ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মুসান্না সাজ্জিল

তুর্কীর নয়া সুলতান ॥ রিসেফ তায়েফ এরদোগান

প্রকাশিত: ০৬:৪৩, ১৮ মে ২০১৬

তুর্কীর নয়া সুলতান ॥ রিসেফ তায়েফ এরদোগান

পাঁচ বছর আগে সবার মুখে ‘তুর্কী মডেলের কথা শোনা যেত। ইসলাম ও গণতন্ত্র কিভাবে পাশাপাশি মানিয়ে চলতে পারে তুরস্ককে তার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসাবে তুলে ধরত পাশ্চাত্য ও মুসলিম বিশ্বের মানুষ। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী (বর্তমানে প্রেসিডেন্ট) রিসেপ তাইপ এরদোগান একজন সংস্কারক হিসাবে প্রশংসিত হয়েছিলেন যিনি দেশকে অধিকতর শান্তিময় ও সম্পদশালী করে তুলছেন। কিন্তু সেই দিনগুলোর সঙ্গে আজকের তুরস্কের তুলনা করলে দুঃখ করতে হয়। তখন উদারতার পথে যাত্রার যে বাগাড়ম্বর শোনা গিয়েছিল তা থেকে স্বৈরাচারের উৎপত্তি হয়েছে। কুর্দী জাতীয়তাবাদীদের সঙ্গে শান্তি প্রক্রিয়া ভেঙ্গে পড়েছে। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা খর্ব হচ্ছে এবং সন্ত্রাসবাদী হামলা বাড়ছে। সমস্যাটা কি? কেনই বা হয়েছে? এরদোগানপন্থীরা এর সহজ উত্তর দিয়ে বলে, এ সবই ষড়যন্ত্র। এরদোগান তুরস্ককে অনেক স্বাধীন ও শক্তিশালী করে তুলেছিলেন। সেটা সহ্য হয়নি পাশ্চাত্যের। তাদের প্রচার মাধ্যম ও দেশীয় এজেন্টরা তুর্কী গণতন্ত্রের ভাবমূর্তি নস্যাতের অভিযানে নেমে পড়ে। কিন্তু তারা বুঝতে অপারগ যে এসব ষড়যন্ত্র তত্ত্ব, এই ধরনের অপপ্রচার এবং তা থেকে সৃষ্ট ঘৃণাই হলো সমস্যার একটা অংশ। তুর্কী মডেল কেন সবাইকে হতাশ করল জানতে গেলে ফিরে যেতে হবে ২০০১ সালে যখন এরদোগানের জাস্টিস এ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি বা এ, কে, পি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সে সময় তুরস্ক ছিল, সেকুলারপন্থী জেনারেলদের থাবার নিচে। এরা কোন সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলেই উৎখাত করত। ১৯৯৭ সালে তারা একেপির ইসলামপন্থী পূর্বসূরি সরকারকে উৎখাত করে। এ অবস্থায় নতুন দলটির প্রতিষ্ঠাতা তারা কৌশল পাল্টায়। তারা ঘোষণা করে যে আগের আদর্শ বা ভাবধারা তারা পরিত্যক্ত করেছে। এখন তাদের একমাত্র অগ্রাধিকার হলো তুরস্ককে ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত করা এবং দেশকে উদার, গণতন্ত্রের পথে নিয়ে যাওয়া। কথাটা চমৎকারই শুধু যে শুনিয়েছিল তা নয়, প্রকৃতপক্ষে তা কিছুকাল সুন্দরভাবে কাজও করেছিল। ক্ষমতায় থাকার প্রথম ৮ বছরে একেপি বেশকিছু উদারপন্থী সংস্কারমূলক আইন প্রণয়ন করে এবং সেই সঙ্গে অবলম্বন করে উদারপন্থী বাগাড়ম্বর। পার্টি ঘোষণা করে যে দেশের মৌলিক সমস্যাটি হলো রাষ্ট্র কর্তৃক নাগরিকদের অধিকারও পদদলন। কুর্দী জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মতো রাষ্ট্রের প্রতি বিরোধিতাকে বিশ্বাসঘাতক চক্র বা সাম্রাজ্যবাদীদের ষড়যন্ত্র হিসাবে নয় বরং স্বৈরাচারী শাসনের প্রতিক্রিয়া হিসাবে দেখতে হবে। অধিকার বা স্বাধীনতাকে খর্ব করে নয় বরং প্রসারিত করেই স্থিতিশীলতা অর্জিত হবে। একেপির এমন ভূমিকার কারণে দলটি পাশ্চাত্যের কাছে ও তুর্কী উদারপন্থীদের কাছে অতি আদরনীয় হয়ে ওঠে। কিন্তু এখানেই কাহিনীর শেষ নয়। ২০১০ সালের গণভোট ও ২০১১ সালের নির্বাচনে একেপির বড় ধরনের বিজয় অর্জন ও সামরিক বাহিনীকে নতজানু করার পর দলটির উদারপন্থী কথাবার্তা ফিকে হয়ে আসে এবং রক্ষণশীলতা পুরোভাগে এসে দাঁড়ায়। তারপর থেকে অবস্থার অবনতি ঘটতেই থাকে। ২০১৩ সালের গণবিক্ষোভ এবং তারপর দুর্নীতির তদন্তে একেপি প্রথমবারের মতো তার ক্ষমতার প্রতি চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়। দলটি তখন সেই স্বৈরাচারী নীতির আশ্রয় নেয় যার বিরোধিতায় তারা ছিল অভ্যস্ত। বিরোধীদের শত্রু হিসাবে গণ্য করা হয় যাদের ধ্বংস করতে হবে। একেপির গণতন্ত্রের রূপকল্পটি সংখ্যাগরিষ্ঠের স্বৈরাচার হিসাবে প্রমাণিত হয়। যারা দলের মৌলভিত্তি উদারপন্থী নীতিমালার প্রতি অনুগত থাকার চেষ্টা করেছিল তারা কোণঠাসা হয়ে পড়ে। তুরস্কের সেক্যুলারপন্থীরা এর পেছনে ইসলামী ষড়যন্ত্র দেখতে পায়। তারা মনে করে দলটি নিজের আসল রং লুকিয়ে রেখেছিল। সঠিক সময় তা প্রকাশ পেয়েছে। তবে ব্যাপারটাকে আরেকভাবেও দেখা যেতে পারে। একেপি প্রয়োজনের তাগিদে উদারপন্থী পথ অবলম্বন করেছিল। এ নিয়ে খুব বেশি চিন্তাভাবনা করেনি কিংবা সত্যিকারের আদর্শিক রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যায়নি। ক্ষমতা করায়ত্ত হবার পর দলের সদস্যরা ক্ষমতার দ্বারা প্রলুব্ধ নেশাসক্ত এবং দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে। আজ যারা এরদোগানের চারপাশে ভিড় জমিয়েছে তারা তাদের জীবনে প্রথমবারের মতো সম্পদ, মানমর্যাদা ও গৌরবের অধিকারী হয়েছে। সেটা তারা কিছুতেই হারাতে চায় না। তার জন্য তুর্কী গণতন্ত্রের যা হয় হোক। তবে উদারপন্থী ইসলামকে মডেল হিসাবে তুরস্ক ব্যর্থ হয়েছে বলে এমন কথা মনে করার কারণ নেই যে সকল ইসলামপন্থীই উদার গণতন্ত্রের প্রতি হুমকি। তিউনিসিয়ার অভিজ্ঞতা এর প্রমাণ। সেখানে শাসক ইসলামিস্ট এনাহুদা পার্টি শুধু জনপ্রিয়ই প্রমাণিত হয়নি আপোসও সমঝোতার অনুসারী হিসাবেও প্রমাণিত হয়েছে। অবশ্য তুরস্কের মূল সমস্যা একেপি দলের এই শেষ দিকের স্বৈরাচারী রূপ নয় বরং দেশের যে সংঘাতময় ও বিভাজনমূলক রাজনৈতিক সংস্কৃতির মধ্যে এরদোগানের পার্টির জন্ম ও বিকাশ ঘটছে সেটা। যতদিন এই সংস্কৃতির অস্তিত্ব থাকবে ততদিন স্বৈরাচারী শাসন নানা রূপে নানা চরিত্রে আবির্ভূত হবার আশঙ্কা থাকবে।
×