ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

কেশবপুরের ১১ ইউনিয়নেই বিদ্রোহী প্রার্থীদের দাপট

প্রকাশিত: ২৩:৫৩, ২৩ মে ২০১৬

কেশবপুরের ১১ ইউনিয়নেই বিদ্রোহী প্রার্থীদের দাপট

স্টাফ রিপোর্টার, যশোর অফিস ॥ যশোরের কেশবপুর উপজেলায় ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থীদের দাপটে আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থীরা কোনঠাসা হয়ে পড়েছে। প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো ইউনিয়নে আওয়ামী লীগ দলীয় ও বিদ্রোহী প্রার্থীদের মধ্যে হামলা, সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে। অভিযোগ উঠেছে, জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও স্থানীয় সংসদ সদস্য-প্রতিমন্ত্রী বিদ্রোহীদের পক্ষ নিয়ে নৌকার বিপক্ষে মাঠে রয়েছেন। ‘বিদ্রোহী প্রার্থীরা জিতবে’ জেলা আইন শৃঙ্খলা কমিটির সভায় এমন মন্তব্যও করেছেন জেলা আ’লীগ সভাপতি। যদিও ১১ ইউনিয়নের বিদ্রোহী ১২ প্রার্থীকে দল থেকে বহিষ্কার করেছে জেলা আওয়ামী লীগ। এসব কারণে আওয়ামী লীগের তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীরা আতঙ্কে রয়েছেন। স্থানীয় সূত্র জানায়, পঞ্চম ধাপে আগামী ২৮ মে কেশবপুর উপজেলার ১১ টি ইউনিয়নে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এখানকার ১১টি ইউনিয়নে নৌকার ১১ জন প্রার্থীর বাইরে ১৫জন আ’লীগ নেতা বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। ১ নং ত্রিমোহিনী ইউনিয়নে চেয়ারম্যান পদে আ’লীগ মনোনীত আনিছুর রহমান ও বিদ্রোহী লতিফুল কবির মনি মাঠে রয়েছেন। ২ নং সাঁগরদাড়ি ইউনিয়নে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মোস্তাফিজুল ইসলাম মুক্ত আওয়ামী লীগের ও বিদ্রোহী শাহাদাৎ হোসেন প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রয়েছেন। ৩ নং মজিদপুর ইউনিয়নে লড়াইয়ে রয়েছেন আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী মজিদপুর ইউনিয়ন আ’লীগের সাধারণ সম্পাদক গাজী গোলাম সরোয়ার এবং বিদ্রোহী হিসেবে রয়েছেন সাবেক চেয়ারম্যান শহিদুল ইসলাম ও মাও. আব্দুল হালিম। ৪ নং বিদ্যানন্দকাটি ইউনিয়নে আ’লীগ মনোনীত ইব্রাহিম হোসেন ও বিদ্রোহী আমজাদ হোসেন মুখোমুখি অবস্থানে রয়েছেন। ৫ নং মঙ্গলকোট ইউনিয়নে আব্দুল কাদের বিশ্বাস নৌকার ও বর্তমান চেয়ারম্যান মনোয়ার হোসেন নৌকার বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন। ৬ নং কেশবপুর সদর ইউনিয়নে শাহাদাৎ হোসেন আওয়ামী লীগের এবং আফসার উদ্দিন গাজী বিদ্রোহী প্রার্থীর অবস্থানে রয়েছেন। ৭ নং পাঁজিয়া ইউনিয়নে বিএনপির পাঁজিয়া আ’লীগের সভাপতি শফিকুল ইসলাম মুকুল নৌকার ও ইয়ার মাহমুদ বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন। ৮ নং সুফলাকাটি আ’লীগ মনোনীত আব্দুস সামাদ সরদার ও এস এম মহব্বত হোসেন, আজাহারুল ইসলাম ও রুহুল আমিন বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে মাঠে রয়েছেন। ৯ নং গৌরিঘোনা ইউনিয়নে ইউনিয়ন আ’লীগের সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান হাবিব ও বিদ্রোহী এস এম সিদ্দিকুর রহমান প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রয়েছেন। ১০ নং সাতবাড়িয়া ইউনিয়নে শামছুদ্দীন আ’লীগের ও মশিয়ার রহমান দফাদার বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে মাঠে রয়েছেন। ১১ নং হাসানপুর ইউনিয়নে শহীদুজ্জামান শাহীন নৌকার এবং নৌকার বিপক্ষে আ’লীগের বিদ্রোহী আলতাফ হোসেন ও অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের অভিযোগ, উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে প্রতিদিনই আওয়ামী লীগ মনোনীত ও বিদ্রোহী প্রার্থীর কর্মী সমর্থকদের মধ্যে হামলা পাল্টা হামলা, প্রার্থীর অফিস, মটরসাইকেল ভাংচুরের ঘটনা ঘটে চলছে। ইতোমধ্যে উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে অন্তত শতাধিক নেতা কর্মী আহত হয়েছেন। মঙ্গলকোট ইউনিয়নে আ’লীগ ও বিদ্রোহী প্রার্থীর সমর্থকদের সংঘর্ষে ২৪ জন হয়েছেন। সাগরদাঁড়ি ও কেশবপুর সদর ইউনিয়নে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। ১২ মে রাতে গৌরীঘোনা ইউনিয়নে আওয়ামী লীগ’র হাবিবুর রহমান ও বিদ্রোহী সিদ্দিকুর রহমানের কর্মী সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে ২৫ কর্মী আহত হয়। এ সময় আ’লীগ মনোনীত প্রার্থীর কার্যালয় ভাংচুরের ঘটনা ঘটে। পরদিন হাসানপুর ইউনিয়নে সংঘর্ষে অন্তত ১৫ নেতা কর্মী আহত হয়। সর্বশেষ রবিবার রাতে সাতবাড়িয়া ইউনিয়নে আওয়ামী লীগ সমর্থিত চেয়ারম্যান প্রার্থী শামছুদ্দিন দফাদারের নির্বাচনী কার্যালয় ভাংচুর করে জ্বালিয়ে দিয়েছে সন্ত্রাসীরা। এছাড়া মজিদপুর, ত্রিমোহিনীসহ আরও কয়েকটি ইউনিয়নে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় থানায় অভিযোগ দায়েরের হিড়িক পড়েছে। ফলে সাধারণ ভোটারদের দেখা দিয়েছে চরম আতঙ্ক। যদিও জেলা আওয়ামী লীগ বিদ্রোহী ১২ প্রার্থীকে দল থেকে বহিষ্কার করেছে। গৌরিঘোনা ইউনিয়নে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী ইউনিয়ন আ’লীগের সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান হাবিব জানিয়েছেন, এই ইউনিয়নে বিদ্রোহী প্রার্থী সিদ্দিকুর রহমান আওয়ামী লীগের স্থানীয় এমপি প্রতিমন্ত্রী ইসমাত আরা সাদেকের নাম ব্যবহার করে প্রচারণা চালাচ্ছেন। পাশাপাশি সন্ত্রাসী বাহিনী নিয়ে সংখ্যালঘু ভোটারদের নানাভাবে হুমকি, ধামকি দিয়ে নির্বাচনী পরিবেশ নষ্ট করছেন। ইতোপূর্বে তার বাহিনী নৌকা প্রতীকের অফিসও ভাংচুর করেছে। মন্ত্রীর নাম ব্যবহার করায় প্রশাসনও এখানে প্রভাবিত। তাই নৌকা প্রতীকের উপর হামলা হলেও পুলিশ প্রশাসনের কোনো তাপ উত্তাপ নেই। তবে বিদ্রোহী প্রার্থী এস এম সিদ্দিকুর রহমান দাবি করেছেন, স্থানীয় মন্ত্রী ও জেলা সভাপতি স্বাক্ষরিত প্রাথমিক তালিকায় তার নাম থাকলেও অনিয়ম ও টাকার কারণে তিনি নৌকা প্রতীক বঞ্চিত হয়েছেন। তারপরও ইউনিয়নবাসীকে সাথে নিয়ে তিনি নির্বাচনী মাঠে রয়েছেন। ইউনিয়নে নৌকা প্রতীকের অফিসে হামলা বা সংখ্যালঘুদের হুমকির বিষয়টি অস্বীকার করে তিনি বলেছেন, তার কোনো লোক এধরণের ঘটনায় জড়িত নয়। আরেক বিদ্রোহী প্রার্থী কেশবপুর সদর ইউনিয়নে আফসার উদ্দিন গাজী জানান, স্থানীয়ভাবে তাকে একক প্রার্থী হিসেবে নির্ধারণ করা হয়। এ সংক্রান্ত কাগজপত্র তিনি স্থানীয় মন্ত্রীকে (ইসমাত আরা সাদেক) দিয়েছিলেন। কিন্তু মন্ত্রীর তালিকার কেউ মনোনয়ন পায়নি। মন্ত্রী তার জন্য চেষ্টাও করেছিলেন। কিন্তু দশ লাখ টাকায় মনোনয়ন কেনাবেচা হওয়ায় সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। তাই নাগরিক সমাজের দোয়া নিয়ে তিনি ভোটে দাঁড়িয়েছেন। তবে মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতির নাম ব্যবহারের অভিযোগ তিনি অস্বীকার করেছেন। এদিকে, রবিবার যশোরে আইন শৃঙ্খলা কমিটির সভায় জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি শহিদুল ইসলাম মিলনও কেশবপুরের নির্বাচনী পরিবেশ নিয়ে বক্তব্য দিতে গিয়ে প্রার্থী মনোনয়নের সমালোচনা করেছেন। তিনি সভায় বলেছেন, কেশবপুরে প্রার্থী মনোনয়ন ঠিক হয়নি, এ কারণে সেখানে বিদ্রোহী প্রার্থীরাই জিতবে। আওয়ামী লীগ সভাপতির এ বক্তব্যে স্থানীয় নেতাকর্মীদের মাঝেও ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। এ প্রসঙ্গে যশোর জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি শহিদুল ইসলাম মিলন জানিয়েছেন, আইন শৃঙ্খলা কমিটির সভার বক্তব্য প্রশাসনিক বিষয়। নির্বাচনে মারামারি যাতে না হয় সেজন্য অনেক কথাই বলতে হয়। এটি ওই সভার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। নির্বাচন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, কেশবপুরে হয় বিদ্রোহী প্রার্থী জিতবে না হয় আওয়ামী লীগ প্রার্থী জিতবে। তবে আইন শৃঙ্খলা কমিটির সভায় বললেও গণমাধ্যমে ‘ত্রুটিপূর্ণ’ মনোনয়নের ব্যাপারে মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান এবং বিদ্রোহী প্রার্থীদের পক্ষে থাকার বিষয়টি অস্বীকার করেন। তবে কেশবপুরের নির্বাচনের ব্যাপারে যশোরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার কেএম আরিফুল হক সাংবাদিকদের জানান, শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানে বদ্ধপরিকর প্রশাসন। ইতোমধ্যে নির্বাচনী এলাকা সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান চলছে। বহিরাগত সন্ত্রাসী নিয়ন্ত্রণে কঠোর অবস্থান রয়েছে তাদের। প্রশাসন প্রভাবমুক্ত হয়েই কাজ করছে বলে তিনি দাবি করেন।
×