ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

বাস ভাড়া কমেনি -মালিকপক্ষ অনড় অবস্থানে

প্রকাশিত: ০৫:৫৯, ২২ মে ২০১৬

বাস ভাড়া কমেনি -মালিকপক্ষ অনড় অবস্থানে

রাজন ভট্টাচার্য ॥ বেপরোয়া পরিবহন মালিকরা। আন্তঃজেলা রুটে বাসভাড়া কমানোর নির্দেশনা তারা মানছেন না। দুই দফা সময় দেয়ার পরও সারাদেশে পুরনো ভাড়াই আদায় করা হচ্ছে যাত্রীদের কাছ থেকে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারী নির্দেশনাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে আগের ভাড়া আদায় করলেও একটি পরিবহন কোম্পানির বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিতে পারেনি মন্ত্রণালয়। নামমাত্র মনিটরিং টিম গঠন করে দায়সারা চেষ্টা চালাচ্ছে বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ)। এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সাধারণ যাত্রীরা। মালিক সমিতি বলছে, আস্তে আস্তে পরিস্থিতির উন্নতি হবে। মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, অল্প টাকা ভাড়া কমায় তা অনেকের নজর এড়িয়ে যাচ্ছে। গত ২৬ বছরে বাস ভাড়া বেড়েছে পাঁচ গুণ। তেলের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় ২০০৩ সালের পর অন্তত পাঁচবার পরিবহন ভাড়া বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত কার্যকর হয়েছে। তেলের দাম কমায় ২০০৯ সাল থেকে তিন দফা ভাড়া কমানোর ঘোষণা দেয়া হলেও এক একটিও যথাযথ বাস্তবায়ন হয়নি। শুক্র ও শনিবার রাজধানীর বিভিন্ন বাস টার্মিনালে ঘুরে ভাড়া কমানোর কোন তথ্য মেলেনি। সব যাত্রীই অভিযোগ করেছেন আগের ভাড়া আদায় করছে পরিবহন কোম্পানিগুলো। কোন বাস কাউন্টারের সামনে নতুন ভাড়ার তালিকা দেখা যায়নি। তবুও সন্তুষ্ট সরকারী মনিটরিং কমিটি। তারা বিআরটিএ ও সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়কে ভাড়া বাস্তবায়ন হওয়ার খবর সরবরাহ করছে। এদিকে যাত্রী অধিকার নিয়ে কাজ করা যাত্রী কল্যাণ সমিতি বলছে, দেশের কোথাও বাস ভাড়া কমানোর খবর পাওয়া যায়নি। তবে রাজধানীর তিনটি রুটে বাস ভাড়া কমানোর কথা না থাকলেও বাড়ানো হয়েছে বলে অভিযোগ সংগঠনের নেতাদের। শনিবার সরকার নির্ধারিত বাসভাড়া যথাযথ কার্যকর হচ্ছে কিনা, তা সরেজমিন দেখতে মহাখালী বাস টার্মিনালে যাওয়ার কথা ছিল সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের। সকালে কর্মসূচী বাতিল করা হয়েছে। ভাড়া প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিআরটিএ সচিব শওকত আলী জনকণ্ঠ’কে বলেন, নতুন ভাড়া যেন যথাযথভাবে কার্যকর করা হয় সেজন্য আমরা তিনটি মনিটরিং টিম গঠন করেছি। গাবতলী, মহাখালী ও সায়েদাবাদ টার্মিনালে এসব টিম কাজ করছে বলে জানান তিনি। তালিকা অনুযায়ী যাত্রীদের থেকে ভাড়া নেয়া হচ্ছে কিনা, তা তদারকি করবেন মনিটরিং কমিটির সমস্যরা। কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া গেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বেশিরভাগ বাস কোম্পানি নতুন ভাড়া বাস্তবায়ন শুরু করেছে। তবে খুব অল্প টাকা ভাড়া কমায় তা অনেকের নজরে আসছে না বলে মনে করেন তিনি। দূরপাল্লার বাস ভাড়া কমানোর বিষয়ে জানতে চাইলে যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক জনকণ্ঠ’কে বলেন, বাস ভাড়া কমাতে দু’দফা সময় দিয়েছিল সরকার। কিন্তু মালিক সমিতি সরকারের নির্দেশনা মানছে