ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

জাতীয় সংসদ ভবনের নক্সা

প্রকাশিত: ০৪:০০, ২১ মে ২০১৬

জাতীয় সংসদ ভবনের নক্সা

বাংলাদেশের মানুষের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতীক জাতীয় সংসদ। সংসদীয় গণতন্ত্রে সেটাই স্বাভাবিক। জাতীয় সংসদ ভবন স্থাপত্যশৈলীতেও অনন্য ও বিশ্বখ্যাত। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, দেশের গৌরবের স্থাপনা জাতীয় সংসদ ভবনের মূল নক্সা বার বার বিকৃত করা হয়েছে। এটি যে শুধু স্থাপত্যরীতির নান্দনিকতার লঙ্ঘন তা নয়, এটি অন্য অর্থে স্বেচ্ছাচারিতারও পরিচয়বাহী। গণতন্ত্রের সঙ্গে এই মানসিকতা নিঃসন্দেহে সাংঘর্ষিক। তাই এই ঐতিহাসিক ভবনটির সুরক্ষা যেমন জরুরী, তেমনি এই ভবনকে ঘিরে মূল নক্সা পরিপন্থী আরোপিত অগ্রহণযোগ্য স্থাপনাসমূহের অপসারণও বাঞ্ছিত। ১৯৬৪ সালের ৬ অক্টোবরে মার্কিন স্থপতি লুই কানের হাতে জাতীয় সংসদ ভবনের নির্মাণ কাজ শুরু হয়। লুই কান বঙ্গীয় বদ্বীপ, এর নদী, এর বিস্তৃত সবুজ, এর প্রসারিত সমভূমি, এর উঁচু ভিটায় তৈরি ঘরবাড়ি এবং এর ভূমি-জলে মেশানো ভূপ্রকৃতি থেকে সংসদ ভবনের নক্সার প্রেরণা খুঁজছিলেন। ঢাকায় আসার অল্প দিনের মধ্যেই তিনি বুড়িগঙ্গা নদীতে নৌকায় ঘুরে বেড়ান এবং এই মৌসুমী জলবায়ুর দেশের জীবন বুঝতে নদী তীরের দৃশ্যাবলীর রেখাচিত্র (স্কেচ) তৈরি করেন। গত শতকের পঞ্চাশ দশকে তার অধীত চিরায়ত গ্রীক-রোমান ও মিসরীয় স্থাপত্যকলার বিদ্যার সঙ্গে বাংলার স্থানীয় ছাপের মিশ্রণ ঘটাতে তার কোন অসুবিধাই হয়নি। শহীদ মিনার যেভাবে ১৯৫০-এর দশকের ভাষা আন্দোলনের চেতনার প্রতীক হয়ে উঠেছিল, সংসদ ভবন তেমনি ষাটের দশকের স্বাধীনতাকামী বাঙালীর মানসিকতার প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছিল। ১৯৭১-এর ২৫ মার্চের পর তড়িঘড়ি করে লুই কানের দফতর বন্ধ করা হলো এবং নির্মাণকাজও স্থগিত হয়ে গেল। সেখানে কেবল দাঁড়িয়ে ছিল একটি অর্ধসমাপ্ত রহস্যময় ভবন। তার পরও তা হয়েছিল বাঙালীদের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধের অদম্য প্রতীক। পরবর্তীকালে ’৮০-র দশকে ভবনের নির্মাণকাজ সমাপ্ত হলে দেখা গেল সেটি দেশটির অস্তিত্বের প্রতীক হয়ে উঠেছে। হাজার টাকার নোটের গায়ে, ডাকটিকেটে, রিক্সার অলঙ্করণে, বিজ্ঞাপনে, সরকারী পুস্তিকায় এবং কতভাবে তার ছবি ব্যবহৃত হতে থাকল! গোটা দুনিয়ার স্থাপত্যশিক্ষায় সংসদ ভবনের নক্সা কেবল অধ্যয়নই করা হয় না, এর ইতিহাস ও সংশ্লিষ্ট অনেক কিছু নিয়েই গবেষণা হয়। বাংলাদেশে নিশ্চয়ই আরও অনেক ঐতিহ্যমণ্ডিত ভবন আছে। কিন্তু বিশ্ব স্তরে এটাই হলো বাংলাদেশের সবচেয়ে পরিচয়সূচক বা প্রতিনিধিত্বশীল প্রতীকী ভবন। পঁচাত্তর-পরবর্তী বিভিন্ন সরকারের শাসনামলে নানা অজুহাতে নক্সাবহির্ভূতভাবে সংসদ ভবন এবং এর আশপাশ এলাকায় বিভিন্ন স্থাপনা গড়ে তোলা হয়। মূল নক্সায় জাতীয় সংসদ ভবন ও এর আশপাশের কোথাও কবরস্থানের জায়গা রাখা হয়নি। অথচ পঁচাত্তরÑ পরবর্তী সময় থেকে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমল পর্যন্ত সমাধিস্থল না হলেও বহুজনকে এ জায়গায় সমাধিস্থ করা হয়। বর্তমান সরকার জাতীয় সংসদের সৌন্দর্য রক্ষায় কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। আমাদের পরম সৌভাগ্য যে যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্কাইভে রক্ষিত স্থপতি লুই কানের করা জাতীয় সংসদ ভবনের ৮৫৩টি মূল নক্সা সম্প্রতি পাওয়া গেছে। এখন নক্সার বাইরের অবৈধ স্থাপনা সম্পর্কে নিঃসংশয় হওয়া সহজতর হবে। জাতি আশা করে সংসদ ভবনের মূল স্থাপত্য সৌন্দর্য অটুট রাখতে শীঘ্রই নক্সাগুলো দেশে আনা হবে এবং নক্সার বাইরের অবৈধ স্থাপনা সরানোর কাজ শুরু হবে।
×