ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বিলুপ্তির পথে দশ ভাষা টুটুল মাহফুজ

প্রকাশিত: ০৬:৪৭, ১৩ মে ২০১৬

বিলুপ্তির পথে দশ ভাষা টুটুল মাহফুজ

সব মানুষই অন্তত নিজ মাতৃভাষার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত। বিভিন্ন ধ্বনি পরপর সাজিয়ে তৈরি হয় শব্দ, আর অনেক শব্দ নানা বিন্যাসে সাজিয়ে গড়া হয় বাক্য। বাক্য নিয়ে তৈরি হয় একটি ভাষা। কিন্তু কোন ভাষায় কতগুলো বাক্য হতে পারে, তার কোন সীমাবদ্ধতা নেই। ভাষার বক্তারা কতগুলো সীমিতসংখ্যক সূত্র কাজে লাগিয়ে অসীমসংখ্যক বাক্য বলতে ও বুঝতে পারেন। আধুনিক চমষ্কীয় ভাষাবিজ্ঞানের পরিভাষায় এই সূত্রগুলোকে বলা হয় বক্তার মানসিক ব্যাকরণ। বক্তা যখন ছোটবেলায় ভাষা জ্ঞান অর্জন করে, তখন তার মধ্যে এই মানসিক ব্যাকরণের বোধ গড়ে ওঠে। বিশ্বের ১১টি সর্বাধিক প্রচারিত ভাষা হলো চাইনিজ, ইংরেজী, হিন্দী-উর্দু, স্প্যানিশ, আরবী, পর্তুগীজ, রাশিয়ান, বাংলা, জাপানী, জার্মান ও ফরাসী। এই ভাষাগুলোয় কথা বলেন বিশ্বের অর্ধেক মানুষ। সবচেয়ে বেশি ভাষার আঁতুড়ঘর দুটি দেশ। পাপুয়া নিউগিনি, যেখানে ৮৫০টিরও বেশি ভাষা রয়েছে। অপরটি ইন্দোনেশিয়া, যেখানে ৬৭০টি ভাষা লোকমুখে ফেরে। মহাদেশের বিচারে বিশ্বের ১ হাজারের মধ্যে ১৫ শতাংশ ভাষায় কথা বলা হয় দক্ষিণ ও উত্তর আমেরিকায়, আফ্রিকায় ৩০ শতাংশ, এশিয়াতে ৩০ শতাংশ, সবচেয়ে কম ইউরোপে সেখানে মাত্র ৩ শতাংশ। এদের মধ্যে অনেকগুলো ভাষাই পরস্পরের সঙ্গে সংযুক্ত। আবার এমন কিছু ভাষা আছে যেগুলো একটিই ভৌগোলিক অঞ্চলে বসবাসকারী মানুষই ব্যবহার করে। বংশধরদের অভাবে কয়েকটি ভাষা বিলুপ্তি হয়ে গেছে। যেমন বাস্ক, উস্কারা- যে ভাষাগুলো বক্তার অভাবে হারিয়ে গিয়েছে। প্রতিনিয়ত ভাষা ও ভাষায় শব্দের ব্যবহার পাল্টে যাচ্ছে। অনেক ভাষা অস্তিত্ব রক্ষায় অন্যের সঙ্গে নিজেকে মিশিয়ে নিচ্ছে। যার ফলে খর্ব হচ্ছে ভাষার স্বাতন্ত্রতা। সমীক্ষা বলছে, প্রতি ১৫ দিনে একটি করে ভাষা প্রায় মুছে যাচ্ছে পৃথিবীর বুক থেকে। কয়েকটি ভাষা অবশ্য সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় স্বমহিমায় ফিরেও এসেছে। যেমন: ওয়েলশ, মাওরি। তবে সরকারী আনুকূল্য ছাড়াই পৃথিবীতে আরও কিছু ভাষার অস্তিত্ব রয়েছে যা ঐতিহ্যগতভাবে এখনও টিকে আছে। আসুন জেনে নেই, বিলুপ্ত দশ ভাষার কথা। তুশিরো ২০০৮ সালের এক গবেষণায় জানা গেছে, মাত্র একজন লোক আছেন যিনি তুশিরো ভাষায় কথা বলতে জানেন। এটি ল্যাটিন আমেরিকার দেশ পেরুর একটি উপজাতীয় সম্প্রদায়ের ভাষা। পেরু-ইকুয়েডরের সীমান্তবর্তী নদী টিগরা ও আওচায়াকোর আশপাশে এ ভাষার জন্ম। তুশিরো এখন পৃথিবীর অন্যতম বিচ্ছিন্ন ভাষা। তুশিরোর নিকটবর্তী অন্য ভাষাগুলোর অস্তিত্ব এখন আর নেই। গবেষণা অনুযায়ী ১৯৬১ সালে তুভার, ১৯৬৮ তে লৈকটকা, ১৯৯৪ তে কাউফম্যান ভাষা হারিয়ে গেছে পৃথিবী থেকে। এগুলো ছিল তুশিরোর নিকটবর্তী ভাষা। কায়জানা ব্রাজিলের জাপুরা নদী অববাহিকার একটি গ্রামের ভাষা ছিল কায়জানা। পরবর্তীতে এখানে পর্তুগীজ উপনিবেশ গড়ে। ফলে হারিয়ে যেতে থাকে কায়জানা ভাষা। একসময় দেখা যায়, স্থানীয় ২০০ লোক এ ভাষায় কথা বলছে। সর্বশেষ ২০০৬ সালের গবেষণায় জানা যায়, ওই জাপুরা নদী অববাহিকায় আর মাত্র ১ জন লোক আছেন যিনি কায়জানা ভাষা জানেন। লেমেরিগ প্রশান্ত মহাসাগরের দক্ষিণে এবং অস্ট্রেলিয়া থেকে প্রায় ১ হাজার মাইল উত্তরে অবস্থিত ছোট্ট দ্বীপদেশ ভানুয়াতু। ভানুয়াতুর একটি দ্বীপের নাম ভানুয়ালাভা। এখানে মূলত আদিবাসীরা বাস করেন। ২০১০ সালের এক গবেষণায় জানা যায়, বিলুপ্ত হতে চলেছে লেমেরিগ ভাষা। আর মাত্র ২ জন লোক আছেন ওই দ্বীপে যারা লেমেরিগ ভাষায় কথা বলেন। লেমেরিগ ভাষার আরও কিছু নাম রয়েছে। যেমন: পাক, বেক, সাসার, লেওন, লেম। সেমেহুয়েবি সেমেহুয়েবি মূলত রেড ইন্ডিয়ানদের ভাষা। আমেরিকার আদিম অধিবাসীরা এ ভাষায় কথা বলত। ২০০৭ সালের এক গবেষণায় দেখা যায়, পৃথিবীতে আর ৩ জন লোক আছে যারা সেমেহুয়েবি ভাষায় কথা বলতে জানে। এ ভাষাটিতে কথা বলত মূলত কলোরাডো, এ্যারিজোনা, ক্যালিফোর্নিয়া ও দক্ষিণ নেভাডা অঙ্গরাজ্যের বাসিন্দারা। নেজরেপ নাইজেরিয়ার আদিবাসীদের ভাষা এটি। বিলুপ্তপ্রায় এ ভাষাটির অস্তিত্ব একসময় ক্যামেরুনেও দেখা গিয়েছিল। তবে অল্পসময়ের জন্য। ২০০৭ সালের এক গবেষণার মাধ্যমে জানা যায়, আর ৪ জন লোক রয়েছেন ওই অঞ্চলে যারা নেজরেপ ভাষায় কথা বলেন। নেজরেপ ভাষার খুব কাছাকাছি একটি ভাষা ম্যামবিলা ভাষা। জানা যায়, নেজরেপ ভাষা ক্রমে বিলুপ্ত হয়ে ম্যামবিলা ভাষার মধ্যে ঢুকে পড়ছে। তানেমা (তানিমা, তেবায়ো) ওশেনিয়া মহাদেশের দেশ সলোম্যান দ্বীপপুঞ্জ। সলোম্যান দ্বীপের তেমোতু রাজ্যে অবস্থিত ভ্যানিকোলা নামের একটি দ্বীপ। এ দ্বীপের একটি গ্রামের নাম ইমুয়া। এ গ্রামের বাসিন্দাদের ভাষা ছিল তানেমা, যা প্রায় বিলুপ্তির পথে। ২০০৮ সালের এক গবেষণা থেকে জানা যায়, এ ভাষায় এখন কথা বলছেন মাত্র ৪ জন মানুষ। এ ভাষার নিকটবর্তী আরও দুটি ভাষা রয়েছে পিজিন ও তেনু নামে। গবেষকরা বলছেন, তানেমা ভাষা এই পিজিন ও তেনুতে হারিয়ে যাচ্ছে। লিকি মোয়ার নামে অন্য আর একটি নাম রয়েছে এ ভাষার। ইন্দোনেশিয়ার উপকূলীয় অঞ্চল সার্মি, জায়াপুরা কাবুপাতেন ও সার্মি কেচেমাতেন নামের গ্রামগুলোতে এ বিলুপ্ত প্রায় ভাষায় কথা বলছে কিছু লোক। জানা যায়, এই তিন অঞ্চলে মাত্র ৫ জন লোক রয়েছে, যারা লিকি ভাষাভাষী। অর্থাৎ প্রায় বিলুপ্তির পথে এ ভাষা। অংগোটা ভাষা বিজ্ঞানীদের মতে অংগোটা মূলত আফ্রো-এশিয়াটিক ভাষা। এ ভাষার উদ্ভব ও বিকাশ আফ্রিকার দেশ ইথিওপিয়ায়। বায়তো নদী অববাহিকার পশ্চিম তীরে অংগোটা ভাষাভাষী লোকদের বাস ছিল। জানা যায়, ওই অঞ্চলে আর ৬ জন বৃদ্ধ মানুষ রয়েছেন যারা এ ভাষায় কথা বলেন। দুমি ত্যাপ ও রাভা নদীর অববাহিকায় গড়ে ওঠা সম্প্রদায়ের লোকদের ভাষা দুমি। এছাড়া হিমালয়ের পাদদেশের খোটাং জেলার মানুষও এ ভাষায় কথা বলছে। এক গবেষণার মাধ্যমে জানা যায়, বর্তমানে তিব্বতীয় এক পরিবারের ৮ জন সদস্য এ ভাষায় কথা বলছেন। এ ভাষাকে বিলুপ্তপ্রায় ভাষা হিসেবে গণ্য করা হয়েছে সম্প্রতি। চামিচুরো পৃথিবীর ৮ জন লোক এ ভাষায় কথা বলছে। ল্যাটিন আমেরিকার দেশ পেরুর আদিবাসীদের ভাষা ছিল চামিচুরো। এ ভাষাটি প্রায় বিলুপ্তির পথে। এ ভাষার ভাষাভাষীরা বহুদিন আগে থেকেই স্প্যনিশ ভাষা আয়ত্ব করে ফেলেছে।
×