ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

রফিকুজ্জামান রণি

সফোক্লিসের আন্তিগোনে ও ওয়ালীউল্লাহ্র বহিপীর নাটকে নারী দ্রোহের কাল পরম্পরা

প্রকাশিত: ০৬:৫১, ১৩ মে ২০১৬

সফোক্লিসের আন্তিগোনে ও ওয়ালীউল্লাহ্র বহিপীর নাটকে নারী দ্রোহের কাল পরম্পরা

নারীরা কোনোকালেই অবলা ছিলো না। পুরুষশাসিত সমাজ ‘অবলা’ শব্দের তকমা সাঁটিয়ে এবং ধর্মের শিকল পরিয়ে লক্ষ্যবছরের ইতিহাসে নারীজাতির কর্ম-দক্ষতার ঔজ্জ্বল্যকে অস্বীকৃতি জানিয়েছে, চেষ্টা করেছে দমিয়ে রাখতে। তারপরও নারীরা কি এগোয়নি? এক্ষেত্রে বাংলাভাষার প্রথম মহিলা কবি চন্দ্রাবতীর ‘রামায়ণ’ কাব্যের পঙ্ক্তি কতেক তুলে ধরা যেতে পারে। আজ থেকে প্রায় চার শ’ বছর আগে কবি চন্দ্রাবতী তাঁর ‘রামায়ণ’ কাব্যে হিন্দুপুরাণের মহীয়সী নারী এবং সতীত্বের উজ্জ্বল প্রতীক সীতা দেবীর গুণের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছেন, ‘সীতার গুণের কথা কি কহিব আর,/কন্থায় আঁকিল কন্যা চান সুরুজ পাহাড়।/আরও যে ্আঁকিল কন্যা হাসা আর হাসি/ চাইরো পাইড়ে আঁকে কন্যা পুষ্প রাশি রাশি...।’ এর বাইরেও সীতা দেবীর অসম্ভব গুণের মহিমা সর্বকালের মানুষের মনে বিস্ময়ের সূত্রপাত ঘটায়। স্বামীর প্রতি তাঁর সীমাহীন শ্রদ্ধাভক্তি এবং মহানুভবতার চমৎকার ইতিহাস অনন্তকালের পৃথিবীকে অনুপ্রাণিত করে। তারপরও প্রশ্ন দাঁড়ায়, সীতা দেবীর এতো এতো রূপ-গুণের ন্যূনতম মর্যাদাও কি দিতে পেরেছিলেন মহাপুরুষ রামচন্দ্র? রাম-রাবণের যুদ্ধশেষে সীতা যে অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেন তারই বা মূল্য পেয়েছেন কী? স্বামীভক্ত এই নারীর প্রতি রামচন্দ্রের কর্তব্যহীনতা কবি-মনকে বার বার আহত করার কারণেই হয়তো চন্দ্রাবতী তাঁর লেখার অন্যত্রে বড় আক্ষেপ নিয়ে উল্লেখ করেছেন, ‘রামের বুদ্ধি হইল না!’ তাছাড়া মুসলিমপুরাণের প্রথম নারীপ্রতীক বিবি হাওয়াও কি অবলা ছিলেন? প্রচলন আছে যে, অসতর্কতার খেসারতে আদম-হাওয়া দুজন স্বর্গচ্যুত হয়ে পৃথিবীতে পড়েছিলেন। দুজনেই পড়েছিলেন পৃথিবীর দুই প্রান্তে। দৈবক্রমে, সময়ের পরিক্রমায় আবার তাদের মিলন ঘটে এবং পৃথিবীতে বংশবিস্তার শুরু হয়। সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন উদিত হয়, আদমের একক প্রচেষ্টায় কি দুজনের মিলন ঘটেছে? নাকি দুজনেই দুজনকে খুঁজে বের করেছেন সেদিন? ধর্মীয় ব্যাখ্যানুসারে বিষয়টা পরিষ্কার হয় যে, মানবশূন্য পৃথিবীতে পরস্পরের ঘামঝরা প্রচেষ্টায়, দীর্ঘসময় পরে আবার দুজন একত্রিত হয়েছেন। যেহেতু দুজনেরই যৌথ প্রচেষ্টায় পুনরায় তাদের মিলন ঘটেছে সেক্ষেত্রে বিষয়টা স্পষ্ট হয়, পৃথিবীর প্রথম পুরুষ আদমের মতন প্রথম নারী বিবি হাওয়াও ছিলেন