ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

দীপু মালিক

উৎসবের ঢেউ ইউরোপিয়ান ফুটবলে

প্রকাশিত: ০৪:২৪, ১৮ মে ২০১৬

উৎসবের ঢেউ ইউরোপিয়ান ফুটবলে

ইউরোপীয়ান ফুটবলে শীর্ষ পাঁচ লীগের খেলা সম্প্রতি শেষ হয়েছে। রূপকথার জন্ম দিয়ে দুই ম্যাচ আগে ইংলিশ প্রিমিয়ার লীগের শিরোপা জয় করেছে লিচেস্টার সিটি। দলটির শিরোপা উদযাপনও হয়েছে দেখার মতো। বাকি চার লীগের মধ্যে জার্মান বুন্দেসলীগা, ইতালিয়ান সিরি এ ও ফরাসী লীগ ওয়ানের শিরোপা নিষ্পত্তি হয় কয়েক ম্যাচ আগেই। লা লীগার শিরোপা ফয়সালা হয়েছে ১৪ মে। লিচেস্টার সিটি যেমন ইপিএলে বাজিমাত করেছে, তেমনি লা লীগায় বার্সিলোনা, বুন্দেসলীগায় বেয়ার্ন মিউনিখ, সিরি এ তে জুভেন্টাস ও ফরাসী লীগ ওয়ানে প্যারিস সেইন্ট-জার্মেইন (পিএসজি) ট্রফি জিতেছে। ইতোমধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে ট্রফি জয়ের উল্লাস করেছে বিজয়ী দলগুলো। এখনও উৎসবের রঙে রেঙে আছে স্পেনের নূক্যাম্প, জার্মানির মিউনিখ, ইতালির তুরিনো, ফ্রান্সের প্যারিস, ইংল্যান্ডের লিচেস্টার। লিওনেল মেসি নামের ক্ষুদে জাদুকর মূল দলে খেলা শুরুর পর থেকেই আমূলে পাল্টে যাওয়া শুরু বার্সিলোনার। এরপর থেকে সাফল্যের আরেক নাম হয়ে দাঁড়ায় কাতালান ক্লাবটি। বিশেষ করে স্প্যানিশ লা লীগার শিরোপা যেন ডালভাতে পরিণত করে দলটি। এবারও এর ব্যত্যয় হয়নি। দুর্দান্ত দাপটে ২০১৫-১৬ মৌসুমের শিরোপা নিজেদের শোকেসেই রেখে দিয়েছে বার্সিলোনা। গত শনিবার রাতে শেষ ম্যাচে লুইস সুয়ারেজের হ্যাটট্রিকে গ্রানাডাকে ৩-০ গোলে উড়িয়ে দিয়ে শিরোপা জয়ের উল্লাস করে কাতালানরা। সবশেষ আট মৌসুমে এটি বার্সার ষষ্ঠ শিরোপা। সবমিলিয়ে লা লীগায় ২৪ বার চ্যাম্পিয়ন হয়েছে স্প্যানিশ পরাশক্তিরা। লা লীগায় বার্সিলোনার মোট শিরোপার এক তৃতীয়াংশই এসেছে মেসি-ইনিয়েস্তা-জাভিরা দলের আসার পর। প্রথম ৭৫ বছর ১৬ বার চ্যাম্পিয়ন হয় তারা। এরপর ২০০৪ সালে মেসি মূল দলে খেলা শুরু করার পর আসে বাকি ৮টি শিরোপা। একটা সময় লা লীগায় একক আধিপত্য দেখিয়েছে রিয়াল মাদ্রিদ। বিশেষ করে ১৯৫৪ থেকে ১৯৬৯, ১৯৭২ থেকে ১৯৮০ ও ১৯৮৬ থেকে ১৯৯০। এর মধ্যে প্রথম ১৫ বছরে রিয়াল স্প্যানিশ লীগের শিরোপা জয় করে ১২ বার। দ্বিতীয় সময়টায় ছয়বার। তৃতীয় অধ্যায়ে টানা পাঁচ মৌসুম বার্সাকে দর্শক বানিয়ে একের পর এক শিরোপা শোকেসে ভরে রিয়াল। কিন্তু নব্বইয়ের দশক থেকেই রিয়ালের এই আধিপত্যে হানা দিতে থাকে বার্সা। যে কারণে ইতিহাসের সবচেয়ে বড়, ঐতিহ্যবাহী, রাজকীয় ক্লাবটির সাফল্যে এখন ভাটার টান। অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, সময়ের