ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

যুদ্ধাপরাধ ইস্যুতে দু’দেশের সম্পর্ক এখন তলানিতে

পাকিস্তান জাতিসংঘে গেলে ছাড় দেবে না বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ০৫:৩৮, ১৬ মে ২০১৬

পাকিস্তান জাতিসংঘে গেলে ছাড় দেবে না বাংলাদেশ

তৌহিদুর রহমান ॥ একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে শীর্ষ জামায়াত নেতা যুদ্ধাপরাধী নিজামীর ফাঁসির পর বাংলাদেশের বিরুদ্ধে নতুন করে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে পাকিস্তান। দেশটির সরকারের পাশাপাশি বাংলাদেশের বিরুদ্ধে একজোট হচ্ছে সে দেশের প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিক দলগুলোও। এদিকে নিজামীর ফাঁসির পর ইসলামাবাদের গতিবিধি সতর্কতার সঙ্গে পর্যবেক্ষণে রেখেছে ঢাকা। এমতাবস্থায় যুদ্ধাপরাধ ইস্যু নিয়ে পাকিস্তান জাতিসংঘে গেলে বাংলাদেশও ছাড় দেবে না। কূটনৈতিক সূত্র জানায়, মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসির পরে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে নানা অপতৎপরতা শুরু করেছে পাকিস্তান। দেশটি ইতোমধ্যেই ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধের বিষয়ে জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিল ও অন্যান্য দেশের কাছে তুলে ধরবে। তবে ইসলামাবাদের বর্তমান গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করছে ঢাকা। পাকিস্তান জাতিসংঘে বিষয়টি তুললে বাংলাদেশও ছেড়ে দেবে না। বাংলাদেশ এক্ষেত্রে পাল্টা যুক্তি তুলে ধরার প্রস্তুতি নিচ্ছে। নিজামীর ফাঁসির পরে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে একজোট হচ্ছে পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিক দলগুলো। রবিবার পাকিস্তানের গণমাধ্যম শামা টিভির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চৌধুরী নিসার আলী খান পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামী প্রধান সিরাজ উল হককে টেলিফোন করেছেন। নিজামীর ফাঁসির প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশের বিরুদ্ধে কৌশল নির্ধারণে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার ব্যাপারে দুই নেতার মধ্যে কথা হয়েছে। এ ব্যাপারে অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করতেও সম্মত হয়েছেন তারা। নিজামীর ফাঁসিকে কেন্দ্র করে পাকিস্তান এখন তুরস্কের সঙ্গে গভীর যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছে। তুরস্কের পাশাপাশি বিভিন্ন মুসলিম দেশের বিষয়ে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। যুদ্ধাপরাধ ইস্যুতে বাংলাদেশকে চাপে ফেলতে বিষয়টি জাতিসংঘে তুলতে চায় পাকিস্তান। তবে জাতিসংঘে তোলার আগে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে আলোচনা করে ঐকমত্য সৃষ্টি করতে চাইছে দেশটি। যুদ্ধাপরাধ বিচারে মৃত্যুদ- কার্যকর করাটা মানবাধিকার লংঘন হিসেবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তুলে ধরতে চায় পাকিস্তান। এছাড়া বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তনের ১৯৭৪ সালের ত্রিপক্ষীয় চুক্তির লঙ্ঘন হয়েছে বলেও দাবি করেছে দেশটি। এ নিয়ে আন্তর্জাতিক জনমত গড়ে তোলার অপচেষ্টা করছে পাকিস্তান। সূত্র জানায়, নিজামীর ফাঁসির পর ঢাকা-ইসলামাবাদের মধ্যে এখন চরম টানাপোড়েন চলছে। পাকিস্তানের গতিবিধি পর্যবেক্ষণে রেখেছে ঢাকা। যুদ্ধাপরাধ বিষয়ে পাকিস্তান জাতিসংঘে কোন প্রস্তাব তুললে বাংলাদেশও এক্ষেত্রে ছাড় দেবে না। কেননা ১৯৭৪ সালের ত্রিপক্ষীয় চুক্তি পাকিস্তানই মানেনি। ওই চুক্তিতে বাংলাদেশে আটকেপড়া পাকিস্তানীকে ফিরিয়ে নেয়ার কথা বলা হলেও তারা ফেরত নেয়নি। তারাই এ চুক্তি ভঙ্গ করেছে। এছাড়া ১৯৭৪ সালের চুক্তিতে যুদ্ধাপরাধী ১৯৫ পাকিস্তানী সেনার বিচারের কথা বলা হয়েছিল। পাকিস্তান সেসব সেনা সদস্যদের বিচার কখনই করেনি। সূত্র জানায়, পাকিস্তানকে বারবার বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলাতে নিষেধ করলেও দেশটি সে কথা শুনছে না। বাংলাদেশের আহ্বানের প্রতি সাড়া না দিয়ে বারবার অভ্যন্তরীণ ইস্যুতে নাক গলিয়ে আসছে পাকিস্তান। এর আগেও যুদ্ধাপরাধ ইস্যুতে একাধিকবার নাক গলিয়েছে পাকিস্তান। নিজামীর ফাঁসির পর এবারই প্রথম বলেছে এই বিচার প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে জাতিসংঘে প্রস্তাব তুলবে পাকিস্তান। তবে বাংলাদেশের পক্ষ থেকেও এ বিষয়ে প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। পাকিস্তান এ বিষয়ে জাতিসংঘে তুললে বাংলাদেশও ছাড় দেবে না। যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে বাংলাদেশ তার যুক্তি তুলে ধরবে। নিজামীর ফাঁসির পর পাকিস্তান সরকারের তৎপরতা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। যুদ্ধাপরাধ ইস্যুতে পাকিস্তান এবার তুরস্কের সঙ্গে শক্ত জোট বেঁধেছে। তবে পাকিস্তান ও তুরস্ক একজোট হলেও এক্ষেত্রে খুব একটা সুবিধা করতে পারবে না বলে মনে করে বাংলাদেশ। কেননা পাকিস্তান ও তুরস্ক দুটি দেশই অভ্যন্তরীণ সমস্যায় রয়েছে। এই দুটি দেশের বিরুদ্ধেই জঙ্গী সম্পৃক্ততার অভিযোগ রয়েছে। পাকিস্তান আল কায়েদা ও তালেবানকে পৃষ্ঠপোষকতা করছে। অপরদিকে তুরস্কের বিরুদ্ধে আইএসকে পৃষ্ঠপোষকতা করার অভিযোগ রয়েছে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দুটি দেশেরই নেতিবাচক ভাবমূর্তি রয়েছে। তাই বাংলাদেশের বিরুদ্ধে এই দুই দেশ এক জোট হলেও খুব একটা সুবিধা করতে পারবে না বলে ধারণা করা হচ্ছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, বাংলাদেশ এখন জাতিসংঘে রোল মডেল হিসেবে বিবেচিত। বিশেষ করে নারীর ক্ষমতায়ন, বাল্যবিয়ে রোধ, জলবায়ু পরিবর্তন ঝুঁকি মোকাবেলা ইত্যাদি কারণে জাতিসংঘে বাংলাদেশের ভূমিকা খুব উজ্জ্বল। এছাড়া সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি) সফলভাবে বাস্তবায়নের পর জাতিসংঘে বাংলাদেশের প্রভাব খুব বেশি। এছাড়া বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধ বিচারের নিরপেক্ষতা ও আইনগত প্রক্রিয়া নিয়ে ইতোমধ্যেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও সংস্থার কাছে বাংলাদেশ অবহিত করেছে। এসব কারণে বাংলাদেশ আশা করছে, বাংলাদেশের বিরুদ্ধে পাকিস্তান জাতিসংঘে কোন প্রস্তাব তুললে সে প্রস্তাবে সাড়া দেবে না সদস্য দেশগুলো। সূত্র জানায় ইতোমধ্যেই বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার পক্ষে ওকালতি করার জন্য লন্ডনে কমনওয়েলথ মিনিস্ট্রিয়াল এ্যাকশন গ্রুপের বৈঠকে একটি প্রস্তাব তুলেছিল পাকিস্তান। ওই বৈঠকে বেগম জিয়ার বিরুদ্ধে বিভিন্ন মামলা প্রত্যাহারের জন্য প্রস্তাব পেশ করেছিল পাকিস্তান। কিন্তু সদস্য দেশগুলো পাকিস্তানের ওই প্রস্তাব নাকচ করে দেয়। বাংলাদেশ আশা করছে, জাতিসংঘে যুদ্ধাপরাধ বিচার নিয়ে কোন প্রস্তাব তুললে কমনওয়েলথের মতো ওই প্রস্তাবও নাকচ হয়ে যাবে। নিজামীর ফাঁসি নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে এক প্রস্তাব পাস করে পাকিস্তান সংসদ। ওই প্রস্তাবে বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রক্রিয়াকে ত্রুটিপূর্ণ বলেও আখ্যা দেয়া হয়। আর পাকিস্তান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে বলা হয়, বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত হাই কমিশনারের প্রতি সমন জারি করা হয়েছে। নিজামীর ফাঁসি অত্যন্ত দুঃখজনক। ত্রুটিপূর্ণ বিচার প্রক্রিয়ায় ১৯৭১ সালে ঘটা অপরাধের শাস্তি হিসেবে তাকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়। আমরা এই ফাঁসির প্রতিবাদ জানাচ্ছি। বিবৃতিতে আরও বলা হয়, বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক উন্নয়নে আমাদের সকল চেষ্টা সত্ত্বেও বাংলাদেশ পাকিস্তানবিদ্বেষী পদক্ষেপ নিচ্ছে যা অত্যন্ত অনুশোচনার বিষয়। এতে আরও দাবি করা হয়, ১৯৭৪ সালের ত্রিপক্ষীয় চুক্তির আওতায় নিজামীদের সাধারণ ক্ষমা করার সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশের সরকার। তবে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বারবারই বলা হয়েছে ত্রিপক্ষীয় চুক্তিতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরুদ্ধে কোন কিছু বলা ছিল না। তাই এই বিচার করাটা অত্যন্ত যৌক্তিক।
×