অধিকার সচেতন এবং সংগ্রামমুখর একজন নারী; ফলে ‘অবলা’ শব্দটি আদম-হাওয়ার মিলনের মধ্য দিয়েই রহিত হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু মূর্খতা, বৈষম্যমূলক আচার-আচারণ, কর্তৃত্বপরায়ণ কূটচালের ফলে শব্দটাকে এখনও জিইয়ে রেখেছে পৃথিবীতে! সে যাই হোক। সকলযুগে, সকলদেশের সাহিত্যে বিশেষ একটা স্থান পেয়েছেÑ নারী। সভ্যতার ঊষাকাল থেকে নাটক, গান, কবিতা ও গল্প-গাঁথায় হাজাররূপী নারীকে আবিষ্কার করি আমরা। সেখানে নারীর দ্বিধা-সংকোচ, লজ্জা-ক্লান্তি, সাহস-ভীরুতা, অধিকার সচেতনতা এবং দ্রোহ-উদ্দমতার পাশাপাশি চূড়ান্ত মাতৃত্বের ঘ্রাণও খুঁজে পাওয়া যায়। আদিলগ্ন থেকে অন্তঃপুরীপ্রিয় তথা নেপথ্যচারণী এবং মুক্তমনা বা সমাজ-দ্রোহী উভয় শ্রেণির নারীরাই পৃথিবীতে আসা-যাওয়া করেছেন, এখনো করছেন। আজ থেকে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগের সাহিত্যজগতের দিকে দৃষ্টিপাত করলে খুব সহজেই সে প্রমাণ পেয়ে যাই আমরা। কেননা, খ্রিস্টপূর্বাব্দ ৪৯৫-এর দিকে জন্মগ্রহণ করেছিলেন ধ্রুপদী গ্রীক সাহিত্যের অন্যতম দিকপাল নাট্যকার সফোক্লিস। তাঁর যৌবনে রচিত ‘আন্তিগোনে’ নাটকটিতে সাহসী ও ভিতুময়ী দুই শ্রেণির নারীকেই আমরা প্রত্যক্ষ করি। সফোক্লিসের ‘আন্তিগোনে’ নাটকের আয়নায় দেখা যায়, আড়াই হাজার বছর আগের নারীরাও সমাজ-সভ্যতা, জাতি-ধর্ম এমনকি রাষ্ট্র ও ক্ষমতার বৈষম্যনীতির বিরুদ্ধে জীবনমৃত্যুর পরোয়া না করেই শক্ত অবস্থান নিয়েছে। জীবনের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠতম শিল্পের প্রতিচ্ছবি হিসেবে যেহেতু নাটককে গণ্য করা হয় সেকারণেই তৎসময়ের নাটকগুলোর ভেতর দিয়েই আমরা আড়াই হাজার বছরপূর্বের সমাজবাস্তবতা ও নারীসত্তার প্রতিরূপ কল্পনা করে নিতে পারি। আলোচ্যমান নাটকে অভিশপ্ত রাজা ইদিপাসের দুই কন্যা ইসমেনি ও আন্তিগোনের মধ্যে নারীর ভিন্ন ভিন্ন এবং স্বতন্ত্র সত্তা লক্ষ্য করা যায়। ইসমেনি যতটা ভীরুপ্রকৃতির মেয়ে ছিলো ঠিক ততটাই সাহস-সঞ্চারী মেয়ে ছিলো আন্তিগোনে। নাটকে দেখানো হয়েছেÑ আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে থিবিস রাজ্যের পলিনেসিস ও ইটিওক্লিস নামের দুই সহোদরের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধশেষে দুজনই মারা পড়ে। অথচ ইটিওক্লিস রাজার প্রীতিভাজন হওয়ায় তাকে দেশাচার মেনে যথাযথ মর্যাদায় সমাহিত করা হয় কিন্তু রাজার বিরাগভাজন হওয়ায় পলিনেসিসকে দেশদ্রোহী ঘোষণা করে তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পাদন কার্যকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয় এবং তার মরদেহ পশুপাখির খাবারের জন্যে ফেলে রাখা হয়। শুধু তাই নয়, তার শবদেহ সৎকার দিতে কেউ ছুটে এলে তার বিরুদ্ধেও মৃত্যুর পরোয়ানা জারি করা হবে মর্মে নোটিস দেয়া হয়। একই উদ্দেশ্যে, একই যুদ্ধক্ষেত্রে নিহত; দুই সৈনিকের বিরুদ্ধে দুই ধরনের নীতিমালা প্রণয়নের ফলে এবং মৃত ভাইয়ের মৃতদেহের প্রতি অশ্রদ্ধা প্রদর্শনের কারণে এই সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারেনি পলিনেসিসের ছোট বোন আন্তিগোনে। সে রাজাজ্ঞা ও মৃত্যুদ-ের ঘোষণা উপেক্ষা করে ভাইকে যথাযথ সম্মানে সমাহিত করার দৃঢ়প্রত্যয় নেয় এবং এই কাজে সহযোগী হিসেবে পেতে তার বোন ইসমেনিকে অনুরোধ জানায়। কিন্তু ইসমেনি রাজার মৃত্যুদ-াদেশের ভয়ে ভাইকে সমাহিত করতে রাজি হয়নি এবং আন্তিগোনেকেও এই নির্ঘাত মৃত্যুর পথ থেকে সরে আসার পরামর্শ দেয়। আন্তিগোনে দমে যায়নি, বোনকে ভর্ৎসনা করে ভাইয়ের বিরুদ্ধে রাজা ক্রিয়নের অমানবিক সিদ্ধান্তকে একপক্ষীয় আখ্যায়িত করে পলিনেসিসের মৃতদেহ গোপনে সরিয়ে ফেলার সিদ্ধান্তে অনড় থাকে। ফলে, নাটকের শেষান্তে একাই পলিনেসিসের লাশ বর্বর শাসকের হাত থেকে রক্ষা করতে গিয়ে নির্বাসন এবং সর্বশেষ মৃত্যুকেও স্বেচ্ছায় বরণ করে নেয় সে। নাটকে ইসমেনি ও আন্তিগোনের সংলাপ থেকে দুই নারীর চিন্তাচেতনার জগতের মধ্যে ভিন্নতার ছাপ পাওয়া যাায়Ñ ‘ইসমেনি : কী কাজে সাহায্য করব? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। আন্তিগোনে : আমরা লাশ সরিয়ে ফেলব...তুই আর আমি, বল, করবি? ইসমেনি : মানে...ওকে সমাহিত করবি? রাজার আদেশ অমান্য করবি? আান্তিগোনে : পছন্দ করিস আর নাই করিস, এ লাশ যার, সে তোর আর আমার ভাই। ভাইকে কখনো আমি ছেড়ে যাব না। কখনো না। ইসমেনি : রাজা পরিষ্কার আদেশ দিয়েছেন লাশ সমাহিত না করার জন্যে। তারপরও তোর এত দুঃসাহস? আন্তিগোনে : রাজার কোনো অধিকার নেই আমার আপনজন থেকে আমাকে সরিয়ে রাখার।/../ ইসমেনি : এমন অনর্থক চেষ্টা করে কোনো লাভ নেই। আন্তিগোনে : আগে তো চেষ্টা করি, তারপর দেখি পারি কিনা।’ সফোক্লিসের ইদিপাস ট্রিলজির অন্যতম শ্রেষ্ঠ সিরিজাংশ আন্তিগোনে নাটকটিতে একই সমাজে দুই শ্রেণির নারীকে আমরা প্রত্যক্ষ করি। তবে আন্তিগোনের দৃঢ়সংকল্পের কাছে শেষতক রাজা এবং বোন ইসমেনিও হার মানতে বাধ্য হয়। পলিনেসিসের লাশ সমাহিত করণকালে ধরা পড়ায় রাজা আন্তিগোনেকে হত্যা করতে চাইলে ভিতুশ্রেণির বোন ইসমেনি প্রতিবাদ করে এবং দোষ না করেও নিজেকে সমদোষী দাবি করে। পুরুষশাসিত সমাজে লুকায়িত অন্তকালের নাগদাঁত ভেঙে, ন্যায়ের পক্ষে লড়াইয়ের তীব্র অঙ্গীকারের মাধ্যমে আন্তিগোনে আমাদের সামনে আড়াই হাজার বছর আগে নারীসমাজের যে প্রতিনিধি হিসেবে উপস্থিত হয়েছে তা একালেও বিরল। এই নাটকের অন্তিমপর্বে ক্রিয়ন রাজা একে একে সর্বস্ব হারিয়ে এবং শেষকালে