অন্যতম সেরা তারকা ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো রিয়ালের হয়ে মাত্র একবার লী লীগা জিততে পেরেছেন। ২০০৫ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত গত ১১ বছরে আটবারই চ্যাম্পিয়ন হয়েছে বার্সা। ১৯৯০ সালের পর রিয়াল লা লীগা জিতেছে মাত্র সাতবার। এই সময়টায় মেসিই রিয়ালের চেয়ে বেশি লা লীগা জিতেছেন! বার্সিলোনার স্বর্ণসাফল্যের পাশাপাশি লা লীগায় দুই মহাতারকা লিওনেল মেসি ও ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোর একতরফা আধিপত্যের অবসান ঘটিয়ে নায়ক বনে গেছেন লুইস সুয়ারেজ। দুই সুপারস্টারকে পেছনে ফেলে গত সাত বছরের মধ্যে এই প্রথমবারের মতো লা লীগার সর্বোচ্চ গোলের পুরস্কার জিতেছেন উরুগুইয়ান সুপারস্টার। দলকে চ্যাম্পিয়ন করানোর পথে সর্বোচ্চ ৪০ গোল করে ‘পিচিচি ট্রফি’ জয় নিশ্চিত করেছেন ২৯ বছর বয়সী সুয়ারেজ। অর্থাৎ রোনাল্ডো-মেসি নন লা লীগার রাজা এখন কামড়কা-ের সেই খলনায়কই! ২০১৫-১৫ মৌসুমে ৫৯ গোল করা সুয়ারেজ লী লীগায় করেছেন সর্বোচ্চ ৪০ গোল। শুধু তাই নয়, ২৬টি গোলে সতীর্থদের সহায়তাও করেছেন। সর্বোচ্চ গোলদাতা হিসেবে সাত বছরে প্রথমবারের মতো মেসি ও রোনাল্ডোকে পেছনে ফেলেছেন। অর্থাৎ ২০০৯ সালের পর মেসি ও রোনাল্ডোর বাইরে অন্য কেউ সর্বোচ্চ গোলের পুরস্কারটি জিতলেন। ২০০৯-১০ থেকে গত মৌসুম পর্যন্ত মোট তিনবার করে পুরস্কারটি ভাগাভাগি করে নেন রোনাল্ডো-মেসি। লা লীগার ইতিহাসে মেসি ও রোনল্ডো ছাড়া প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে এক মৌসুমে ৪০ গোলের কীর্তিও গড়েছেন উরুগুয়ের তারকা স্ট্রাইকার। সাফল্যের এই স্বীকৃতিস্বরূপ ইউরোপীয়ান গোল্ডেন স্যুও জিতেছেন সাবেক লিভারপুল তারকা। গ্রানাডার মাঠে জিতেই উৎসব করে বার্সিলোনা। তবে সেই উৎসবে যেন প্রাণ ছিল না! কেননা স্প্যানিশ লা লীগার চ্যাম্পিয়ন বার্সার ফুটবলররা যে ছিলেন নিজ শহর ছেড়ে অন্য জায়গায়। পরের দিন তাই মেসি-নেইমার-সুয়ারেজদের বরণ করে নিতে মুখিয়ে ছিলেন ন্যূক্যাম্পের হাজার হাজার ভক্ত-সমর্থকরা। ১৫ মে লা লীগার ২০১৫-১৬ মৌসুম আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ হয়েছে। লীগের শেষ দিনে বিজয়ী বীরদের বরণ করে নিতে কাতালান রাজ্যে নেমেছিল লাখো মানুষের ঢল। সকাল থেকে রাত অবধি ভক্ত-সমর্থকরা নেচে-গেয়ে চ্যাম্পিয়নদের বরণ করে নেন। স্থানীয় সময় সন্ধ্যায় ছাদখোলা বাসে সিউটাট এসপোর্টিভো থেকে যাত্রা শুরু করে দুই ঘণ্টা পর ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে পৌঁছায় পুরো বার্সিলোনা দল। এ সময় প্রিয় দলের জার্সি গায়ে, প্রিয় দলের পতাকা হাতে রাস্তায় নেমে আসে কাতালানবাসী। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী রিয়াল মাদ্রিদকে আশা দেখিয়ে ট্রফি জেতায় কাতালান সমর্থকরা আরও খুশি। একজন প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেন, এটি অসাধারণ। রিয়ালকে শেষ পর্যন্ত আশা দেখিয়ে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার স্বাদই আলাদা। আরেকজন বলেন, লা লীগায় বার্সিলোনা সেরা এটি আরেকবার প্রমাণ হয়েছে। সবাইকে অভিনন্দন। বিশেষ করে লিওনেল মেসিকে। সুয়ারেজ বেশি গোল করলেও মেসির অবদানই বেশি। ভক্তদের ভালবাসার জবাব দিতে চ্যাম্পিয়ন বার্সার ফুটবলাররা খোলা বাসে করে প্রদিক্ষণ করেন। বাসটির চারদিকে চ্যাম্পিয়ন লেখা লোগা ছিল। বাসটিতে কাতালানদের সব ফুটবলাররা হাত নেড়ে সমর্থকদের ভালবাসার জবাব দেন। এ সময় মেসি-সুয়ারেজ-নেইমাররা তাদের স্বাক্ষর করা জার্সি ভক্তদের উদ্দেশ্যে ছুড়ে দেন। ট্রফি নিয়ে এই উল্লাস ছিল দেখার মতো। ইতিহাসের কি অদ্ভুত প্রতিদান। ২০০৪ সালে চেলসি থেকে বহিষ্কার হয়েছিলেন লিচেস্টার সিটিকে এবার রূপকথার সাফল্য পাইয়ে দেয়া কোচ ক্লাওডিও রানিয়েরি। একযুগ পর সেই রানিয়েরিকেই মর্যাদার আসনে বসিয়েছে ব্লুজরা। সেই সঙ্গে লিচেস্টার সিটিকেও। ১৫ মে রাতে ২০১৫-১৬ মৌসুমে শেষ ম্যাচ খেলতে লন্ডনের স্টামফোর্ড ব্রিজে গিয়েছিল নতুন চ্যাম্পিয়ন লিচেস্টার। স্বাগতিক চেলসির বিরুদ্ধে ম্যাচ। যারা কিনা আগের আসরের চ্যাম্পিয়ন। ম্যাচ শুরুর আগে গত মৌসুমের চ্যাম্পিয়নরা সম্মান জানান নতুন বীরদের। অর্থাৎ ম্যাচ শুরুর আগের আনুষ্ঠানিকতায় লিচেস্টার সিটিকে ‘গার্ড অব অনার’ দিয়েছেন চেলসির খেলোয়াড়রা। ‘গার্ড অব অনার’ পেয়েছেন কোচ রানিয়েরিও। যার কারণে স্টামফোর্ড ব্রিজ থেকে চাকরিটা হারিয়েছিলেন, সেই চেলসির মালিক রোমান আব্রামোভিচও উষ্ণ আলিঙ্গনে বাঁধেন এই ইতালিয়ান কোচকে। চেলসি থেকে ছাঁটাই হওয়ার পর রানিয়েরি এবারই যে প্রথম স্টামফোর্ড ব্রিজে আসেন তা নয়। ২০০৮-০৯ মৌসুমের চ্যাম্পিয়ন্স লীগের শেষ ষোলোর ম্যাচে জুভেন্টাসের কোচ হিসেবে এসেছিলেন। ফিরেছিলেন ১-০ গোলের হার নিয়ে। এবার দ্বিতীয়বারের মতো এসে পেয়েছেন অভ্যর্থনা, স্মারক, ভালবাসা। স্বাভাবিকভাবে এবারের অনুভূতি ভীষণভাবে ছুঁয়ে গেছে ৬৪ বছর বয়সী এই ইতালিয়ানকে। এ প্রসঙ্গে রানিয়েরি বলেন, ‘এটা আবেগের। আমার বিশ্বাস, আমার পুরানো সমর্থকরা আমাকে নিয়ে খুশি। এবার আমি চ্যাম্পিয়ন হয়ে ফিরলাম। এটা দারুণ গল্প। চ্যাম্পিয়ন্স লীগের ম্যাচের জন্য জুভেন্টাসের হয়ে স্টামফোর্ড ব্রিজে এসেছিলাম। কিন্তু এবারের আসাটা অন্যরকম। কেননা আমি ইংল্যান্ডেরই আরেক দল লিচেস্টার সিটির কোচ।’
×