গাফফার খান চৌধুরী ॥ সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ব্লগার, লেখক ও প্রকাশক হত্যার সঙ্গে সেনাবাহিনীতে অভ্যুত্থান ঘটানোর চেষ্টাকারী পলাতক মেজর জিয়াসহ কয়েকজনের জড়িত থাকার তথ্য মিলেছে। আনসারউল্লাহর ৬ জঙ্গী সরাসরি এসব হত্যাকা- ঘটাচ্ছে। সম্প্রতি ঢাকা মহানগর পুলিশ এদের ধরিয়ে দিতে পুরস্কার ঘোষণা করেছে। এই ছয় জঙ্গীর দুজন অপারেশনাল কমান্ডার হিসেবে ঘটনাস্থলে উপস্থিত থেকে হত্যাকা-ে দিকনির্দেশনা দেয়। কলাবাগানের জোড়া খুনের ঘটনায় রিমান্ডে থাকা আনসারউল্লাহ বাংলা টিমের অন্যতম শীর্ষ নেতা শরিফুল ইসলাম শিহাবের দেয়া তথ্যের রেশ ধরে এমন কাহিনী বেরিয়ে এসেছে।
গত ২৫ এপ্রিল রাজধানীর কলাবাগানে বাসায় ঢুকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনির খালাত ভাই, ঢাকায় মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সাবেক প্রটোকল কর্মকর্তা ও ইউএসএআইডিতে কর্মরত জুলহাস মান্নান ও তার বন্ধু নাট্যকর্মী মাহবুব রাব্বী তনয়কে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় গ্রেফতার হয়ে দ্বিতীয় দফায় পাঁচ দিনের রিমান্ডে রয়েছে আনসারউল্লাহ বাংলা টিমের অন্যতম শীর্ষ নেতা শিহাব। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ কার্যালয়ে তার জিজ্ঞাসাবাদ চলছে।
গোয়েন্দা পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, শিহাব আনসারউল্লাহ বাংলা টিমের শীর্ষ পর্যায়ের নেতা। তার প্রধান কাজ ছিল জঙ্গী সংগঠনটির বিভিন্ন সিøপার সেলের মধ্যে অস্ত্র গোলাবারুদ সরবরাহ। অস্ত্র গোলাবারুদ সরবরাহ করার সুবাদে শিহাব প্রতিটি হত্যাকা-ের আগে জানত। শিহাব ঢাকায় অভিজিত রায়, ব্লগার নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায়, ওয়াশিকুর রহমান বাবু, প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপন, সিলেটে অনন্ত বিজয় দাশ হত্যা, মোহাম্মদপুরে শুদ্ধস্বর প্রকাশনীতে হামলা করে তিনজনকে হত্যা চেষ্টা এবং সর্বশেষ কলাবাগানে দুজনকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যার অনেক আগেই ঘটনাগুলো জানত। এসব হত্যাকা-ের সঙ্গে যারা জড়িত ছিল, তারা বিভিন্ন সময় শিহাবের কাছে যাতায়াত করেছে। শিহাবের কাছে তারা অস্ত্র গোলাবারুদ ও শেল্টার চেয়েছে। অনেককে শিহাব শেল্টার দিয়েছিলেন। আবার অনেককে অস্ত্র গোলাবারুদ দিয়ে সহায়তা করেছে। শিহাবের সঙ্গে আনসারউল্লাহ বাংলা টিমের একজন শীর্ষ নেতার যোগাযোগ ছিল। সেই নেতা এবং দলীয় নির্দেশনা মোতাবেক শিহাব সিøপার সেলগুলোকে অস্ত্র গোলাবারুদ সরবরাহ করত। ওই শীর্ষ নেতা সেনাবাহিনীতে অভ্যুত্থান ঘটানোর অপচেষ্টাকারী বলে মেজর জিয়া বলে ধারণা পাওয়া যাচ্ছে।
ওই শীর্ষ নেতার সঙ্গে যোগাযোগ থাকার সূত্র ধরে প্রতিটি ঘটনা ঘটানোর আগ থেকেই শিহাব জানত। শীর্ষ নেতার সূত্র ধরেই শিহাবের সঙ্গে আনসারউল্লাহ বাংলা টিমের ছয় জঙ্গীর নানাভাবে যোগাযোগ হয়। ছয় জঙ্গীর মধ্যে শিহাবের সঙ্গে কারও কারও সরাসরি যোগাযোগ ও পরিচয় রয়েছে। আবার অনেকের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ ছিল।
