ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

এনামুল হক

মানচিত্রের বিশাল সংগ্রহশালা

প্রকাশিত: ০৬:৩৯, ১৩ মে ২০১৬

মানচিত্রের বিশাল সংগ্রহশালা

ডেভিড রামসে সানফ্রান্সিসকোর একজন রিয়েল এস্টেট ডেভেলপার ও ইনভেস্টর। কিন্তু তার পেশা মানচিত্র সংগ্রহে। বেশ কয়েক দশক ধরে তিনি দেড় লাখেরও বেশি মানচিত্র, এটলাস ও গ্লোব সংগ্রহ করেছেন। তাঁর এই বিশাল সংগ্রহ নিয়েই ক্যালিফোর্নিয়ার স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্প্রতি চালু হয়েছে নতুন এক মানচিত্র সংগ্রহশালা যার নাম ভেডিভ রামসে ম্যাপ সেন্টার। রামসের সংগ্রহশালায় গেলে মনে হবে ওটা মানচিত্রপ্রেমীদের এক স্বর্গ। বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐ কেন্দ্রে যেতে হলে একটা বিচিত্র দরজা দিয়ে লাইব্রেরিতে প্রবেশ করতে এবং দুপ্রস্থ সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে হবে। তবে সিঁড়িটাও স্রেফ সিঁড়ি নয়। দেয়ালগুলো মেঝে থেকে নিয়ে সিলিং পর্যন্ত নানাবর্ণের মানচিত্রে চিত্রিত। সিঁড়ির ওপরের প্রান্তে জর্জ মন্টেগু হুইলারের ১৮৮৩ সালের ইয়োশেমাই উপত্যকার টপোগ্রাফিক মানচিত্র কাঁচের দরজায় খোদাই করা। সেটি ঠেলে প্রবেশ করতে হয় এক বিশাল কক্ষে সেখানে কঠোর বুককেসের ওপরে বসানো গ্লোবগুলো ধীর গতিতে পাক খেয়ে চলেছে। বুককেসগুলো আবার প্রাচীন এটলাসে ঠাসা। একটা দেয়াল প্রমাণ স্ক্রীনে প্রাচীন ও আধুনিক মানচিত্রগুলোর ছবি পালাক্রমে প্রদর্শিত হচ্ছে। কেন্দ্রটিতে যে দেড় লক্ষাধিক ম্যাপ, এটলাস ও গ্লোব আছে তার মধ্যে বিশেষভাবে প্রাধান্য হলো অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীর মানচিত্র। ঐ অধ্যায়টিতেই শুরু হয়েছিল আধুনিক মানচিত্র অঙ্কন। এগুলোর মধ্যে আছে ১৭৫০ ও ১৮১৫ সালের মধ্যে ক্যাসিনি পরিবারের তৈরি ফ্রান্সের অবিশ্বাস্য বিশদ মানচিত্র। এই মানচিত্রের ১৮২টি শিট পাশাপাশি রাখলে সেটা হবে ৩৯ ফুট উঁচু ও ৩৮ ফুট প্রশস্ত। এখানে আরও আছে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগের মার্কিন আদম শুমারির ভিত্তিতে ফ্রান্সিস আমাসা ওয়াকারের পরিসংখ্যান এটলাস। নিউইয়র্ক পাবলিক লাইব্রেরীর জিও স্প্যাশিয়ান মাইব্রেরিয়ান ম্যাট ক্ল্যুজেনের ভাষায় এটা হলো বিশ্বে মানচিত্রের বৃহত্তম প্রাইভেট সংগ্রহশালাগুলোর একটি। নিউইয়র্ক পাবলিক লাইব্রেরীরও মানচিত্রের নিজস্ব