ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

আক্তারুজ্জামান সিনবাদ

সৃষ্টির উজ্জ্বল স্রোতে

প্রকাশিত: ০৬:৪০, ২০ মে ২০১৬

সৃষ্টির উজ্জ্বল স্রোতে

প্রাগৈতিহাসিক যুগে মাতৃশক্তিকে আরাধনার জন্য শুরু হয়েছিল ভাস্কর্য সৃষ্টির প্রয়াস। যা কালানুক্রমিক ধারায় পরিপূর্ণতার সমুজ্জ্বল একটি রূপ লাভ করেছে। বাংলাদেশের ভাস্কর্যও মূলত দেব-দেবী কেন্দ্রীয় হয়ে ধ্রুপদী ও মন্ডনধর্মী আঙ্গিকে চলায়মান ছিল। মূলত ঊনবিংশ শতাব্দীতে ইংরেজ শাসনামলে এদেশে শিল্পচর্চার প্রসার ঘটলে বিধিবদ্ধ আরাধনা পর্যায় থেকে দেশীয় বিষয়বস্তু নিয়ে ইউরোপীয় কৌশল আয়ত্ত করে ভাস্কর্য সৃষ্টি শুরু হয়। কিন্তু পূর্ববঙ্গ অর্থাৎ বর্তমান বাংলাদেশ তখনও অনুমোদিত কোন প্রতিষ্ঠানিক শিল্প শিক্ষার ব্যবস্থা ছিল না। ধর্মীয় রক্ষণশীলতার কারণে মুসলমান চিত্রকর থাকলেও সে সময়ে ভাস্কর ছিল না। এই প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও ভাস্কর নভেরা আহমেদ বাংলাদেশে প্রথম আধুনিক আঙ্গিকে ভাস্কর্য চর্চা শুরু করেন। বাংলাদেশের শিল্পাকাশে নভেরা আহমেদ এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। তিনি বাংলাদেশের প্রথম আধুনিক ভাস্কর। দীর্ঘদিন এ দেশে সামাজিক, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং পাকিস্তানী মৌলবাদী ভাবাদর্শের কারণে ভাস্কর্য চর্চার অনুপস্থিতির পর ’৬০-এর দশকে আকস্মিকভাবেই নভেরার উত্থান ঘটে। এ দেশের শিল্পাঙ্গনে যা আজও অবিস্মরণীয় হয়ে আছে। তার ভাস্কর্য চর্চা এদেশের শিল্প, শিল্পরসিক ও জনসাধারণের দৃষ্টি আকর্ষণ ও অনুপ্রেরণার খোরাক যোগায়। নভেরা আহমেদ ও তার শিল্প একই সূত্রে বাঁধা। তাই ব্যক্তিক নভেরাকে তাঁর শিল্প থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখবার পরিসর নেই। নভেরার জীবন, শিক্ষা, শিল্পচৈতন্য এবং মূল্যবোধ গড়ার ক্ষেত্রে বিদেশের শিল্প ও শৈল্পিক দৃষ্টিভঙ্গি ব্যাপকভাবে প্রভাব ফেলেছিল। অন্তঃপুরের অন্ধকারাচ্ছন্ন গৃহকোণ ছেড়ে সামাজিক কুসংস্কার, ধর্মীয় গোড়ামী উপেক্ষা করে বুকে সাহস নিয়ে এই প্রতিকূল অবস্থাকে সামনে রেখেই ভাস্কর নভেরা বাংলাদেশে প্রথম আধুনিক আঙ্গিকে ভাস্কর্য চর্চায় এগিয়ে আসেন। চিরায়ত সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির কাঠামো ভেঙ্গে বের হয়ে এসে জীবন ও জগতকে নতুন করে দেখার আগ্রহ সৃষ্টি তাঁর কর্মক্ষেত্রে অংশগ্রহণকে ভিন্নমাত্রা দিয়েছে। ফলে বাঙালীর বাস্তব জীবনযাত্রা ও ঐতিহ্যবোধের সঙ্গে মেশান পাশ্চাত্যের কলা-নৈপুণ্যের ছোঁয়া। সুনিপুণ দক্ষতার সঙ্গে যোগ করেন নতুন এক মাত্রা। ভাবনায়, চিন্তায়, বিষয়বস্তু