ভুল-সিদ্ধান্তকে স্বীকার করে, প্রমাণ করে দিলেনÑ লৌহপ্রতিম পৃথিবীতে মানবতা এবং নারীর কোনো পরাজয় নেই। নেই দ্রোহের বিনাশ। তবে যুগযুগ ধরে নারীর পাশে দাঁড়িয়ে সাহস ও শক্তি যোগানোর পেছনে সুপ্রবৃত্তির পুরুষদের অবদানও যে অনস্বীকার্য তা আন্তিগোনে নাটকে, রাজা ক্রীয়নের পুত্র হেমন আন্তিগোনের পাশে দাঁড়িয়ে প্রমাণ করে দিয়েছে। হেমন কৌশলে তার বাবা ক্রিয়নের স্বেচ্ছাচারিতাকে সমর্থন না দিয়ে আন্তিগোনের সিদ্ধান্তকে প্রশংসা করেছে। বিখ্যাত এই ট্র্যাজেডি নাটকটি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, হাজার বছর আগেও নারীরা অধিকারসচেতন ও প্রতিবাদী ছিলো। ছিলো অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার। গ্রীক নাট্যজন সফোক্লিসের আন্তিগোনে নাটকটির মতো বাংলাসাহিত্যের অমর কথাকার সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ‘বহিপীর’ নাটকটিও নারীদ্রোহের শৈল্পিক আখ্যান। বহিপীর নাটকের মধ্যেও একই সমাজে নারীসত্তার দ্বৈতরূপ লক্ষ্য করা যায়। সেখানেও নারীদের কাউকে কাউকে সীমাহীন সাহসী, কাউকে বা আবার অন্তহীন ভীরুতা নিয়ে জন্মাতে দেখা যায়। তবে ওয়ালীউল্লাহর নায়িকা তাহেরার প্রতিবাদের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। নিজের অধিকার ও স্বাধীনতার সংগ্রামে নেমে সে চাপিয়ে দেয়া ধর্মীয় সিদ্ধান্তকে দ্ব্যর্থহীনভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে। অতিমাত্রায় পীর-ভক্ত মুরিদ তাহেরার বাবা ও সৎমা জোর করে বৃদ্ধপীরের সঙ্গে তার বিয়ে দেয়। এই অসম বিয়ে মেনে নেয়নি তরুণী তাহেরা। ফলে সুযোগ পেয়ে সে পালিয়ে যায়। নিজের স্বাধীনজীবন ও ব্যক্তিত্বের প্রশ্নে সে স্বর্গ-মর্ত্যরে ভয়ভীতিকর আপ্তবাক্যকেও মোটেই প্রশ্রয় দেয়নি। কোনো কিছুর বিনিময়েই বৃদ্ধপীরকে সে স্বামী হিসেবে মেনে নিতে নারাজ। তবে পালিয়ে আসারকালে যে বজরায় আশ্রয় নিয়েছে তাহেরা, প্রকৃতির খেয়ালে সেখানেই অবস্থান নিয়েছে সদ্যবিয়ে করা স্ত্রী-হারানো পীর। এই নাটকে বজরার মালিক হাতেম আলী জমিদারের স্ত্রী খোদেজা বেগম একজন একরোখা ধর্মভীরু নারীর প্রতিমূর্তি। ধর্মীয় যে কোনো সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে নতজানু সে। ফলে খোদেজা বেগম বিষয়টা জানতে পেরে তাহেরাকে ধর্মের ভয় দেখিয়ে, পরকালের সুখশান্তির গল্প শুনিয়ে এবং পীরকে অশ্রদ্ধা করার ভয়ংকর পরিণতির কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েও তাকে টলাতে পারেনি। মেয়েটির স্পর্ধা দেখে বার বার মূর্ছা যায় খোদেজা। এখানে খোদেজা এবং তাহেরার সংলাপ থেকে দুজনের অবস্থান সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়Ñ ‘তাহেরা : বাপজান আর সৎমা। যে