ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

চাঞ্চল্যকর তথ্য- হত্যায় অংশ নেয় ৪ জন, ৩ জন কুপিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করে

জেএমবির কিলিং মিশনের শিকার অধ্যাপক রেজাউল

প্রকাশিত: ০৫:৪৪, ১৮ মে ২০১৬

জেএমবির কিলিং মিশনের শিকার অধ্যাপক রেজাউল

মামুন-অর-রশিদ, রাজশাহী ॥ নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গী সংগঠন জেএমবির কিলিং মিশনের শিকার হয়েছেন রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ের (রাবি) ইংরেজী বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক এএফএম রেজাউল করিম সিদ্দিকী। হত্যাকা-ের ২৪ দিন পর জড়িত জেএমবির এক সদস্যকে গ্রেফতারের পর পুলিশ বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছে। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী জেএমবির চার সদস্য এ চাঞ্চল্যকর হত্যাকা-ে জড়িত। এদের মধ্যে মাসকাওয়াত হাসান সাকিব ওরফে আব্দুল্লাহ (২৩) নামের একজনকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়েছে পুলিশ। হত্যাকা-ে জড়িত থাকার স্বীকারোক্তিও দিয়েছে জেএমবির এ সদস্য। তার দেয়া তথ্যানুযায়ী সোমবার রাতে নগরীর খড়খড়ি এলাকা থেকে আরও তিনজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। একইসঙ্গে উদ্ধার করা হয়েছে হত্যাকা-ে ব্যবহৃত একটি মোটরসাইকেল (বগুড়া-ল-১১-১২৬৫), রামদা ও চাপাতি। গ্রেফতার তিনজনের মধ্যে দুইজনের বাড়ি রাজশাহী নগরীতে ও একজন বাইরের। পুলিশ তদন্তের স্বার্থে তাদের নাম-ঠিকানা প্রকাশ করেনি। তারাও জেএমবি সদস্য। এ হত্যাকা-ের ঘটনায় তারা সহায়তা ও আশ্রয়দানকারী। আর জেএমবি সদস্য মাসকাওয়াত হাসান রংপুর পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ছাত্র বলে জানা গেছে। অধ্যাপক রেজাউল করিম সিদ্দিকী হত্যাকা-ের চাঞ্চল্যকর মামলা তদন্তের অগ্রগতি নিয়ে মঙ্গলবার রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের (আরএমপি) কমিশনার মোঃ সামসুদ্দিন সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন। তিনি বলেন, শিক্ষক রেজাউল করিম সিদ্দিকী হত্যাকা-ে সরাসরি অংশ নেয়া মাসকাওয়াত হাসান সাকিব ওরফে আব্দুল্লাহ নামের একজনকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়েছে পুলিশ। সে জেএমবির সক্রিয় সদস্য। তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহার করে গোয়েন্দা শাখা ও বগুড়া পুলিশের সহায়তায় রাজশাহী মহানগর পুলিশের একটি টিম সোমবার তাকে গাইবান্ধা থেকে গ্রেফতার করেছে। গ্রেফতারের পর সে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছে। কমিশনার জানান, এখন স্পষ্ট অধ্যাপক রেজাউল করিম সিদ্দিকী জেএমবির কিলিং মিশনের শিকার হয়েছেন। জেএমবি সদস্য মাসকাওয়াত হাসান সাকিব ওরফে আব্দুল্লাহ’র স্বীকারোক্তির উদ্ধৃতি দিয়ে পুলিশ কমিশনার বলেন, হত্যা মিশনে চারজন সরাসরি অংশ নেয়। সবাই জেএমবির সঙ্গে যুক্ত। প্রথমে এসে তিনজন শিক্ষক রেজাউল করিমকে ঘিরে ধরে। অন্যজন মোটরসাইকেল নিয়ে সামান্য দূরে অপেক্ষা করে। শিক্ষক রেজাউল করিম সিদ্দিকী বাড়ি থেকে বের হলেই তিনজন তার পিছু নেয়। বাড়ি থেকে সামান্য দূরে আসলেই কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়েই পেছন থেকে শিক্ষকের ঘাড়ে ধারালো চাপাতির কোপ দেয়া হয়। এককোপেই শিক্ষক মাটিতে উপুড় হয়ে পড়ে যান। পরে অপর দুজনও একইস্থানে রামদা দিয়ে একই জায়গায় কোপ দিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করে দুজন গলিপথে বেরিয়ে পালিয়ে যায়। অপর দুজন মোটরসাইকেলে দ্রুত এলাকা ত্যাগ করে। হত্যাকা-ের এক সপ্তাহ আগে থেকে শিক্ষকের গতিবিধি, এলাকার অবস্থান ও হত্যাকা-ের ছক কষা হয়। স্বীকারোক্তি অনুযায়ী এপ্রিলের ১৬ তারিখে হত্যাকা- সংগঠিত করার কথা ছিল। তবে ওইদিন ওই এলাকায় মানুষের উপস্থিতি বেশি থাকার কারণে কিলিং মিশন ব্যর্থ হয়। পরে ২৩ এপ্রিল শনিবার সকালেই হত্যার দিন নির্ধারণ করা হয়। সকালে অপেক্ষাকৃত ওই এলাকায় জনসমাগম কম হওয়ায় এ দিনটি পর্যবেক্ষণের পর বেছে নেয়া হয়। সংবাদ সম্মেলনে মহানগর পুলিশ কমিশনার মোঃ সামসুদ্দিন জানান, আমরা মূল জায়গায় হাত দিয়েছি। হত্যাকা-ে সরাসরি অংশ নেয়া একজন গ্রেফতার হয়েছে। বাকি তিনজনসহ এ হত্যায় পরিকল্পনাকারীদের গ্রেফতারে পুলিশের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। অচিরেই তারাও ধরা পড়বে বলে আশাপ্রকাশ করেন পুলিশ কমিশনার। এখন পর্যন্ত এ হত্যাকা-ে সাতজন গ্রেফতার হয়েছে। গ্রেফতার অন্যদের হত্যাকা-ে সম্পৃক্ততার বিষয়ে তদন্ত করা হচ্ছে। প্রয়োজনে তাদের রিমান্ডে নিয়ে আরও জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। সরাসরি জড়িত মাসকাওয়াত হাসান সাকিব ওরফে আব্দুল্লাহ আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিলেও তদন্তের স্বার্থে আরও জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ডে নেয়া হতে পারে। স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীর পর তাকে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে বলে পুলিশ জানিয়েছে। পুলিশ জানায়, সোমবার বিকেলে গাইবান্ধা থেকে গ্রেফতার জেএমবি সদস্য ও শিক্ষক হত্যায় সরাসরি জড়িত মাসকাওয়াত হাসান সাকিব ওরফে আব্দুল্লাহকে রাজশাহী মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে নেয়া হয়। সেখানেই শিক্ষক রেজাউল হত্যায় নিজের জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে। তবে শিক্ষক রেজাউল হত্যাকা-ের কারণ জানায়নি সে। সে জানায় তারা শুধু ওপরের (জেএমবি) নির্দেশ মেনেছে। তবে ওপরের কারা এ বিষয়ে জড়িত ও পরিকল্পনাকারী এ বিষয়ে পুলিশ কিছু জানায়নি। পুলিশ জানায়, শীঘ্রই এ হত্যাকা-ের সঙ্গে জড়িত ও পরিকল্পনাকারীদের গ্রেফতার করা সম্ভব হবে। তাদের গতিবিধি সনাক্তের চেষ্টা চলছে। এদিকে শিক্ষক রেজাউল করিম হত্যাকা-ের কারণ আদর্শিক হতে পারে বলে পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে। জনপ্রিয় শিক্ষককে হত্যা করে আলোচনায় আসা ও সংগঠনের তৎপরতা জানান দেয়াও কারণ হতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র ধারণা করছেন। তবে ধর্মানুভূতির কারণেও তাকে হত্যা করা হতে পারে। পুলিশ এখন পরিকল্পনাকারী ও হত্যায় সরাসরি অংশ নেয়া অপর তিনজনকে খুঁজছে। প্রসঙ্গত, গত ২৩ এপ্রিল রাজশাহী নগরীর শালবাগান এলাকায় নিজ বাড়ির কাছেই অধ্যাপক রেজাউল করিম সিদ্দিকীকে কোপানোর পর গলাকেটে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনায় দেশজুড়ে তোলপাড় শুরু হয়। পুলিশ প্রশাসনেও অস্থিরতা শুরু হয়। লাগাতার আন্দোলনে নামেন রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি ও শিক্ষার্থীরা। রাবির আন্দোলনে এসে সংহতি প্রকাশ করে হত্যায় জড়িতদের দ্রুত গ্রেফতারের আশ^াস দেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম, শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম ও ১৪ দলের শীর্ষ নেতারা।
×