চয়নে এবং উদ্ভাবনায় সৃষ্টি করেন ভাস্কর্য কলার নবযুগ, ঐতিহ্য অন্বেষা ও বিশ্ববীক্ষার নতুন প্রকরণ ও শৈলী নির্মাণ করেন। তাঁর শিল্পকর্মে আছে অসাধারণত্বের ছাপ। বিষয় হিসেবে নভেরার কাজে গ্রামীণ জীবনের উপস্থাপনা বিশেষভাবে লক্ষ্য করা যায়। বিশেষ করে তাঁর কাজের বিষয়বস্তু হলো, গরু ও রাখাল, মা, শিশু, পরিবার ইত্যাদি। ইউরোপের আধুনিক ভাবধারার সঙ্গে তাঁর যে পরিচয় ঘটেছিল তারই সঙ্গে তিনি দেশজ বিষয়, উপকরণ ও টেকনিকের সংমিশ্রণ ঘটিয়েছেন। তাই তিনি স্বভাবতই লোহার রডের আর্মেচার তৈরি করে তার ওপর সিমেন্টের মিশ্রণ ব্যবহার করে ভাস্কর্য নির্মাণ করতেন। যা তাঁর কাজের নিজস্বতা। একই সঙ্গে সমকালীন ইউরোপীয় ভাইটালিস্ট ধারায় গড়নের সরলীকরণ অভ্যন্তরে গর্ত সৃষ্টি করে এবং এদেশের লোকজ পুতুলের সাদৃশ্য আকার নিয়ে ভাস্কর্যগুলো নির্মাণ করা। তাঁর এই ভাস্কর্যগুলো বিশ্বজনীন ও স্থানীয় শিল্পভাষার স্বাধীন সমন্বয়ের একটি বলিষ্ঠ উদাহরণ। যা তাঁর কাজের নিজস্ব স্টাইল হিসেবে বিবেচিত। নভেরার কাজের প্রধান দিক হলো নারীদের প্রতিমূর্তি। তাঁর সমসাময়িক অধিকাংশ পুরুষ শিল্পী ইউরোপীয় ইন্দ্রিয় সুখাবহ নারীদের একটা রোমান্টিক ইমেজ দেয়ার চেষ্টা করেছিলেন। গ্রামের দৃশ্যে জলসিক্ত কাপড়ে স্নানরতা রমণী, আয়না দেখে কেশবিন্যাস বা প্রসাধন যৌবনোচ্ছল নারী ইত্যাদি তাদের বিষয় হিসেবে এসেছে। যেখানে নারীদের যথার্থ কর্মময় অবস্থান উহ্য রাখা হয়েছে। পক্ষান্তরে নভেরার নারীরা, পুরুষ শিল্পীদের দেখার চাইতে ভিন্ন রূপে আসে। তাঁর কাজে নর ও নারী একটি ঐক্য গঠন করে তৈরি করে কম্পোজিশনের নকশা। তিনি ভাসা ভাসা সুন্দর, আনন্দদায়ী ফর্ম তৈরি করতে চাননি। তিনি তাঁর ফর্মগুলোকে সরল অর্থপূর্ণ স্বকীয়তায় সমৃদ্ধ করতে চেয়েছেন। তিনি উৎসাহী ছিলেন বাস্তবতার নিরিখে কিছু নির্দিষ্ট আদর্শকে তুলে ধরতে। তিনি উন্মোচন করেন সব ধরনের বিচলিত, আবেগায়িত, সত্যিকার নারীর রূপকে। যা শক্তিদায়ী, সংকল্পবদ্ধ, অকপট, যৌন আকর্ষক রূপে উদ্ভাসিত হয়। তাঁর মায়েরা সুন্দরী নয়, শক্তিময়ী, জোড়ালো এবং সংগ্রামী। এরই এক শ্রেষ্ঠ নিদর্শন হলো ‘দ্য লং ওয়েট’ ভাস্কর্যটি। যেখানে নারী মানবিকতার প্রতীক। ভাস্কর্যের বহিঃরেখা সরলতর এবং কৌণিকতা ও রৈখিকতা কমে গোলাকৃতি প্রধান, অধিকতর প্রকাশধর্মী। বহিরাঙ্গনের তীব্র আলো-ছায়ার বৈপরীত্য নিয়ে চিন্তা নেই। পাশ্চাত্যের ধারার অনুসরণ গৌণ। তাঁর শিল্পকর্মের অপর নিয়ামক ছিল আধুনিক ইউরোপীয় ভাস্কর্যের সম্পর্কে সম্যক ধারণা। তাঁর অধিকাংশ কাজের উপকরণ সিমেন্ট এবং মার্বেলের গুঁড়া। এ ছাড়াও পোড়ামাটি, প্লাস্টার এবং কাঠের তিনি কাজ করেন। এর ফলে তিনি তাঁর পূর্ববর্তী বাস্তবানুগ স্বাভাবিকতার ধারা ত্যাগ করে সরলতার দিকে অগ্রসর হন। নভেরার অধিকাংশ কাজ অনমনীয় লোহার রডের কাঠামোর ওপরে সরাসরি সিমেন্টে সম্পন্ন। যেহেতু তাঁর কাজ লোহার রডের কাঠামো অনুসরণে নির্মিত হয়, সেহেতু তাঁর কাজে কৌণিক ও রৈখিক বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। নভেরার নিরাবলম্ব ভাস্কর্যেও টেপা পদ্ধতিতে নির্মিত পোড়ামাটির মূর্তির সরলীকরণ আত্মীভূত হয়। যেমন দেখা যায় এক সময় গ্রন্থাগারের প্রাঙ্গণে অবস্থিত পরিবার বিষয়ক ভাস্কর্যসমূহে। এই ভাস্কর্যগুলো বর্তমানে জাতীয় জাদুঘরের সংগ্রহে। তাঁর সিমেন্ট ভাস্কর্যে তিনি প্রায়ই সিমেন্টের সঙ্গেই গুঁড়া রং ব্যবহার করেছেন গড়নের তলে রং যোগ করতে। তাঁর কাজে বাংলাদেশের গ্রামীণ জীবনের কিছুটা রোমান্টিক উপস্থাপনা লক্ষ্যণীয়। স্থানীয় মাধ্যম, স্থানীয় বিষয়বস্তু, চরিত্র, পরিবেশ এবং এর সঙ্গে আত্মিক যোগসূত্র সমন্বয়ে শিল্প সৃষ্টি করেছেন নভেরা। যার ফলে তাঁর কিছু কিছু কাজে এদেশের কাদামাটির মর্ম মূলটি উঠে এসেছে। ‘শিশুসহ মা’ ভাস্কর্যটিতে চোখের দৃষ্টিতে সরলতার অভিব্যক্তি, মাতৃহৃদয়ের স্নেহের আচ্ছাদনে ঢাকা শিশু দুটি। ফর্ম নির্ভর ঘোমটা মাথায় গাঁয়ের বধূর ভাস্কর্য গড়েছেন অসামান্য দক্ষতায়। নভেরার কাজের কলাকৌশলে ও ব্যাকরণে পাশ্চাত্যের প্রভাব ও রসাশ্রয়ী মনোভাব সুস্পষ্ট। যা অনেক ক্ষেত্রে তাঁর শিল্পের দ্বৈত সংঘাতকে উত্তরণ করে প্রকট প্রকাশ ঘটিয়েছে। বিশেষ করে তাঁর রচিত নারী-পুরুষ, শিশুসহ দম্পতি সিরিজে এবং রিক্লাইন ফিগারে। এই আঙ্গিকে শিল্পকর্মগুলো থ্রি-ডাইমেনশনাল, ভরাট এবং ফিগার বিন্যাসে আগে পিছে, ছোট-বড় করে স্পেস তৈরি করা হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য উভয়ের সংমিশ্রণে নিরীক্ষা করেছেন শিল্পে। আধুনিক ভাস্কর্যের প্রবাদ পুরুষ হেনরি মুরের কাজের উল্লেখযোগ্য প্রভাব পরিলক্ষিত হয় নভেরার কাজে। রদ্যার শিল্পকর্মও প্রভাব ফেলেছে। বিষয় হিসেবে এক্ষেত্রে তিনি বেছে নিয়েছেন চিরায়ত বাংলার মানুষ এবং প্রকৃতিকে। সংমিশ্রণটা এখানেই। কর্মনির্ভর স্বামী-স্ত্রী তাদের সন্তান এবং গাভী বিষয় হিসেবে এসেছে ‘দম্পতি’ শিরোনামের কাজে। ভাস্কর্যটি আমাদের চিরচেনা একটি রূপ। স্বামী-স্ত্রী সঙ্গে মঙ্গলার্থে মাতৃসম অবদানে গাভীর উপস্থাপন যা ফর্মের সরলীকরণে তুলে ধরা হয়েছে। আবেগ বক্তব্যকে মাথায় রেখে কাঠামোগুলোতে দেয়া হয়েছে মসৃণ ছন্দ। সার্বিকভাবে চারটি ফর্মের বিন্যাসে পাওয়া যায় শান্ত-সুখী পরিবারের ছায়া। এখানে দম্পতিকে ধরিত্রীর প্রতিনিধি হিসেবে উপস্থাপন করেছেন তিনি। ফর্ম