ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সিন্ডিকেটের কারসাজিতে রমজানের আগেই অস্থির ভোগ্যপণ্য বাজার

প্রকাশিত: ০৫:৩৭, ২১ মে ২০১৬

সিন্ডিকেটের কারসাজিতে রমজানের আগেই অস্থির ভোগ্যপণ্য বাজার

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ রমজান সামনে রেখে অত্যাবশ্যকীয় ১২টি পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। এর মধ্যে রমজানে সর্বোচ্চ চাহিদার ভোজ্যতেল, চিনি, ছোলা, পেঁয়াজ, ডাল ও খেজুরের দাম বেড়েছে সবচেয়ে বেশি। ব্যবসায়ীদের কারসাজি ও সিন্ডিকেশনের কারণেই পণ্যের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে দাম বাড়বে না বলে ব্যবসায়ীরা সরকারকে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তা আর রক্ষা হয়নি। মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে অবশেষে ‘ওয়াদা’ ভঙ্গ করলেন ভোগ্যপণ্যের ব্যবসায়ীরা। দুর্বল বাজার তদারকি এবং যথাযথ আইন প্রয়োগের অভাবের কারণে তারা অতিরিক্ত মুনাফা করার সুযোগ পাচ্ছেন। দাম বাড়ানোর কৌশল নেয়ায় ভোগ্যপণ্যের বড়মাপের ১০ জন ব্যবসায়ীকে ইতোমধ্যে চিহ্নিত করা হয়েছে। কিন্তু নিয়মিত বাজার পর্যবেক্ষণ না থাকার সুযোগে ভোগ্যপণ্যের বাজার অস্থির হয়ে উঠছে। সরকারী তথ্যমতে, এ মুহূর্তে দেশে নিত্যপণ্যের কোন ঘাটতি নেই। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে এ তথ্য। জানা গেছে, ভোক্তাদের স্বার্থ বিবেচনায় নিয়ে ১৭টি পণ্যকে অত্যাবশ্যকীয় পণ্য হিসেবে ঘোষণা করেছে সরকার। পণ্যগুলোকে অত্যাবশ্যকীয় করার উদ্দেশ্য হচ্ছে- ভোক্তাদের স্বার্থ সংরক্ষণ করে ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা। কিন্তু রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে ও গত এক বছরের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে- শব-ই-বরাতের আগেই ১২টি পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। এসব পণ্যের মধ্যে রয়েছেÑ সয়াবিন তেল, পামতেল, রসুন, মসুর ডাল, ছোলা, চিনি, ধনিয়া, জিরা, আদা, হলুদ, তেজপাতা ও খাদ্য লবণ। এছাড়া দাম অপরিবর্তিত রয়েছে শুধু দারুচিনি ও তেজপাতার। লবঙ্গ, এলাচ ও ধনেপাতাসহ তিনটি পণ্যের দাম হ্রাস পেয়েছে। সরকার নিয়ন্ত্রিত সংস্থা ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্যমতে, এক বছরে শুধু রসুনের দাম বেড়েছে ১২১ শতাংশ পর্যন্ত। এছাড়া মসুর ডাল ২২, পামওয়েল ১২, সয়াবিন তেল ৬, চিনি ৪৮, ছোলা ৬১ এবং লবণে ৩৩ শতাংশ পর্যন্ত দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। গত বছরের তুলনায় এবার পেঁয়াজের দাম কিছুটা স্থিতিশীল থাকলেও রমজান শুরু হলে দাম বাড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। যদিও বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বারবার বলে আসছেন, রমজান সামনে রেখে চাহিদার তুলনায় বেশি পণ্য মজুদ ও আমদানি হয়েছে। তাই কোন পণ্যের দাম বাড়বে না। এছাড়া পণ্যমূল্য বাড়ানোর কারসাজির আশ্রয় নেয়া হলে দায়ী ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন তিনি। কিন্তু রোজার আগেই জিনিসপত্রের দাম বেড়ে গেছে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব হেদায়েতুল্লাহ আল মামুন জনকণ্ঠকে বলেন, রোজা সামনে রেখে ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব। তবে চিনি, ডাল, রসুনসহ কয়েকটি পণ্যের দাম বেড়ে গেছে স্বীকার করে তিনি বলেন, এখনও সহনীয় পর্যায়ে রয়েছে। সামনের দিকে দাম আরও বাড়লে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। তিনি জানান, চিনি আমদানিতে ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। পণ্যটির দাম নাগালের বাইরে চলে গেলে তা নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজনে শুল্ক প্রত্যাহর করা হতে পারে। এছাড়া রোজায় নিয়মিত বাজার মনিটরিং করা হবেÑ তাই ওই সময় পণ্য নিয়ে কারসাজির তেমন সুযোগ থাকবে না। এদিকে ভোগ্যপণ্যের বাজারে প্রতিকেজি ছোলার খুচরা দাম হচ্ছে ৮৫-১০০ টাকা। গত এক মাস পূর্বে বিক্রি হয়েছে ৭৮-৮৪ টাকায়। আর এক বছর পূর্বে ৫৫-৬০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। পণ্যটির আমদানি খরচ, আন্তর্জাতিক মূল্য এবং অভ্যন্তরীণ বাজার বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, পাইকারি থেকে খুচরা পর্যায়ের সব খরচ মিলিয়ে এ পণ্যটির সর্বোচ্চ বিক্রিমূল্য হওয়ার কথা ৫৪ টাকা। অর্থাৎ এই এক পণ্যেই প্রতি কেজিতে প্রায় ৩৫ টাকা অতিরিক্ত হাতিয়ে নিচ্ছে অসাধু ব্যবসায়ী চক্র। রমজানের আগেই নিত্যপ্রয়োজনীয় ছয় পণ্য থেকে অযৌক্তিক মুনাফা হাতিয়ে নিচ্ছে অসাধু ব্যবসায়ী ও মধ্যস্বত্বভোগীরা। এর মধ্যে প্রতিলিটার ভোজ্যতেলে ১৫ টাকা, মসুর ডালে ২৬ টাকা ও মটর ডালে ১৪ টাকা, চিনিতে ৬ টাকা এবং পেঁয়াজে ১২ টাকা করে অতিরিক্ত লাভ আদায় করা হচ্ছে বলে জানা গেছে। বাজার বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি অসাধু ব্যবসায়ী চক্রের কৌশল। কনজুমার্স এ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান মনে করেন, ব্যবসায়ীদের কারসাজির কারণে রমজান সামনে রেখে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাচ্ছে। সরকারের উচিত হবে মূল্য কারসাজির সঙ্গে জড়িত কিংবা অবৈধ মুনাফাকারী ওই সব ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে কঠোর শাস্তির মুখোমুখি করা। নতুবা দাম বৃদ্ধির এ প্রতিযোগিতায় নতুন নতুন কৌশল চলতেই থাকবে। পর্যাপ্ত মজুদ থাকার পরও দাম বাড়ছে ॥ রমজান সামনে রেখে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হবে ভোজ্যতেল, চিনি, মসুর ডাল, ছোলা, খেজুর এবং পেঁয়াজের। এসব পণ্যের পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে বর্তমানে ১৫ লাখ টন ভোজ্যতেলের চাহিদা রয়েছে। এর মধ্যে দেশীয় উৎপাদন প্রায় আড়াই লাখ টন। ফলে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে অপরিশোধিত এবং পরিশোধিত সয়াবিন ও পামওয়েল তেল আমদানি করে ঘাটতি পূরণ করতে হয়। এছাড়া রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্যমতে, গত ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ১৯ লাখ ১৯ হাজার টন ভোজ্যতেল আমদানি হয়েছে। চলতি ২০১৫-১৬ অর্থবছরের মার্চ পর্যন্ত ১৭ লাখ ১ হাজার টন ভোজ্যতেল দেশে আনা হয়েছে। এছাড়া খোলা সয়াবিন তেলের খুচরা মূল্য প্রতি লিটার ৭৯-৮৪ এবং বোতলজাত ৯০-৯৫ টাকা। খোলা পামওয়েলের দাম প্রতিলিটার ৬৬-৭০ টাকার মধ্যে রয়েছে। এছাড়া বর্তমানে দেশে প্রায় ১৪ থেকে ১৫ লাখ টন পরিশোধিত চিনির চাহিদা রয়েছে। চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে মার্চ পর্যন্ত ১২ লাখ ২১ হাজার টন চিনি এসেছে। আমদানিকৃত চিনির ওপর ট্যারিফ মূল্য ৩৫০ মার্কিন ডলার এবং প্রতিটনে আরোপিত ২ হাজার টাকা স্পেসিফিক শুল্কের সঙ্গে ২০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণমূলক কর আরোপ করায় চিনির মূল্য বৃদ্ধি পেয়ে খুচরা বাজারে প্রতি কেজি ৫৫-৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তবে এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মৌলভীবাজার পাইকারী ব্যবসায়ী সমিতির কোষাধ্যক্ষ হাজী মোহাম্মদ আলী ভুট্টো জনকণ্ঠকে বলেন, অভ্যন্তরীণ মার্কেটে চিনির বাজার বাড়তির দিকে রয়েছে। এছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারেও দাম বাড়ানোর পাঁয়তারা করছে সিন্ডিকেট চক্র। ফলে দেশে চিনির কোন ঘাটতি না থাকলেও বহির্বিশ্বে দাম বাড়লে দেশেও দাম বেড়ে যাবে। তবে খুচরা পর্যায়ে যে হারে দাম বাড়ছে তাতে সরকারী মনিটরিং জোরদার করতে হবে। এছাড়া অভ্যন্তরীণ মার্কেটে আস্ত ছোলার চাহিদা ৬০ হাজার টন। এর মধ্যে ৭ হাজার টন দেশে উৎপাদিত হয়ে থাকে। বাকিটা আমদানি করে চাহিদা মেটানো হয়। গত ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ডালসহ ছোলা ৩ লাখ ৫৫ হাজার টন দেশে আমদানি হয়েছে। চলতি অর্থবছরের জানুয়ারি পর্যন্ত ২ লাখ ৪৫ হাজার টন ডালসহ ছোলা আমদানি হয়েছে। এছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী ১ লাখ ৪ হাজার টন আস্ত ছোলার এলসি নিষ্পত্তি হয়েছে। বর্তমান খুচরা বাজারে প্রতি কেজি ছোলা ৮৫-১০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া দেশে প্রায় ২২ লাখ টন পেঁয়াজের চাহিদা রয়েছে। এনবিআরের তথ্যমতে, চলতি অর্থবছরের মার্চ পর্যন্ত ৪ লাখ ৯৮ হাজার টন পেঁয়াজ দেশে আমদানি হয়েছে। উৎপাদন, আমদানি প্রবাহের কারণে খুচরা বাজারে প্রতি কেজি পেঁয়াজ ২৫-৪৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া দেশে মসুর ডালের চাহিদা ৩ লাখ ৭৫ হাজার টন। কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী গত অর্থবছরে দেশীয় উৎপাদন প্রায় ২ লাখ ৬০ হাজার টন। এনবিআরের তথ্যমতে, গত অর্থবছর ১ লাখ ৯২ হাজার টন মসুর ডাল দেশে এসেছে। চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে মার্চ পর্যন্ত ১ লাখ ৩৬ হাজার টন মসুর ডাল দেশে আমদানি হয়েছে। বর্তমান প্রতি কেজি মসুর ডালের স্থানীয় বাজার মূল্য ১০০-১৫০ টাকা। এছাড়া দেশে প্রায় ১৫ হাজার টন খেজুরের চাহিদা রয়েছে। এর মধ্যে রমজানে চাহিদা প্রায় ১৩ হাজার টন। এনবিআরের তথ্যমতে, চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত ১৯ হাজার ৩শ’ টন খেজুর দেশে আমদানি হয়েছে। মানের ভিন্নতা থাকায় বর্তমানে প্রতি কেজি খেজুর ৮০-২২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। রমজানে পণ্য বিক্রি করবে টিসিবি ॥ রমজান উপলক্ষে সারাদেশের ১৭৪টি পয়েন্টে টিসিবি ট্রাক বসাবে। যেখানে চিনি, মসুর ডাল, ছোলা, সয়াবিন তেল ও খেজুর সরকার নির্ধারিত দামে বিক্রি হবে। রাজধানী ঢাকার ২৫টি পয়েন্টে, চট্টগ্রামের ১০টি, অন্য বিভাগীয় শহরে ৫টি করে ট্রাক বসবে। এছাড়া জেলা শহরে দুটি করে মোট ১৭৪টি স্থানে অস্থায়ীভাবে ট্রাক বসিয়ে স্থানীয় বাজারের তুলনায় কিছুটা কম দামে পাঁচটি পণ্য বিক্রি করা হবে বলে জানিয়েছেন টিসিবির জনসংযোগ কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির। রমজান উপলক্ষে পাঁচ শ’ মেট্রিক টন সয়াবিল তেল, ১ হাজার ৫শ’ মেট্রিক টন ছোলা খোলাবাজারে ছাড়া হবে।
×