বুড়ো পীরের সঙ্গে বাপজান আমাকে বিয়ে দিলেন, আমরা তার মুরিদ। অবশ্য আমি না, আমার বাপজান ও সৎমাই তার মুরিদ। বছরে দু-বছরে পীরসাহেব একবার এলেই তারা খাতির-খেদমত করার জন্য অস্থির হয়ে ওঠেন। [থেমে হঠাৎ রেগে] আমি কি বকরী-ঈদের গরু-ছাগল নাকি? খোদেজা : কী ঢঙের কথাই যে তুমি বল। পীরের সঙ্গে বিয়ে হওয়াটা কোনো খারাপ কথা নয়। তাহেরা : আমি যা করেছি, তা নাকি কেউ কখনো করে না। আমার মতো মেয়েও নাকি জন্মায় না। আমি পালিয়ে কোথায় যাচ্ছি; কে আমাকে নেবে? কেন-ই বা আমি পালিয়ে যাচ্ছি? কেনই বা এমন কাজ করছি যা কোনোদিন কেউ করে না। খোদেজা : এই তো ঠিক-ঠিক কথা বলছ তুমি মা! পালিয়ে কোথায় যাবে তুমি, কেনই বা পালাবে? তাছাড়া ভেবে দ্যাখ, পীর মানুষ স্বামী কজনের কপালে জোটে? কত বড় কপাল তোমার মা, সে কথা একবার সত্যি ভেবে দ্যাখ। তাহেরা : না, না, পীরসাহেবের কথা বলবেন না। পীরসাহেবেব কথা শুনলেই আমার ভেতরটা এক মুহূর্তে কালো হয়ে যায়। মনে হয়, এক্ষুনি পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ি, না হলে একটি মেয়ে কি অত সহজে ঘর ছেড়ে পালাতে পারে? সে কথা বোঝেন না কেন?’ সফোক্লিসের আন্তিগোনে নাটকের প্রতিবাদী নায়িকা আন্তিগোনে যখন দীপ্তকণ্ঠে বলে ওঠেÑ ‘আমাকে আমার পথে চলতে দিন’। তখন সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর বহিপীর নাটকের নায়িকা তাহেরাকেও ক্ষীপ্রকণ্ঠে বলতে শুনি Ñ’আমি কি বকরী-ঈদের গরু-ছাগল নাকি?’ নারীর এই প্রতিবাদের স্বর কোনোকালেই সাধারণ কিংবা সহজ উচ্চারণ ছিলো না। তারপরও নারীদ্রোহের তামাদি হয় না কখনো। সফোক্লিসের আন্তিগোনে নাটকের মতো ওয়ালীউল্লাহর বহিপীর নাটকেও নারী-হাতকে শক্তিশালী করতে এগিয়ে এসেছে সমাজের সুপ্রবৃত্তির সাহসী পুরুষ। কেননা, খোদেজা বেগম অযৌক্তিক ধর্মভীরুতা দেখিয়ে মেয়েটিকে বার বার বিব্রতকর অবস্থায় ফেলার কারণে তার পুত্র হাশেম সরাসরি মায়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় এবং তাহেরার গৃহত্যাগের সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানায়; প্রয়োজনে সে নিজেই তাহেরাকে বিয়ে করে এই বিপদ থেকে উদ্ধারের ঘোষণা দেয়। খোদেজা তাতে বিস্মিত হলেও নাটকের চূড়ান্তপর্বে এসে তাহেরার হাত ধরে যখন সবার সামনে দিয়ে অজানার উদ্দেশ্যে পা বাড়ায় হাশেম, তখন আন্তিগোনে নাটকের স্বেচ্ছাচারী রাজা ক্রিয়নের মতো বহিপীর নাটকের পীরসাহেবও উপলব্ধি করতে পেরেছেন যে তার বিয়ের সিদ্ধান্তটা আসলেই ত্রুটিযুক্ত ছিলো। তাই, দুজনের অগ্রযাত্রাকে বাধা না দেয়ার জন্যে পীরসাহেব কঠোরভাবে নির্দেশ প্রদান করলেন। ফলে, এখানেও নারী বিদ্রোহের চূড়ান্ত ও সার্থক বিজয়ের দৃশ্যপট শৈল্পিকভাবে চিত্রিত হয়েছে।
×