যমে এ রোগের চিকিৎসা করা যায়। তবে দীর্ঘমেয়াদে এ ওষুধ সেবন করা প্রয়োজন। লক্ষ্য রাখতে হবে যে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শেই এ রোগের চিকিৎসা গ্রহণ করা উচিত আর যেহেতু এক-দুইদিনে ফল পাওয়া যাবে না তাই ধৈর্য ধরে চিকিৎসকের পরামর্শমতো ওষুধ খেতে হবে। ওষুধের পাশাপাশি ধারণা ও আচরণ পরিবর্তনকারী চিকিৎসা (কগনিটিভ-বিহেভিয়ার থেরাপি) এ রোগের জন্য বিশেষ কার্যকরী। এ পদ্ধতির মূলনীতি হচ্ছে ‘এক্সপোজার ও রেসপন্স পিভেনশন’। এক্সপোজার পদ্ধতিতে যে বিষয়টি নিয়ে তার খুঁতখুঁতে চিন্তা আছে তাকে সে বিষয়টির মুখোমুখি করতে হবে। যেমন কারও যদি ময়লা-আবর্জনা নিয়ে খুঁতখুঁতে চিন্তা থাকে তবে তাকে ময়লার ঝুড়িতে হাত দেয়ার জন্য বলতে হবে। প্রথমে এ বিষয়টি তার জন্য অসম্ভব মনে হলেও ধীরে ধীরে (সিস্টেমিক ডিসেনসিটাজিশন) অথবা একবার (ফ্লাডিং) কাজটি তাকে দিয়ে করাতে হবে। আর রেসপন্স প্রিভেনশন পদ্ধতিতে যে কাজটি বারবার না করলে সে শান্তি পায় না সে কাজটি করা থেকে তাকে বিরত রাখতে হবে। যেমন সে বারবার হাত ধোয়- তাকে হাতে ময়লা লাগিয়ে হাত না ধুয়ে বসিয়ে রাখতে হবে আর তাকে বোঝাতে হবে যে এখন হাত ধোয়ার প্রয়োজন নেই- খাবার আগে হাত ধোবেন। খুঁতখুঁতে চিন্তা বন্ধ করার জন্য অন্য কোন বিকল্প চিন্তা বা আচরণের অভ্যাস করা যেতে পারে- যেমন হাতে একটি রাবার ব্যান্ড লাগিয়ে রাখতে হবে এবং যখনই মনে অবসেসিভ চিন্তাটি আসবে তখনই রাবার ব্যান্ডে টান নিয়ে ছেড়ে দিতে হবে- হাতে মৃদু আঘাত লাগবে; মনের অবসেসিভ চিন্তাটি অন্যদিকে ধাবিত হবে- উৎকণ্ঠা কমে আসবে। অনেক সময় এ ধরনের রোগীকে একটি ডায়েরি রাখতে বলা হয়- সেখানে প্রতিদিনের শেষে সে তার সারাদিনের সব চিন্তা ও আচরণের বর্ণনা সময়সহ লিখবে। এ ডায়েরিতে সময়ের হিসাব দেখানোর উদ্দেশ্য দুটি- অবসেসিভ-কম্পালসিভ রোগের চিকিৎসা সময়সাপেক্ষ- অযথা ধৈর্যহারা না হয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী চললে এ রোগকে পরাজিত করা সম্ভব। ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ সহকারী অধ্যাপক জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা
×