ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

সাদিক ইসলাম

অসহায়ের নজরুল

প্রকাশিত: ০৬:৩৫, ২০ মে ২০১৬

অসহায়ের নজরুল

বাংলা সাহিত্যের অবিস্মরণীয় প্রতিভা কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬) বাংলাদেশের জাতীয় কবি। রবীন্দ্রনাথ তার পাঠকদের পুরোপুরি আচ্ছন্ন করে রেখেছিলেন তার জাদুকরী বহুমুখী সাহিত্যে রস আস্বাদনে। যখন রবির কিরণে পুরো বাংলা সাহিত্য আলোকিত নজরুল উদিত হলেন এক প্রবল আলোড়ন নিয়ে। রবীন্দ্রনাথের সুউচ্চ সুকুমার সৌকর্য বাংলা সাহিত্যকে যে সময় বিশ্বসাহিত্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ মর্যাদায় আসীন করে নজরুল তার তেজোদীপ্ত চেতনায় বাংলা সাহিত্যে নিয়ে আসেন নব জোয়ার। রবীন্দ্র মননে-মানসে বাঙালীর সূক্ষ্মতর ভাবাবেগকে শিল্পের ব্যঞ্জনায় অদ্বিতীয় স্থানে নিয়ে যান আর নজরুল ঘুণে ধরা মানবিকতায় ঢেলে দেন প্রাণের নির্যাস। তার সমকালীন ব্রিটিশ-শাসিত মূল্যবোধ যা পুঁজিবাদের নব্য ধারণা নিয়ে নখর বসাতে উদত্ত সাম্যের বাংলায় তখন নজরুলের রোমান্টিক সত্তা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে প্রবল আবেদনের কাব্য আন্দোলনে। রবীন্দ্রনাথ হৃদয় উন্মেষের কবি আর নজরুল চেতনা জাগরণের পুরোধা কবি। নিপীড়িত, অত্যাচারিত, কুলি, ভিখারি, কৃষক, মুটে, মজুর ও অসহায় মানুষের সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং মানবিক বিপর্যয়ে ব্যথিত-মথিত নজরুল মন অকুতোভয় কাব্য-বাণী নিয়ে একাই কাঁপিয়ে দেন নিপীড়কদের দোর্দ- প্রতাপকে। তার জাগরণের কবিতা, বিপ্লবী গান, বলিষ্ঠ প্রবন্ধ, গল্প, উপন্যাস মানুষের লুপ্ত-প্রায় অধিকার আর লুণ্ঠিত-প্রায় চেতনাকে জাগিয়ে দিয়ে সমতা, ন্যায্যতা, প্রাপ্যতা, বঞ্চনার বিরুদ্ধে শক্ত হাতিয়ার হিসেবে সাহিত্য জগতে এক নতুন বিপ্লবী ধারার সূচনা করে। বাংলা সাহিত্যে নিপীড়িত, অসহায় ও বঞ্চিতদের নিয়ে এত ধারালো ও জীবন ঘনিষ্ঠ লেখা বিরল। পশ্চিমা লেখক ওয়াল্ট হুয়িটম্যান, পি.