না। দেশের কোন রুটে বাস ভাড়া কমানোর খবর পাওয়া যায়নি একথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ১৫ মে থেকে বাস ভাড়া কমানোর কথা থাকলেও তা হয়নি। তখন আমরা নিজস্ব মনিটরিং টিম গিয়ে বিভিন্ন রুটে খবর নিয়ে দেখি আগের ভাড়া আদায় হচ্ছে। তাই এবারও পরিস্থিতি খুব একটা উন্নতি হবে তা মনে হয় না। তিনি অভিযোগ করে বলেন, সরকারী নির্দেশ অনুযায়ী রাজধানীতে বাস ভাড়া কমানোর কথা না থাকলেও তিনটি পরিবহন সিটিং সার্ভিস ও কম স্টপেজের নামে তিন দিন ধরে বাড়তি ভাড়া যাত্রীদের থেকে আদায় করছে। মিরপুর রুটে চলা ট্রাস্ট পরিবহন, কালশী থেকে সদরঘাট পর্যন্ত একটি পরিবহন ও তুরাগ পরিবহনে ভাড়া বাড়ানোর কথা উল্লেখ করেন তিনি। ২৬ বছরে ভাড়া বেড়েছে পাঁচ গুণ ॥ পরিসংখ্যান বলছে, গত ২৬ বছরে বাস ও মিনিবাসের ভাড়া বেড়েছে প্রায় পাঁচ গুণ। মূলত ডিজেলের দাম বাড়ানোর কারণেই বাসের ভাড়া বাড়ানো হয়েছে। এ সময়ে ডিজেলের দামও বেড়েছে চার গুণ। ১৯৯০ সালে ডিজেলের দাম ছিল প্রতি লিটার ১৭ টাকা। ওই সময় বাসভাড়া প্রতি কিলোমিটারে ছিল ৩২ পয়সা। এখন ডিজেলের দাম প্রতি লিটার ৬৫ টাকার বেশি। আর বাস ভাড়া হয়েছে ১ টাকা ৪৫ পয়সা। বর্তমানে দেশের ৬০ ভাগ যানবাহন ডিজেল ও অকটেনে চালিত। যাত্রী কল্যাণ সমিতি বলছে, সরকার নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে অনেক বেশি আদায় করা হচ্ছে যাত্রীদের কাছ থেকে। এছাড়া পাঁচ টাকা জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হলে ১০ টাকা ভাড়া বাড়ানো হয়। আর পাঁচ টাকা তেলের দাম কমানো হলে ভাড়া কমে দুই টাকা। গত ২৬ বছরে যতবার ভাড়া কমানো হয়েছে একবারও এর যাত্রীরা সুফল পাননি। প্রকৃত অর্থে ভাড়া কমানোর বিষয়টি ছিল কাগজেকলমে। এতে লাভবান হয়েছে পরিবহন মালিকরাই। নীরবে পকেট কাটা গেছে যাত্রীদের। তাছাড়া ভাড়া কমানোর পর তা কার্যকর করতে কখনই সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় আন্তরিক ভূমিকা পালন করেনি। ডিজেলের মূল্য লিটারপ্রতি ২০ টাকা হওয়ার পর ২০০৩ সালের ৯ মার্চ কিলোমিটারপ্রতি বাস ভাড়া বেড়ে দাঁড়ায় ৭২ পয়সা। ডিজেলের মূল্য লিটারপ্রতি ২৬ টাকা হওয়ার পর ২০০৫ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর বাস ভাড়া বাড়িয়ে কিলোমিটারপ্রতি ৮০ পয়সা নির্ধারণ করা হয়। ২০০৮ সালে জুলাই মাসে জ্বালানি তেলের লিটারপ্রতি দাম হয় ৫৫ টাকা। তখন ফেরি ভাড়া বাদে কিলোমিটারপ্রতি বাস ভাড়া হয় এক টাকা পাঁচ পয়সা। একই বছরে তেলের দাম কমে লিটারপ্রতি হয় ৪৮ টাকা। তখন কোন ব্যয় বিশ্লেষণ না করেই লিটারপ্রতি সাত টাকা তেলের দাম কম হওয়ায় কিলোমিটারপ্রতি সাত পয়সা ভাড়া কমানো হয়। যা যথাযথ কার্যকর হয়নি। ২০০৯ সালের জ্বালানি তেলের দাম আরেক দফা কমে লিটার প্রতি দাঁড়ায় ৪৪ টাকা। তখন চার পয়সা ভাড়া কমানো হয়। ২০১১ সালে লিটারপ্রতি তেলের দাম ৪৬ টাকা হওয়ায় প্রতি কিলোমিটারে বাস ভাড়া এক টাকা ১৫ পয়সা নির্ধারণ করা হয়। একই বছরে আরেক দফা বাড়ে তেলের দাম। ২০১২ সালে ফের তেলের দাম বেড়ে লিটারপ্রতি হয় ৬১ টাকা। তখন কিলোমিটারপ্রতি ভাড়া হয় এক টাকা ৩৫ পয়সা। এরপর ২০১৩ সালে তেলের দাম বৃদ্ধির পর আন্তঃজেলায় কিলোমিটারপ্রতি বাস ভাড়া এক টাকা ৪৫ পয়সা নির্ধারণ করা হয়েছে। গত ৩ মে ডিজেলে চালিত দূরপাল্লার পরিবহনের ভাড়া ৩ পয়সা কমিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ঢাকা