সংগঠনে রয়েছে অসাধারণ রিদমের উপস্থিতি। শিল্পকর্মের মাঝে হেনরি মুরের মতো গোলাকার গর্তের বিন্যাস ঘটিয়েছেন, যা শিল্পকর্মকে প্রকৃতিতে প্রসারিত করেছে। এই শ্রেণীভুক্ত শিল্পকর্মগুলোতে যেমন ছন্দ পাওয়া যায়, তেমনি ফিগার স্থাপনের কৌতূহলে বৈচিত্র্যের স্বাদও পাওয়া যায়। এই ধরনের আরেকটি কাজ ‘কাউ এ্যান্ড টু ফিগার’ জাতীয় জাদুঘরের সামনের লনে অবস্থিত। গ্রামীণ জীবনের একটি বিষয় ফুটিয়ে তোলা হয়েছে ভাস্কর্যটিতে। ভাস্কর্যটির মাধ্যমে নভেরা দেখিয়েছেন রাখাল ও গরুর ওপর নির্ভরশীল মানুষ। ভাস্কর্যটির কিছু কিছু অংশ বৃত্তাকারে কেটে বাদ দেয়া হয়েছে। নভেরা আহমেদের বেশ কিছু কাজে আবহমান বাংলার ঐতিহ্য আশ্রিত লোকজ আঙ্গিকের প্রভাব প্রতীয়মান হয়। তিনি কৌণিক আঙ্গিকে মুখের তিনকোন আদল, চোখ গোলাকার ছিদ্র এবং গ্রীবা লম্বা করেছেন। রিলিফ আঙ্গিকের কাজে লৌকিক আঙ্গিকে কালো ড্রয়িং করেছেন। বাংলার কন্যা পুতুলের আভাস তাঁর এসব কাজে পরিলক্ষিত হয়। নগ্নিকা নারী মূর্তি, লম্বা গ্রীবা, মস্তকের এনাটমি এখানে আভাসে ছেড়েছেন। তাঁর কাজে পরিলক্ষিত হয় স্থাপত্য শিল্পের স্পেস তৈরির প্রবণতা এবং বারোকের আলো-আঁধারির প্রভাব। ভাস্কর্য আঙ্গিকে ‘পিস’ শিল্পকর্মটি বিশ্লেষণ করলে স্থাপত্যের আঙ্গিকে সৌন্দর্য এবং ভাস্কর্যের আঙ্গিকে সৌন্দর্য উভয়কে অভিন্ন রূপে দেখা যায়। এটা কাঠামোগত বিমূর্ত শিল্প। স্থাপত্য হতে রসাশ্রয়িতে ভাস্কর্যে রূপায়িত হয়েছে। এই শিল্পকর্মটি স্থাপত্য এবং ভাস্কর্য আঙ্গিকের সংমিশ্রণে একটি সার্থক শিল্পকর্ম। জাতীয় শহীদ মিনারের নকশা এবং ভাস্কর্য তৈরিতে তাঁর জোড়ালো অবদান তাঁর সামাজিক দায়িত্ব বোধেরই নিদর্শন। ভাস্কর্য শিল্পে অনন্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ভাস্কর নভেরা আহমেদকে ১৯৯৭ সালে ২১ পদক প্রদান করেন। নভেরা আহমেদের ভাস্কর্য নিয়ে শুরু হয় এদেশের আধুনিক ভাস্কর্য চর্চা। দেশের প্রতি মমত্ববোধ ও পাশ্চাত্য করণকৌশল দেশীয় উপকরণের সমন্বয়ে নভেরা নিজস্বতার দিকে এগিয়ে যান। গভীর চিন্তাধারা তাঁকে নতুন কিছু সৃষ্টিতে প্রেরণা যুগিয়েছে সব সময়। সম্পূর্ণ নিজস্ব চিন্তাধারা এবং ভাবধারায় তৈরি করেছেন শিল্পকর্ম। হয়ত তা জনসাধারণের বোধগম্যের মধ্যে ছিল না। তবুও এই নিগূঢ় বোধকে পৌঁছে দিতে চেয়েছেন সবার কাছে। তাঁর কাজ বর্তমান শিল্পবোদ্ধা, শিল্পামোদিসহ ভবিষ্যত প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করবে। তখন হয়ত জাতি বলবে তাঁর শিল্প-সংগ্রাম সার্থক হয়েছে। শিল্পের সদা প্রজ্বলিত শিখায় নভেরা আমাদের মানসপটে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
×