বি. শেলী, উইলিয়াম ব্লেক, উইলিয়াম এডওয়ার্ড হয়ত সামাজিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে লেখনীর সূত্রপাত করে গেছেন কিন্তু নজরুলের মতো এত জীবনমুখী ও বিপ্লবী চেতনায় বলিষ্ঠ হতে পারেননি কেউই। তাই এটি নিঃসঙ্কোচে বলা যায় মেহনতী, নির্যাতিতদের মুখপাত্র হিসেবে কোন কবিকে যদি এক নামে বলতে হয় তিনি নজরুল। তার বিখ্যাত কবিতা বিদ্রোহী ছাড়াও ‘ধূমকেতু’, ‘পাপ’, ‘বীরাঙ্গনা’, ‘সর্বহারা’, ‘সাম্যবাদী’, ‘মানুষ’, ‘নারী’, ‘কুলি-মজুর’, ‘আমার কৈফিয়ত’, ‘দারিদ্র্য’, ‘কামাল পাশা’, ‘কীষাণের গান’, ‘ধীবরের গান’ ইত্যাদি বাংলা সাহিত্যে নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে। একজন অ-রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হয়েও তিনি কবি পরিচয়ে রাজনৈতিক, সামাজিক, মানবিক মূল্যবোধের শেকড়ে নাড়া দিয়ে গেছেন প্রবলভাবে। ‘দারিদ্র্য’ কবিতাটির কথা আলাদাভাবে বলতে হয় এর শুধু যদি প্রথম বহুল-চর্চিত স্তবকটিই আমরা গণ্য করি তবে নজরুলের সাহিত্য দর্শনের যে ভিত্তিরূপ তা আমাদের কাছে অনেকটা পরিষ্কার হবে। চরম দরিদ্রতার সঙ্গে যুদ্ধই তাকে মহানের আসনে বসিয়েছে। আর্থিক সমস্যায় নজরুল পড়ালেখা করতে পারেননি, কবি দলে কাজ করেছেন, হোটেলে রুটি বানিয়েছেন, ব্যক্তিগত সমস্যা, দারিদ্র্যের সঙ্গে যুদ্ধ করে চলা নজরুল পরাভব তো মানেননি বরং এটি তাকে শক্তিশালী করে ইস্পাত-সম মনোবল দিয়েছে। চরম সঙ্কট আর অভাব তাকে মহিয়ান করেছে। ঐশ্বর্য মানুষকে গ-িবদ্ধ করে কিন্তু অসহায় অবস্থা মানুষকে দেয় সহায় হবার তীব্র তাড়না। তাই নিষ্পেষিতের জন্যে তার কবিতার বাণী হলো এত ‘উদ্ধত-উলঙ্গ’ আর ‘ক্ষুরধার’ আর তার গানগুলো হলো ‘তরবার’। এ সবই শুধু অসহায়ের জন্যে নিবেদিত হলো, তার সাহিত্যের ভাষাকে করে তুলল প্রতিবাদী, বিপ্লবী আর বপন করল সমাজ সংস্কারের বীজ ও দিল মুক্তির প্রেরণা। তার গান যেমনÑ ‘কারার ঐ লৌহ কপাট ভেঙ্গে ফেল কররে লোপাট’ কিংবা ‘মোদের এই শিকল পরা ছল’ আবার তার আগুন ঝরানো গান ‘দুর্গম গিরি কান্তার মরু দুস্তর পারাবার হে/লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি নিশীথে যাত্রীরা হুঁশিয়ার’ এই উদ্দীপক গানগুলো শুধু আমাদের মহান স্বাধীনতা আন্দোলনে যুগান্তকারী ভূমিকা রাখেনি, যে কোন যুগে যে কোন দেশে এই গান প্রেরণা যোগাবে নিপীড়িতদের ন্যায্য দাবি আদায়ে। কবি নজরুল যে কত বড় মাপের সমাজ-সংস্কারক ছিলেন তা বোঝা যায় তার উদ্দীপনামূলক কবিতাগুলোতে; এগুলো ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে মানুষের মাঝে আন্দোলনের স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে দেয়। ‘অগ্নিবীণা’ কাব্যগ্রন্থ বাংলা সাহিত্যে নতুন ধারা এনেছিল নিষ্প্রাণ কাব্য জগত যেন প্রাণময়, সঞ্জীবনী সুধা পান করিয়েছিল হাজার পাঠক, কবি আর নিদ্রিত হৃদয়কে। শান্ত-সৌম্য বাংলা কাব্য রীতিতে এ রকম ঝড় কেউ তুলতে পারেনি, যখন নজরুল বলেন : ‘তোরা সব জয়ধ্বনি কর তোরা সব জয়ধ্বনি কর ওই নূতনের কেতন ওড়ে কালবোশেখী ঝড়।’ অন্যায় ক্ষমতার বিরুদ্ধে নির্ভীক নজরুল একাই ব্রতী হন তার ‘ধূমকেতু’ ও ‘লাঙল’-এর মতো নবযুগ সৃষ্টিকারী পত্রিকাগুলো অকুতোভয়ে শিল্পিত-আন্দোলন গড়ে তোলে। ‘ধূমকেতু’ পত্রিকাটি বিপ্লবীদের মুখপত্র এটিতেই নজরুলের অনলবর্ষী ‘ধূমকেতু’ কবিতাটি প্রকাশিত হয়। ‘লাঙল’ মাটি ও মানুষের কথা বলে এর পাশাপাশি ধনিক শ্রেণীর কব্জা থেকে গরিবদের অর্থনৈতিক মুক্তির পথ দেখায়। ‘লাঙল’ পত্রিকায় নজরুল ধনিক শ্রেণীর জন্য করণীয় বেঁধে দেন। গরিবের ক্ষুধা আর অশিক্ষার বিরুদ্ধেও অবস্থান নেয় ‘লাঙল’ শুধু তাই নয় গরিব, কৃষক, শ্রমিকদের দাবি আদায়ের স্বার্থে বেঁধে দেয় এর মেনিফেস্টো। এর সঙ্গে শরৎ চন্দ্রের ‘পথের দাবি’র কিছু মিল খুঁজে পাওয়া যায়। এভাবে সাহিত্যিক হিসেবে রাজনীতিতে সাম্যবাদের সূচনা নজরুলই করেন। আবার ঔপনিবেশিক শাসন যা নিরন্ন, বাস্তুহীনদের শেষ রক্ত বিন্দু শুষে নিয়ে সমাজে ধনীদের শক্ত আসন আরও পাকাপোক্ত করার কুচক্রে লিপ্ত ছিল তার বিরুদ্ধে সাহসী নজরুল শুরু করেন একাকী লড়াই। এর জন্য নজরুলকে অনেক খেসারত দিতে হয়েছে, তার কবিতা বাজেয়াফত হয়েছে, তাকে জেলে যেতে হয়েছে কিন্তু নজরুল দমে যাননি, মহা-বিদ্রোহী এই কবি নিরন্তরভাবে অজস্র জ্বালাময়ী কবিতায় বলে গেছেন স্বাধীনতার কথা, বন্ধনহীনতার কথা : ‘আজাদ মানুষ বন্দী ক’রে অধীন করে স্বাধীন দেশ কুল মুলুকের কুষ্টি ক’রে জোর দেখালে ক’দিন বেশ পরের মুলুক লুট করে খায় ডাকাত তারা ডাকাত তাই তাদের তরে বরাদ্দ ভাই আঘাত শুধু আঘাত।’ অপশক্তির হাত থেকে দেশ স্বাধীন না হলে নিষ্পেষিত মানুষ মুক্তি পাবে না তাই ‘কামাল পাশার’ মতো অনবদ্য কবিতায় সৈনিক কবি পরাধীনতার শেকল ভাঙতে চান। নিপীড়িত, জীবন্ত-মৃত মানুষের জন্য ব্যথিত হৃদয় কবি তার কাঠিন্যের আড়ালে যে রোমান্টিক কোমলতা আছে তাও তুলে ধরেন ‘কুলি মজুর’ কবিতায়। দুর্বলরা কবির কাব্য-চেতনার কেন্দ্রে, এই কবিতাটি তারই প্রমাণ : ‘দেখিনু সেদিন রেলে কুলি বলে এক বাবু সাব তারে ঠেলে দিলো নিচে ফেলে চোখ ফেটে এলো জল, এমনি করে কি জগত জুড়িয়া মার খাবে দুর্বল? কিন্তু অন্যায়ের প্রতি সোচ্চার কবি এই কবিতায় তার আপোসহীনতাও প্রকাশ করেন জোড়ালে ভাষায় ‘আসিতেছে শুভদিন/দিনে দিনে বহু বাড়িয়াছে দেনা শুধিতে হইবে ঋণ!’ লাঞ্ছিত-বঞ্চিতের কবি ভাল করেই জানেন গরিবরা জীবনভর নিরন্তর মার খেয়ে যাবে না : ‘তুমি শুয়ে রবে তেতলার’ পরে, আমরা রহিব নিচে, অথচ তোমারে দেবতা বলিব, সে ভরসা আজ মিছে!’ যুগ-যন্ত্রণায় বিদ্ধ কবি; কিন্তু কবি হতাশ নন বরং জানেন শক্তিশালীদের মিথ্যা গরিমা তাদের উচ্চাসনে বসায় না তাদের ভেতরের কদর্য চেহারাই তুলে ধরে, তাই তারা দেবতা বা সম্মানের কোন স্থান পেতে পারে না। ‘মানুষ’ কবিতায় কবি মানুষে মানুষে যে দেয়াল তা ভেঙ্গে দেন। একই স্রষ্টার সৃষ্টি মানুষ একই সমাজে স্তরায়িত হতে পারে না। কালো, সাদা, জাত, বেজাতকে লালন যেমন সমান অধিকারে চিহ্নিত করেন নজরুলও তাই : ‘গাহি সাম্যের গান- মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান! নাই দেশ-কাল পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্মজাতি সব দেশে সবকালে ঘরে-ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি।’ তাই সকল মানুষকে যদি একই নিক্তিতে মাপা যায় তবে মানুষের মাঝে যে বিভিন্ন ভাগ তা আর থাকবে না; নজরুলের সম-চেতনার এ এক অনুপম অনুভব। তার লেখা ‘আমার কৈফিয়ত’ কবিতা যদিও নজরুল তার সমালোচকদের উদ্দেশ্য করে লিখেছিলেন সেখানেও অসহায়ের জন্য আর্তনাদ উচ্চারিত হয়। আসলে নজরুলকে অমরা দেখি দেশ-কাল-পাত্র সবার উপরে ওঠে সারা বিশ্বের সব নিপীড়িতের জন্য আর্তনাদ করতে; তাই তার সব কবিতাতেই শ্রেণী-সচেতনতা যেমন ঘুরে ফিরে আসে তেমনি সম্বলহীনের জন্য ঐকান্তিক দরদ বাদ যায় না কোন খানেই। তাই তার ‘আমার কৈফিয়ত’ কবিতাতেও অবচেতন মনে তিনি আঁকেন নিরন্ন শিশুর দুঃখ গাথা : ‘ক্ষুধাতুর শিশু চায় না স্বরাজ, চায় দুটো ভাত একটু নুন বেলা বয়ে যায়, খায়নি ক’ বাছা, কচি পেটে তার জ্বলে আগুন।’ কিন্তু এখনও আমরা মর্মান্তিকচিত্র দেখি শুধু বাংলাদেশে নয় পৃথিবীজুড়ে শত কোটি মানুষ না খেয়ে ঘুমাতে যায় আবার অন্যদিকে ইউরোপে, আমেরিকায় অনেক ধনী রাষ্ট্র উদ্বৃত্ত খাবার সাগরে ফেলে দেয় বা ডাম্পিং করে; গম, চাল, যব দিয়ে বায়োগ্যাস বানিয়ে বিলাসবহুল গাড়িতে করে চড়ে বেড়ায়। ২০০ কিলোমিটার পথ চলতে একটা বায়োগ্যাস গাড়ির যে পরিমাণ শস্য নষ্ট করতে হয় তা দিয়ে তৃতীয় বিশ্বের একটি পরিবারের সারা বছরের খাদ্য সংস্থান হয়ে যায়। এই পৃথিবীতে যেমন একদিকে আছে চরম ঐশ্বর্য আরেকদিকে বিদ্যমান চরম অভাব কিন্তু তা দেখবার জন্য যেন কেউ নেই। তাই বলা চলে নজরুল মানব বঞ্চনার যে কঠিন বাস্তবটাকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে গেছে সেদিকে অপরিণামদর্শী আর স্বার্থপর মানুষের চোখ এখনও পড়েনি তাই মানুষে মানুষে বিভেদ আরও চরম আকার ধারণ করেছে। অন্যদিকে ‘সর্বহারা’ কাব্যে-গ্রন্থের ‘ফরিয়াদ’ কবিতায় কবি এই বিশ্ব জগতে ভাগাভাগি, শোষণ, দুর্বলের ওপর প্রবলের যে আঘাত, বিভিন্ন ধাপের অবতারণা তাতে দারুণ বিচলিত কবি; এখানেও গরিবের প্রতি তার পক্ষপাত আবারও পরিলক্ষিত। স্রষ্টা পৃথিবী সৃষ্টি করেছে কিন্তু মানুষ যুক্তিহীন উপায়ে এর ফুল, ফসল, জমিজমা নিয়ন্ত্রণ করে কেউ মালিক সেজে বসে আছে; আবার কেউ থেকে গেছে সম্বলহীন প্রজা হয়ে। জমির মালিক বসে থেকে যারা জমি চাষ করে তাদের রক্ত-পানি করা শ্রম দিয়ে ফুলে-ফেঁপে গরিবদের শোষণের জন্য আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। নজরুলের নিন্দা তাই আবারও প্লাবিত হয় যন্ত্রণা-ক্লিষ্ট মন নিয়ে : ‘জনগণে যারা জোঁক সম শোষে তারা মহাজন কয়, সন্তান সম পালে যারা জমি, তারা জমিদার নয়।’ কিন্তু নজরুলের যে যুক্তিপূর্ণ বাসনা ‘তোমার দেয়া এ বিপুল পৃথ¦ী সকলে করিব ভোগ’ তা থেকে যায় অতৃপ্তই। কবি কিন্তু বরাবরের মতোই নিরাশ নন। বেদনায় ক্ষত-বিক্ষত হতে পারেন কিন্তু মুক্তির স্বাদ যে আসবে তাতেও আশাবাদী কবি : ‘চির অবনত তুলিয়াছে আজ গগনে উচ্চ শির। বান্দা আজিকে বন্ধন ছেদি’ ভেঙেছে কারা-প্রাচীর’ ‘মৃত্যু ক্ষুধা’ উপন্যাসে সেজ- বৌ এর যে করুণ অবস্থা নজরুল তুলে ধরেছেন তা এক কথায় অবর্ণনীয় : ‘সেজ-বৌ সপ্তাহখানিক হলো টাইফয়েড থেকে কোন রকম বেঁচে উঠেছে কিন্তু ওই বেঁচে উঠেছে মাত্র। বেঁচে থাকার চিহ্ন শ্বাস-প্রশ্বাসটুকু ছাড়া আর কিছু নেই। দেহের যেটুকু অবশিষ্ট আছে, তা কবরে দেয়া ছাড়া আর কোন কাজে লাগবে না। যেন কুমির চিবিয়ে দিয়ে আবার উগড়ে দিয়ে গেছে। কসাই যেমন করে মাংস থেঁতলায় রোগ, শোক, দুঃখ, দারিদ্র্যÑ এই চারটিতে মিলে তেমনি করে যেন থেঁতলেছে ওকে।’ অসহায়ের জন্য নজরুলের এই আর্তনাদ তার গরিব-বান্ধব দর্শন প্রকাশ করে। ‘চোর-ডাকাত’ কবিতায় নজরুল ধনীরা যে ধনিক-বৃত্তি বা চৌর্যবৃত্তি করে সেই দিকে আঙ্গুল তুলেছেন। তারা যে গরিবদের নিঃষেশিত করে এবং প্রতাপশালীরাই যে বিশ্বে মর্যাদার আসনে আসীন তাও তিনি তুলে ধরেন এই কবিতায়। এই কবিতাটি পুঁজিবাদী ও কর্পোরেট এই আধুনিক যুগের সঙ্গেও মিলে যায় : ‘অন্ন, স্বাস্থ্য, প্রাণ আশা ভাষা হারায়ে সকল কিছু দেউলিয়া হয়ে চলেছে মানুষ ধ্বংসের পিছু পিছু। পালাবার পথ নাই। দিকে দিকে আজ অর্থ-পিশাচ খুঁড়িয়াছে গড়খাই।’ ‘সাম্যবাদী’ কাব্যের ‘রাজা-প্রজা’ কবিতায় কবি মানুষে মানুষে যুক্তিহীন ব্যবধানকে চমৎকারভাবে কিন্তু গভীর তাৎপর্যের সঙ্গে অঙ্কিত করেছেন। তার যুক্তিসঙ্গত দর্শন রাজাকে প্রজারা তৈরি করে কিন্তু প্রজারা থেকে যায় অন্তরালে আর রাজাদের হয় জয়জয়কার; এখানে রাজা প্রতীকী অর্থে শোষক সমাজের প্রতিনিধিত্ব করে : ‘নিহত আহত বীরের মাড়ায়ে ছুটেছে রাজার রথ, যুদ্ধ-ফেরত খঞ্জ পঙ্গু পালা পালা ছাড় পথ! বন্ধু এমনি হয় জনগণ হ’ল যুদ্ধে বিজয়ী, রাজার গাহিল জয়।’ এই কবিতায় গণতন্ত্রের নামে স্বৈরতন্ত্রের যে অমানিশাকর বীজ সমাজ কাঠামোতেই বিদ্যমান প্রচ্ছন্ন বিদ্রƒপে নজরুল তাই বলতে চান। কিন্তু স্রষ্টা প্রকৃতির মাঝে মানুষের জন্য যে আয়োজন করে রেখেছেন সেখানে তিনি ভেদাভেদ করে রেখে দেননি মানুষই এই বৈষম্য তৈরি করেছে লোভের বশবর্তী হয়ে। প্রতিটা মানুষকে তার ন্যায্য অধিকার দিলে সমাজে মূল্যবোধ বজায় থাকবে তখনই। নজরুলের ‘সাম্যবাদী’ কবিতা মানুষের অধিকার রক্ষায় এক অতুলনীয় কবিতা। তিনি সব ধর্ম-বর্ণ-স্তরের মানুষের যে সমান অধিকারের কথা এই কবিতায় বলেছেন বর্তমান ক্ষয়িঞ্চু মানবিকতার বিশ্বেও তা প্রযোজ্য। আবার ‘সাম্য’ কবিতায় কবি ভেদাভেদহীন টমাস মুরের মতো এক স্বপ্ন রাজ্যের (ইউটোপিয়া) কল্পনা করেন : ‘বন্ধু, এখানে রাজা-প্রজা নাই, নাই দরিদ্র-ধনী হেথা পায় না ক’ কেহ ক্ষুদ্র-ঘাঁটা, কেহ দুধ সর-ননী।’ এক্ষেত্রে মহান দার্শনিক প্লেটোর কথা স্মরণযোগ্য তিনি ‘দ্য রিপাবলিক’ গ্রন্থে যে আদর্শ রাষ্ট্রের কথা বলেছিলেন তার সঙ্গে নজরুলের দর্শনগত মিল আছে। যেখানে ন্যায় থাকবে অবিচল আর মানব থাকবে সবার ওপরে। এই প্রসঙ্গে নজরুলের ‘মানুষ’ কবিতাটিও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য কারণে চলে আসে; কবিতাটিতে কবি মানবতাকে সবার ওপরে রেখেছেন; যেখানে মানুষ প্রতিপত্তি, অর্থ, পেশিশক্তি দিয়ে নয় সমতা দিয়ে বিবেচিত হবে। এই পঙ্ক্তিগুলোর আবেদন সর্বকালীন : ‘গাহি সাম্যের গান মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই নহে কিছু মহীয়ান।’ নজরুলের কবিতা তাই শুধু উনিশ শতকে থেমে থাকে না। মানবতার সঙ্কট যেমন সুদূরবিস্তৃত নজরুলের আহ্বান মানবতাকে রক্ষা করতে তেমনি যুগান্তকারী। ‘কুলি মজুর’ কবিতায় কবি এক মুক্ত-সীমান্ত, ক্ষুদ্র-চিন্তা বর্জিত মহা-পৃথিবীর ডাক দেন যেখানে সব ধরনের মানুষ মিলেমিশে এক স্বর্গরাজ্য রচনা করবে : ‘সকল আকাশ ভেঙ্গে পড়ুক আমাদের এই ঘরে, মোদের মাথায় চন্দ্র সূর্য তারারা পড়ুক ঝরে! সকল কালের সকল দেশের সকল মানুষ আসি’ এক মোহনায় দাঁড়াইয়া শোনো এক মিলনের বাঁশি।’ বিশ্ব-বারতার এই উদার আহ্বান নজরুলকে শুধু বাংলাদেশের নয়; সকল দেশের কবি করে তুলে; যেখানে বিভেদ নয় মানুষ হবে তার মানবিকতার গুণে শ্রেষ্ঠ। এই কবিতাটির সঙ্গে রবার্ট ফ্রস্টের ‘মেনডিং ওয়াল’ কবিতাটির বিশেষ মিল পাওয়া যায়; কিন্তু নজরুলের মতো ফ্রস্ট এত স্পষ্টভাবে আন্তরিকতা দেখাতে পারেননি তার জনপ্রিয় কবিতাটিতে। নজরুলের ‘সর্বহারা’ কাব্যের ‘কৃষাণের গান’, ‘শ্রমিকের গান’, ‘ধীবরের গান’ এগুলোর নামেই বোঝা যায় নজরুল প্রান্তিক মানুষের জীবনের কত মূল্য দিয়েছিলেন। ‘কৃষাণের গান’ কবিতায় ইংরেজ শাসন ও এর উপজাত হিসেবে জোর করে কৃষি জমির মালিকানা নেয়া শুরু হয় কৃষক হারায় তার ন্যায্য হিস্যা; এর প্রতিবাদ উঠে এসেছে এই কবিতায় : ‘মোদের উঠান ভরা শস্য ছিল হাস্য ভরা দেশ ঐ বৈশ্য-দেশের দস্যু এসে লাঞ্ছনার নাই শেষ, ও ভাই লক্ষ হাতে টানছে তারা লক্ষ্মী মায়ের কেশ, আজ মা’র কাঁদনে লোনা হ’ল সাত সাগরের জল।’ ‘শ্রমিকের গান’ কবিতায় কবি শ্রমিকদের দেখিয়েছেন দেশ গড়ার কারিগর হিসেবে কিন্তু তিনি ব্যথিত মনে দেখেছেন এই শ্রমিকরাই বড় লোকদের ইমারত তৈরি করে দিয়ে নিজেরা মানবেতর জীবনযাপন করছেন। নজরুল দারিদ্র্যের এই দুষ্টচক্রে চুপ করে থাকতে পারেননি; তাই শ্রমিকদের ডাক দিয়েছেন এর বিরুদ্ধাচরণ করতে : ‘ও ভাই দালান বাড়ি আমরা গড়ে রইনু জনম ধুলায় প’ড়ে বেড়ায় ধনী মোদের ঘাড়ে চড়ে রে। আমরা চিনির বলদ চিনি নেস্বাদ চিনি বওয়াই সার কেবল। ধর হাতুড়ি তোল কাঁধে শাবল।’ ‘ধীবরের গান’ ‘লাঙল’ পত্রিকায় ছাপা হয় নজরুলের জেলেদের প্রতি সহানুভূতি আবার প্রমাণ করে তার শ্রেণীহীন মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা। কবিতাটিতে কবি প্রতীকের ব্যবহার করে রাঘব-বোয়ালদের বিরুদ্ধে দাঁড়ান এইভাবে : ‘আমরা অতল জলের তলা থেকে রোহিত-মৃগেল আনি ছেকে রে, এবার দৈত্য দানব ধরব রে ভাই ডাঙাতে জাল ফেলে।’ নজরুল তার জ্বালাময়ী সব লেখনীর মাধ্যমে পাঠককে উদ্দীপ্ত করার পাশাপাশি মনন, চেতনা, রুচিবোধ যেমন সমৃদ্ধ করেছেন তেমনি তার কবিতা ছিল সমাজ পরিবর্তনের বলিষ্ঠ হাতিয়ারও; ব্রিটিশ তাড়ানোর আন্দোলনে তার গান, কবিতা যেমন ভূমিকা রেখেছিল একাত্তরে আমাদের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে যুগিয়েছিল সবিশেষ প্রেরণা। আবার হৃদয়ের গভীর উপলব্ধি আর মমত্ববোধ থেকে তিনি দুর্দশাগ্রস্তদের অসহায়ত্বে ছিলেন মর্মন্তুদচিত্তে বিচলিত। তার বিদ্রোহী কবিতা যেটি অন্যায়, অবিচার থেকে মানবাত্মার মুক্তির এক অনন্য সনদ সেখানেও অসহায়ের প্রতি সহমর্মিতা পোষণ করেন তিনি ‘মহা-বিদ্রোহী রণক্লান্ত/আমি সেই দিন হব শান্ত /যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে-বাতাসে ধ্বনিবে না।’ কিন্তু অত্যন্ত বেদনার ব্যাপার নজরুলের প্রদীপ্ত মানবতাবাদ সম্যকভাবে আদৃত, প্রচারিত ও প্রতিষ্ঠিত হয়নি আজও। নজরুলের দার্শনিক মানবতাবাদ প্রতিষ্ঠিত হলে সহায়হীনের যন্ত্রণা আমাদের বেদনাক্লিষ্ট করত না। সম্বলহীন, প্রত্যাখ্যাত, দুর্বলের জন্য তার লেখনী আজও জাগাতে পারে ক্ষয়ে যাওয়া মানবিক মূল্যবোধ, কারণ তার লেখা সবযুগের দাবি মেটাতে পারে। মানুষের বাইরের চাকচিক্য যত বৃদ্ধি পেয়েছে ভেতরের অবস্থা ততই রুগ্ন। সারাদিন খেটেও দু’বেলার খাবার জোটাতে পারে না এমন মানুষ রয়েছে লাখ লাখ আবার পেটের বাড়তি মেদ কমাতে দামী ওষুধ সেবনকারীও কম নয়। একদিকে বেড়ে উঠেছে ধনিক-সমাজ আর একদিকে রয়েছে চরম দারিদ্র্য-আক্রান্ত অসহায়-গোষ্ঠী। ধনী-গরিবের ক্রমবর্ধমান বৈষম্য বেড়েই চলছে যা নজরুল তার সৃষ্টিশীল-সংগ্রামে দূর করার জন্য ছিলেন দুর্বার। নজরুলকে আমাদের আবার নতুন করে মূল্যায়িত করতে হবে তাহলে দ্রোহের, বিপ্লবের, নিরন্নের কবি নজরুলের মহান সাহিত্য সাধনা ফলপ্রসূ হবে আর অসহায়ের মুখপাত্র কবির নিরলস সাহিত্য সংগ্রাম সফল হবে।
×