ও আশপাশের কয়েকটি জেলা এবং চট্টগ্রাম মহানগরী ব্যতীত আন্তঃজেলা ও দূরপাল্লার রুট পরিচালিত ডিজেল চালিত বাস ও মিনিবাসের ভাড়া কিলোমিটারপ্রতি ১ টাকা ৪৫ পয়সা থেকে কমিয়ে ১ টাকা ৪২ পয়সা করা হলো। যা ১৫ মে থেকে কার্যকরের নির্দেশও দেয়া হয়। কিন্তু বাস মালিক সমিতি তা কার্যকর করেনি। দ্বিতীয় দফায় সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় থেকে পাঁচ দিন সময় বাড়ানো হয়, যা শুক্রবার থেকে ভাড়া কমানোর কার্যকরের নির্দেশ দেয়া হয়। দ্বিতীয় পর্বে ভাড়া কমানোর দিনক্ষণ ঠিক করে দেয় সরকার। কিন্তু বাস্তবে এর প্রতিফলন ঘটেনি। গত ১৫ মে বাস ভাড়া কার্যকরের প্রথম দিন সকাল এগারোটায় সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের গাবতলী বাস টার্মিনাল পরিদর্শন করেন। তিনি যাত্রী ও বাস মালিকদের সঙ্গে কথা বলেন। মন্ত্রী বুঝে ফেলেন আগের ভাড়াই রাখা হচ্ছে। এতে তাৎক্ষণিক ক্ষোভও দেখান সড়কমন্ত্রী। পরে বাস মালিক সমিতির অনুরোধে আরও পাঁচদিন সময় দেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেছেন, ‘২০ মে থেকে ডিজেল চালিত পুনর্নির্ধারিত বাস ভাড়া কঠোরভাবে কার্যকর করা হবে। কেউ এই নির্দেশ অমান্য করলে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে বলেও সেতুমন্ত্রী মালিকদের হুঁশিয়ার করেন। শুক্রবার ও শনিবার রাজধানীর কমলাপুর, কল্যাণপুর, গাবতলী সরেজমিনে দেখা গেছে সব ডিজেল চালিত দূরপাল্লার কাউন্টারে আগের ভাড়াই রাখা হচ্ছে। কোন কাউন্টারেই কোন ভাড়ার তালিকা টানানো হয়নি। দিনাজপুর হিলির যাত্রী জুয়েল রানার। তিনি জানান, হিলি থেকে ৪৫০ টাকা ভাড়া দিয়ে ঢাকায় এসেছেন। শনিবার সকাল সোয়া নয়টায় কল্যাণপুর এস আর প্লাস পরিবহনে তার কাছে ৪৫০ টাকাই রাখা হয়েছে। এসআর প্লাসের টিকেট মাস্টার জয়নাল মিয়া জানান, দূরত্ব অনুযায়ী আমরা এমনিতেই ভাড়া কম রাখা হয়। এছাড়া মালিক পক্ষ থেকে কোন নির্দেশনা পাওয়া যায়নি। তাই আগের ভাড়া রাখা হচ্ছে। সায়েদাবাদ থেকে থেকে বৃহত্তর সিলেট ও চট্টগ্রামে চলা পরিবহন থেকে আগের ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। সুনামগঞ্জ থেকে আসা যাত্রী নিজাম জানান, আগে ভাড়া ছিল ৪৫০ টাকা। এখনও তাই। এক টাকাও ভাড়া কমেনি। গাবতলী বাস টার্মিনাল থেকে আন্তঃজেলা শহরে চলাচলকারী বিভিন্ন গণপরিবহনেও আগের ভাড়া রাখা হচ্ছে। মানিকগঞ্জের বালিরটেক যাত্রী মোঃ বাদল মিয়া। তিনি জানান, গাবতলী থেকে বালিরটেক ভাড়া আগে ৭০ টাকাই রাখা হচ্ছে। জানতে চাইলে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ জনকণ্ঠকে বলেন, আমি যতদূর খবর পেয়েছি কিছু কিছু রুটে সরকার নির্ধারিত বাস ভাড়া কার্যকর হয়েছে। আশা করি পর্যায়ক্রমে সব রুটেই নতুন ভাড়া কার্যকর হবে। মহাখালী আন্তঃজেলা বাস মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কালাম জনকণ্ঠকে বলেন, মহাখালী থেকে সব রুটের বাস ভাড়া কার্যকর হয়েছে। শুক্রবার সকাল থেকেই নতুন ভাড়ায় যাত্রীরা যাতায়াত করছেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো মহাখালীর কোন কাউন্টারেই নতুন ভাড়ার তালিকা দেখা যায়নি। বিভিন্ন জেলা থেকে আসা যাত্রীদের থেকে পুরনো ভাড়া আদায়ের অভিযোগ মিলেছে। সন্ধ্যায় মহাখালী বাস টার্মিনালের নেত্রকোনার শাহজালাল কাউন্টারে-০১৭১৭০৫৮১৫১ এই নম্বরে ফোন করা হলে জানানো হয় পুরনো ভাড়া ২৫০ টাকাই রাখা হচ্ছে।
×