বিশাল সংগ্রহ আছে। তবে রামসে তার সংগ্রহকে প্রায় জনগণের সম্পদ হিসেবেই গড়ে তুলেছেন। গোড়া থেকেই রামসে বলেছেন যে, তিনি দিয়ে দেয়ার জন্যই মানচিত্রগুলো সংগ্রহ করেছিলেন। একাডেমিক আগ্রহ থেকে যে কেউ কাগুজী মানচিত্র পরীক্ষা করে দেখতে কিংবা সূক্ষ্মতম উপায়ে দেখার উদ্দেশ্যে ডিজিটাল ডিসপ্লেগুলো বড় করে দেখতে পারে। রামসে দেয়ালে বসানো ১২ ফুট বাই ৭ ফুটের টাচ্স্ক্রীন দিয়ে দানিউর নদীর ১৮৩৭ মানচিত্র দেখিয়ে থাকেন। তিনি এ ব্যাপারে আধুনিক স্যাটেলাইট ইমেজকেও কাজে লাগান। রামসের জীবনের গতিপথ সহজ-সরল নয়। সেখানে বাঁক আছে, মোড় আছে, ঘাত-প্রতিঘাত আছে। ষাটের দশকের শেষদিকে ইয়েমেনের আন্ডার গ্র্যাজুয়েট রামসে ‘পালসা গ্রুপ’ নামে একটি পারফর্মেন্স আর্ট গ্রুপ প্রতিষ্ঠা করেন। তারা সিনথেসাইজার তৈরি এবং শব্দ ও আলো নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট কাজে লাগাতেন নিউইয়র্ক সিটির মিউজিয়ার্স অব মডার্ন আর্টে, তাদের পরিবেশিত অনুষ্ঠান ভোগ ম্যাগাজিনে সুখ্যাতির সঙ্গে উল্লেখ করা হয়। বিখ্যাত আলোকচিত্রী ইবভিং পেনের এই অনুষ্ঠানের ছবিও তাতে পরিবেশিত হয়েছিল। রামসে বলেন, ‘আমরা শিল্পকারখানার বাজারে বিশ্বাসী ছিলাম না। আমরা এমন শিল্পকলা তৈরি করতে চেয়েছিলাম যা সবার জন্য উন্মুক্ত থাকবে এবং বিনামূল্যে।’ রামসের বয়স যখন ৩০ বছর তখন গ্রুপটিতে ভাঙ্গন ধরে। অচিরেই রামসে শৈশবের এক বন্ধুর পক্ষে কাজ করতে চলে যান। পরে তিনি ২০টি বছর আটলান্টিক ফিলানথ্রোপিসের পক্ষে রিয়েল এস্টেটে বিনিয়োগ করেন এবং দাতব্য কাজে অর্থ সম্পদ গড়ে তোলেন। নিজের জন্য বেশ ভালভাবেই গুছিয়ে নিয়েছিলেন তিনি। ১৯৯৫ সালে ৫০ বছর বয়সে তিনি পদত্যাগ করেন। ততদিনে তিনি প্রায় এক দশক ধরে তিনি মানচিত্র সংগ্রহ করছিলেন। তিনি বলেন, ‘আমার সবসময়ই মনে হয়েছে যে কাজের চাপের মধ্যে থাকলে মানচিত্র দেখলে দারুন এক মানসিক আনন্দ পাওয়া যায়।’ তিনি এক বিশাল সংগ্রহ গড়ে তুলছিলেন সেটা শুধু মানচিত্রের নয়, উপরন্ত বিশদ রেকর্ড ও নথিপত্র। এসব নিয়ে কী করা যায় সে ব্যাপারে তিনি বেশ মাথা ঘামাচ্ছিলেন। ঠিক এমন সময় আবির্ভাব ঘটল ইন্টারনেটের। তিনি মানচিত্রগুলো স্ক্যানিং ও আপলোডিং করতে শুরু করেন। রামসে বলেন ‘১৯৯৯ সালে’ আমরা যখন এই সাইটটি চালু করি লোকে তখনও ইন্টারনেট সংযোগ পাওয়ার জন্য ডায়াল আপ করছিল। আমার মনে আছে বেশ কিছু ম্যাপ লাইব্রেরিয়ান অভিযোগ করছিলেন যে, আমাদের ছবিগুলো বড্ড বেশি বড়। কিন্তু আমরা আমাদের নিজস্ব কৌশলই আঁকড়ে ধরে থাকি এবং বলি এগুলো সবই দ্রুততর ও উন্নততর হয়ে উঠবে।’ বলাবাহুল্য সে সময় বড় বড় ইমেজ অনলাইনে দেখানোর জন্য ভাল সফটওয়্যার ছিল না। সেই কারণে রামসে নিজেই একটা কোম্পানি গঠন করেন যার নাম লুনা কোম্পানি এবং লুনা সফটওয়্যার নামে তার নিজস্ব সফটওয়্যারও গড়ে তোলেন। আজ এই সফটওয়্যার কয়েক ডজন লাইব্রেরী, মিউজিয়াম ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান ব্যবহার কমছে। অর্থাৎ তিনি সময়ের আগেই চলে গিয়েছিলেন। আজ সেটা ইমেজ টাইলিং বলে পরিচিত লুনা তখন সে কাজটাই করছিল। ব্যাপারটা ছিল ইমেজের সুবিশাল ফাইল ছোট ছোট টুকরোয় কেটে ইন্টারনেট যোগে পাঠিয়ে দেয়া এবং একটা নির্দিষ্ট সময়ে শুধু সেটাই পাঠিয়ে দেয়া যা একজন ব্যবহারকারীর স্ক্রীনে প্রদর্শিত হতে পারে। এ কারণেই গুগল ম্যাপস, আপনার আইফোনকে নিষ্ক্রিয় করে ফেলে না। আজ অবধি রামসে তাঁর ওয়েবসাইটে প্রায় ৬৮ হাজার মানচিত্র স্ক্যান ও আপলোড করেছেন। এটা হলো তাঁর সংগ্রহে যত মানচিত্র আছে তার অর্ধেকের কিছু কম। তবে পুরো সংগ্রহ অনলাইনে না যাওয়া পর্যন্ত তাঁর এই স্ক্যানিং চলবে। বহু বছর রামসে ঊনবিংশ শতাব্দীতে তৈরি মানচিত্রের ওপরই দৃষ্টিনিবন্ধ করেছিলেন। সে সময় মানচিত্র নির্মাণে একটা মৌলিক পরিবর্তন ঘটে গিয়েছিল। তার আগ পর্যন্ত মানচিত্রে পরিবেশের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য যথা পাহাড় পর্যন্ত, নদ-নদী, শহর-নগর, রাস্তাঘাট ইত্যাদি ফুটিয়ে তোলা হতো। কিন্তু ঊনবিংশ শতকে মানচিত্র নির্মাতারা রোগব্যাধির প্রাদুর্ভাব ও সামাজিক অবস্থাবলীও তুলে ধরতে শুরু করেন। সরকারগুলো জাতীয় আদমশুমারির জনসংখ্যাগত তথ্য, তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাত এবং আবহাওয়ার অন্যান্য বৈশিষ্ট্যও দেখাতে থাকে। উপাত্তের সঙ্গে ভূগোলের সংযোগ ঘটালে সম্পূর্ণ নতুন এক প্যাটার্ন বেরিয়ে আসত। শেষের অল্প কয়েক বছর রামসে সপ্তদশ শতাব্দীর গোড়ার দিকের এটলাস থেকে শুরু করে বিংশ শতাব্দীর আমেরিকার নগরীগুলোর সচিত্র মানচিত্রসহ নতুন ও পুরনো মানচিত্রে তার সংগ্রহ সমৃদ্ধ করে তোলেন। রামসে এসব মানচিত্র শুধু তার নিজের জন্য নয়, সকলের ব্যবহারের জন্য সংগ্রহ করেছেন। সে কথা তিনি নিজেও বিভিন্ন সময়ে বলেছেন। সূত্র : বিবিসি
×