প্রসঙ্গত, গত ১৯ মে ঢাকা মহানগর পুলিশ আনসারউল্লাহ বাংলা টিমের ছয় জঙ্গীর ছবি প্রকাশ করে। তাদের ধরিয়ে দিতে ১৮ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণাও করা হয়। পুরস্কার ঘোষিত ছয় জঙ্গীর মধ্যে শরিফুল ওরফে সাকিব ওরফে শরিফ ওরফে সালেহ ওরফে আরিফ ওরফে হাদী-১ ও সেলিম ওরফে ইকবাল ওরফে মামুন ওরফে হাদী-২ কে ধরিয়ে দিতে ৫ লাখ টাকা করে দশ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করা হয়। অপর চারজন সিফাত ওরফে সামির ওরফে ইমরান, আব্দুস সামাদ ওরফে সুজন ওরফে রাজু ওরফে সালমান ওরফে সাদ, শিহাব ওরফে সুমন ওরফে সাইফুল ও সাজ্জাদ ওরফে সজিব ওরফে সিয়াম ওরফে শামসকে ধরিয়ে দিতে প্রত্যেকের জন্য ২ লাখ টাকা করে ৮ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করা হয়।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জনকণ্ঠকে বলেন, পুরস্কার ঘোষিত ছয় জঙ্গীর সঙ্গে মেজর জিয়ার সরাসরি যোগাযোগ থাকার তথ্য পাওয়া গেছে। মেজর জিয়ার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদে বাংলাদেশে সব ব্লগার, লেখক, প্রকাশক হত্যার ঘটনা ঘটেছে। তবে মেজর জিয়া ছাড়াও আরও কয়েকজনের সঙ্গে জড়িত। পুরস্কার ঘোষিত জঙ্গীর মধ্যে হাদী-১ ও হাদী-২ অপারেশনাল কমান্ডার হিসেবে প্রতিটি হত্যাকা-ে সরাসরি উপস্থিত থেকেছে। পুরস্কার ঘোষিত অন্য চারজনের বিভিন্ন হত্যাকা-ে নানাভাবে জড়িত থাকার তথ্য মিলেছে। অস্ত্র গোলাবারুদ সরবরাহ করার সুবাদে শিহাব প্রায় প্রতিটি হত্যাকা-ের আগে জানত। শুধু ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে ঢাকার উত্তরায় ব্লগার আসিফ মহিউদ্দিনের ওপর হামলা এবং ওই বছরের ফেব্রুয়ারিতে শাহবাগ গণজাগরণ মঞ্চের অন্যতম সংগঠক ব্লগার প্রকৌশলী আহমেদ রাজীব হায়দার শোভন হত্যাকা-ের বিষয়টিও আগেই জানত না বলে শিহাবের দাবি। এছাড়া ব্লগার, প্রকাশক ও লেখক হত্যা এবং হামলার যত ঘটনা ঘটেছে শিহাব আগ থেকেই তা জানত। তবে সরাসরি কোন হত্যাকা-ে অংশ নেয়নি বলে শিহাবের দাবি।
এ ব্যাপারে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের দক্ষিণ বিভাগের উপ-কমিশনার মাশরুকুর রহমান খালেদ জনকণ্ঠকে জানান, শিহাবের সঙ্গে নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন আনসারউল্লাহ বাংলা টিমের এক শীর্ষ নেতা এবং সম্প্রতি পুরস্কার ঘোষিত ছয় জঙ্গীর যোগাযোগ থাকার তথ্য মিলেছে। শীর্ষ ওই জঙ্গী নেতাসহ আরও কয়েকজনের মদদে দেশে ব্লগার, প্রকাশক ও লেখক হত্যার ঘটনাগুলো ঘটায় আনসারউল্লাহ বাংলা টিমের বিভিন্ন সিøপার সেল। অধিকাংশ হত্যাকা-ে ৫ লাখ টাকা করে ১০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষিত দুই জঙ্গী অপারেশনাল কমান্ডার হিসেবে সরাসরি অংশ নিয়েছিল বলে তথ্য পাওয়া গেছে। আর আনসারউল্লাহ বাংলা টিমের শীর্ষ ওই নেতা দেশে সেনা অভ্যুত্থানের ব্যর্থ চেষ্টা করে আলোচনায় এসেছিলেন বলে তথ্য মিলেছে। তবে এই ডিবি কর্মকর্তা শীর্ষ ওই জঙ্গী নেতার নাম প্রকাশ করতে অপারগতা প্রকাশ করেছেন। গ্রেফতারকৃত শিহাবের সঙ্গে পুরস্কার ঘোষিত ছয় জঙ্গী ও শীর্ষ জঙ্গী নেতার নানাভাবে যোগাযোগ থাকার তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। এসব তথ্যের সত্যতা যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে।
আরো পড়ুন
শীর্ষ সংবাদ: