ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

মুনতাসীর মামুন ॥ পাঠে-পাঠান্তরে

প্রকাশিত: ০৩:৫৩, ২৪ মে ২০১৬

মুনতাসীর মামুন ॥ পাঠে-পাঠান্তরে

কোথায় পড়েন? -জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। কোন বিষয়ে? -ইতিহাসে। একটু অবজ্ঞার দৃষ্টি ফেললেন প্রশ্নকর্তা। উত্তরদাতা আমি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে সদ্য ভর্তি হওয়া (২০০৩) ছাত্র, সগর্বে বলি ‘জি, এই ইতিহাস বিষয়ের ছাত্র ছিলেন মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, সালাহউদ্দীন আহমেদ, মুনতাসীর মামুন।’ প্রশ্নকর্তার অবজ্ঞার সুরটি আমার কথা শুনে এবার সমীহতে বদলে যায়। মুনতাসীর মামুন এভাবে প্রত্যক্ষ শিক্ষক না হয়েও ইতিহাসের ছাত্র হিসেবে আমার সাহসের সীমা যেমন বাড়িয়ে দেন অনেকখানি তেমনি পাঠক হিসেবে আমাকে নিমগ্ন রাখেন আশৈশব। ॥ দুই ॥ জেমস জয়েসের যেমন ডাবলিন, নগিব মাহফুজের যেমন কায়রো, ওরহান পামুকের যেমন ইস্তাম্বুল, মুনতাসীর মামুনের তেমনি ঢাকা। পূর্বোক্ত সকলেই কথাশিল্পের ক্যানভাসে ধারণ করেছেন তাদের প্রিয় নগরীকে আর আমাদের মুনতাসীর মামুন গবেষণার আপাত জটিল পরিসরের ভেতরে থেকেও ঢাকাকে নিয়ে এসেছেন প্রায় ফিকশনাল বিষয় করে। কলকাতা স্ট্রিট ডায়েরির মতো নিয়মিত হালনাগাদ করা কোন বই না থাকলেও আক্ষেপ নেই, কারণ আমাদের আছে মুনতাসীর মামুনের ঢাকা : স্মৃতি বিস্মৃতির নগরী, যা ঢাকার রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো দেশী-বিদেশী মানুষের পাশাপাশি আখতারুজ্জামান ইলিয়াস থেকে আজকের তরুণ কথাশিল্পী পর্যন্ত, যারা ঢাকাকে বিষয় করে গল্প-উপন্যাস লিখেন তাদের সৃজনশীল সহায়সূত্র হয়ে উঠেছে। এই সেদিন আমিই ‘এপিটাফের ঘ্রাণ’ নামের একটি গল্প লিখতে গিয়ে শরণাপন্ন হলাম এপিটাফ শীর্ষক মুনতাসীর মামুনের অনবদ্য বইটির, যেখানে ঢাকার বুকে শুয়ে থাকা শতসহস্র মানুষের এপিটাফ সংকলিত হয়েছে নিবিড় নিষ্ঠায়। তো আমার গল্পের এক জায়গায় আছেÑ মিনারের এপিটাফ-উৎসাহী বন্ধু ডেভিড ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুনের বইপত্র ঘেঁটে বের করল যে ১৭৯১-এ স্থাপিত পুরান ঢাকার আর্মানিটোলার এ চার্চের প্রাঙ্গণে অষ্টাদশ শতকের বহু পুরনো কবর আছে। কলকাতার ওয়েলেসলি স্ট্রিট থেকে আনা পাথরে মৃতের এপিটাফগুলো জীবন পেয়েছে। এখনও যখন ছুটির দিনে পুরনো ঢাকার রাস্তায় উৎসুক ছেলে-মেয়েদের খুঁজতে দেখি মীর জুমলার কামান কিংবা রূপলাল হাউস, তখন তাদের জিজ্ঞেস করে জানতে পারি ঢাকা বিষয়ে তাদের জাগ্রত কৌতূহলের মূলে আছে মুনতাসীর মামুনের বইপত্র। কবি শামসুর রাহমান বলেছিলেন ‘মুনতাসীর মামুনের ঢাকা : স্মৃতি বিস্মৃতির নগরী আমার চিরসঙ্গী হয়ে থাকবে।’ আর আখতারুজ্জামান ইলিয়াস বলেন- মুনতাসীর মামুন ইতিহাসের বিশিষ্ট গবেষক কিন্তু পূর্বসূরিদের মতো তাঁর কাছে ঢাকা কেবল গবেষণার বিষয় নয়। তাঁর কৈশোর থেকেই ঢাকা তাঁকে তীব্রভাবে আকর্ষণ করে আসছে। আবার ঢাকা নিয়ে লেখা তাঁর বইগুলো ঢাকার প্রতি অনেকের আকর্ষণ বাড়িয়ে দিয়েছে অনেক গুণ। তিনি কেবল বিদ্যাচর্চার জন্যে এই শহরটিকে বেছে নেননি। এই নগরীর রাস্তা, ফুটপাথ, দালানকোঠা, বস্তি, পার্ক, ঘাস, লতাপাতা, গাছগাছড়া, জীবজন্তু ও সর্বোপরি মানুষ, হ্যাঁ, সব সময়কার সব মানুষই তাঁর আনন্দ ও উদ্বেগের কারণ। বৃহত্তর বাঙালীর মাঝে আন্তর্জাতিক যে কোন নগরীর পাশাপাশি ‘ঢাকা’কেন্দ্রিক বোধ নির্মিতিতে মামুনের অবদান এক ও অনন্য। তাঁর সে ঢাকা-যজ্ঞ কেবল বিপুলসংখ্যক মৌলিক ও সম্পাদিত বইয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; ঢাকা নগর জাদুঘর প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়েও তাঁর ঢাকা-অন্বেষা ব্যাপ্তি পায়। তাঁর এ কাজ আর্কাইভাল দিক থেকে মূল্যবান শুধু নয়, ঢাকাকে আমাদের ‘প্রাইড আইকন’ হিসেবেও মনোজগতে প্রতিষ্ঠা দেয়। ঢাকার ঈদমিছিল থেকে শুরু করে জন্মাষ্টমীর মিছিলের ইতিহাস প্রণয়ন করে এই নগরীর সেক্যুলার অভিমুখকেও ইতিহাসের পটে শনাক্ত করেন তিনি। কবি বেলাল চৌধুরীকে লেখা দুই বাংলার কবি-লেখক-গবেষকদের চিঠিপত্র সংকলন করতে গিয়ে দেখি পশ্চিমবঙ্গের প্রখ্যাত গবেষক সুমন্ত বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯৯৬-তে লেখা একটি চিঠিতে খোঁজ করছেন স্মৃতিময় ঢাকা, পুরনো ঢাকা- উৎসব ও ঘরবাড়ি বই দুটো, লেখক-মুনতাসীর মামুন। ইতিহাস বিষয়ক কোন এক প্রবন্ধে উদ্ধৃতি দেখে বই দুটো তাঁকে আগ্রহী করে তোলে। দেশের প্রান্ত ছাড়িয়ে এভাবে তার ঢাকা কৌতূহল তৈরি করে দেশান্তরের মানুষের মাঝেও। এই বইমেলার (২০১৬) ঘটনা। কবিকে নিয়ে কবিতা বইয়ের জন্য সিটি-আনন্দ আলো সাহিত্য পুরস্কার পাই আমি। যত না আনন্দিত হই নিজের পুরস্কারপ্রাপ্তিতে তার চেয়ে বেশি আপ্লুত হই এই কারণে যে ঢাকার খাল পোল ও নদীর চিত্রকর নামের অসামান্য বইটির জন্য ২০১৬তে একই পুরস্কারের আরেকজন প্রাপক ছিলেন মুনতাসীর মামুন। ॥ তিন ॥ মুনতাসীর মামুন ইতিহাসচর্চাকে কোন শুষ্ক বা একরৈখিক সরণিতে এনে দাঁড় করাননি। তাই উনিশ শতকের পূর্ববঙ্গ থেকে উনিশশ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ- উভয়ই তাঁর গবেষণার বিষয় হয়ে যায় অনায়াসে। দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তর ইতিহাস থেকে পূর্ববঙ্গের পঞ্চায়েতের ইতিহাস- সবই তাঁর আগ্রহের বিষয়। ডাকসুর মুখপত্র ছাত্রবার্তার সম্পাদক যে এক সময় উনিশ শতকে বাংলাদেশের সংবাদ-সাময়িকপত্রের মতো মহাকায় সাময়িকপত্র-গবেষণায় হাত দেবেন তা হয়ত ইতিহাস-নির্ধারিতই ছিল। ব্রিটিশদের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত, বঙ্গভঙ্গ কিংবা পাকিস্তানীদের গণহত্যা, যার মধ্যমেই বাংলা ও বাঙালীকে হতমান ও নিশ্চিহ্ন করতে চাওয়া হয়েছে তিনি সেইসব প্রকল্পের কুলঠিকুজি সন্ধান করেছেন যুগপৎ একজন একাডেমিশিয়ান ও দেশপ্রেমিক নাগরিক হিসেবে। ইতিহাসের বিষয়কে সামগ্রতাবাদী কোণ থেকে বিচার করতে চান বলেই সেইসব পাকিস্তানী, শান্তি কমিটি ১৯৭১, রাজাকারের মন এর মতো বইয়ের মধ্য দিয়ে বাঙালীবিরোধী পক্ষের আত্মঅবস্থান ও মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণ করেছেন। আমরা অনেক ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বায়বীয়, শূন্যসার কথা বলি। মুনতাসীর মামুন এক্ষেত্রে বিরল ব্যতিক্রম। আর্মি ব্যুরোক্রেসির বিরুদ্ধে ‘সিভিল সমাজ’ ভাবকল্পটি প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি তাঁর বিপুল-ব্যাপক গবেষণাকর্মের সমান্তরালে লিখে চলেছেন সামরিকায়ন, সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদবিরোধী ক্ষুরধার রাজনৈতিক বিশ্লেষণ। এ বিষয়ে তাঁর পিতৃব্য বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ তাৎপর্যপূর্ণ- রাজনৈতিক পরিবর্তনের ফলে সাংস্কৃতিক স্মৃতি বদলে যেতে থাকে বলেই মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক তার বিভিন্ন বই, রাজাকারের মন বিষয়ক তার বিভিন্ন কাজের দূরস্পর্শিতা স্মর্তব্য। এই দায়িত্ববোধ থেকে তিনি সিভিল সমাজের রাজনৈতিক আন্দোলন, জিয়াউর রহমান ও এরশাদের স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সিভিল সমাজের বিদ্রোহের স্মৃতি নিয়ে কাজ করেছেন। সরকারী স্মৃতির বিপক্ষে যারা স্বৈরশাসনের শিকার তারা হচ্ছেন, মামুনের দিক থেকে- বিভিন্ন স্মৃতি, কাউন্টার বিদ্রোহ স্মৃতি। সিভিল সমাজের দায়িত্ব, সিভিল সমাজের বিদ্রোহ উদ্দীপিত রাষ্ট্রব্যবস্থার মধ্যে বিদ্রোহ-উৎসারিত সাংস্কৃতিক স্মৃতির অনবরত চর্চা করা। মামুন এই কাজটাই করে চলেছেন ভবিষ্যতের প্রতি দায়িত্ববোধ থেকে। ম্যানিলা থেকে মংলা- তিনি ঘুরে বেড়ান বাংলা হয়ে বিশ্বমায়ের হৃৎসত্তার সন্ধানে। বাঙালিত্বের বোধ প্রতিষ্ঠার কাজটিও তাই বড় প্রেক্ষিতের। এই বাংলাদেশ সিরিজে লক্ষ্য করা যাবে- হাতিয়া, উখিয়া, সীতাকুণ্ড, ইনানি, মনখালী, বাঁকখালী, মহেশখালী, কুতুপালং, জাফলং, কুসুম্বা, নাটোর, ফকিরহাট, বিরামপুর, পঞ্চগড়, তেঁতুলিয়া, চুকনগরের পথে-ঘাটে, জলে-পাহাড়ে তাঁর স্বদেশসন্ধান। ইতিহাস এভাবে বইয়ের পাতা থেকে মানুষের মুখে পায় অভিনতুন পরিসর। রেমব্রান্টের বাড়ি, এক সকালে বইয়ের লেখক মুনতাসীর মামুন যে হাশেম খান, মনিরুল ইসলামের মতো চিত্রশিল্পীদের সঙ্গে স্পেনের পথে-প্রান্তরে ভ্রমণের হৃদয়ছোঁয়া বৃত্তান্ত রচনা করবেন মাদ্রিদে তিন বাঙাল শিরোনামে তা তো খুবই সঙ্গত। চিত্রকলার পাশাপাশি আলোকচিত্রেও তাঁর অভিযান; ঢাকা ১৯৭১ আলোকচিত্র-এলবাম এ অভিযানেরই সবল সাক্ষ্য। আমরা প্রত্যাশায় থাকি, তিনি নিজেও লিখবেন ইতিহাসের খিড়কি থেকে সিংহদুয়ার পর্যন্ত তাঁর এক জীবনের অভিযানের অভিযান ও জয়গাথা। সে গাথা থেকে রসদ পাবে সকলেই। সালাহউদ্দীন আহমেদ, সরদার ফজলুল করিম প্রমুখের স্মরণসভায় দেখেছি পূর্বগামীদের প্রতি কী অসীম শ্রদ্ধায় আনত তিনি; আর সমকালের তরুণদের প্রতি তাঁর প্রশ্রয়ও সুবিদিত। অগ্রজ-অনুজ, সহযাত্রী সবার মাঝে যিনি ছড়িয়ে দিতে পারেন প্রভাববিন্দু তাঁর নিজের জীবনের কথা সবিস্তারে জানার অপেক্ষায় থাকি আমরা সবাই। জীবনের পঁয়ষট্টি বসন্তে এসে আর লেখালেখির প্রায় অর্ধশতকে দাঁড়িয়ে মুনতাসীর মামুন নিশ্চয়ই লিখবেন তাঁর জীবনের গল্প, যে রুপালি-স্বর্ণালি গল্প হয়ে উঠবে উত্তরকালের পাঠক-গবেষকের কাছে ইতিহাসেরই অনন্য আকর।
×