ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মুনতাসীর মামুন

উদ্ভট উটের পিঠে কি চলেছে স্বদেশ?

প্রকাশিত: ০৩:৫৫, ১৩ মে ২০১৬

উদ্ভট উটের পিঠে কি চলেছে স্বদেশ?

(গতকালের সম্পাদকীয় পাতার পর) অন্য আরেকটি ঘটনা ঘটছে। গ্রামাঞ্চলে, ব্যাপক দল বদল। সবাই আওয়ামী প্রসাদ চাই। দল বদল হতেই পারে। কিন্তু একজন বিএনপি-জামায়াতকে স্থানীয় নির্বাচনে মনোনয়ন দেয়া কতটুকু যৌক্তিক। বছর পাঁচেক দল করুক। টেকে কিনা দেখা হোক। তারপর মনোনয়ন দেয়া হোক। ব্যাপারটা এমনই হচ্ছে যে, বাংলা ভাইয়ের এলাকা বাগমারায় বাংলা ভাইয়ের দোসরকেই চেয়ারম্যান নির্বাচনে মনোনয়ন দেয়া হলো।’ দৈনিক সমকালে এই সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার পর তার মনোনয়ন বাতিল করা হয়। অবস্থা এমন দাঁড়াচ্ছে যে, বলতে হয়, আওয়ামী লীগ, বিরোধী দল ও দর্শনে একমাত্র পার্থক্য ব্যক্তি শেখ হাসিনা। সব শেষে বলব, যারা শেখ হাসিনাকে সব সময় সমর্থন করে এসেছেন প্রগতি ও শান্তির প্রতীক হিসেবে, এখন তারা নিরাপদে বেরুতে পারেন না ঘর ছেড়ে, অনেককে নিতে হয়েছে নিরাপত্তা কর্মী। যারা সুযোগ বুঝে সমর্থন করে আবার সময় পাল্টে গেলে বিরোধিতা করে এখন। প্রভাবশালী পদগুলোতেও তারা। আমি যে ব্যক্তিগত উদাহরণ দিয়েছিলাম। খুলনায় মুক্তিযুদ্ধের প্রতিষ্ঠান করতে গিয়ে দুই কমিশনারের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে ক্ষমতা প্রদর্শন এবং এ কারণে তাদের উচ্চ পদায়ন, বিভিন্ন পদে হঠাৎ নৌকালাভারদের প্রেরণ, নির্বাচনে তাদের অগ্রাধিকার। তারা খুন করলে উপদেশ দেয়া হয় ভিকটিমদের। আর যারা শেখ হাসিনাকে পারলে জবাই করতে চায় সপরিবারে তাদের রমরমা। তারা নির্ভয়ে ঘুরে বেড়ায়, চাকরি পায়, এমপিদের পোষ্য তারা, প্রশাসনে তাদের প্রভাবÑ এ অবস্থা চললে প্রশ্ন তো উঠতেই পারে, উদ্ভট উটের পিঠে কি চলেছে স্বদেশ? সব লড়াই-ই অন্তিমে সাংস্কৃতিক লড়াই। ১৯৪৮ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখব, বঞ্চনার বিষয় ছিল, কিন্তু সাংস্কৃতিক ইস্যুগুলোই মুখ্য হয়ে উঠেছিল। ১৯৭৫ সালের দ্বন্দ্বটাও ছিল কাকুল না ঢাকা বা বাঙালী না মুসলমান বাঙালী। এখনও জঙ্গীদের যে বিষয়টি সামনে আসছে তাও সংস্কৃতির দ্বন্দ্ব। বর্তমানে বিএনপি-জামায়াত-জঙ্গীদের পার্থক্য খুব বেশি একটি নেই। জঙ্গীরা যা বলছে আর হেজাবীরা যা বলছে তাতে পার্থক্য কোথায়? হেজাবীরাও হিন্দুদের বিরুদ্ধে, আহমদ শফিও বিরুদ্ধে, ওলামা লীগও বিরুদ্ধে। শেখ হাসিনা দেশের যে উন্নয়ন করেছেন তা দৃশ্যমান। তাহলেও হেজাবীদের সমাবেশে তো লোকের ঘাটতি দেখি না। ইউপি নির্বাচনে বিএনপি যদি ২০০ আসনও পেয়ে থাকে, পেয়েছেও। এত অন্যায় করার পর ২০০টি এলাকায় তারা পাকিস্তানী ছিটমহল করল কীভাবে? বংশ পরম্পরায় রাজাকারী মনোভাবাপন্ন মানুষ তৈরি হচ্ছে কীভাবে। এর কারণ একটি যেটি বারংবার বলে আসছি কিন্তু কর্ণপাত করেননি শাসকরা। সেটি হচ্ছে মনোজগতে আধিপত্য। হেজাবীরা বাঙালীর মনে লুকিয়ে থাকা সাম্প্রদায়িকতা ও পাকিস্তান প্রেম উস্কে দিতে পেরেছে। এখানে ধর্ম-বর্ণের ভেদাভেদ কম। যে কারণে মির্জা-গয়েশ্বর কোন পার্থক্য সৃষ্টি করে না। জিয়া টাকা দিয়ে, সরকারী প্রতিষ্ঠান দিয়ে, অস্ত্র দিয়ে পাকিস্তানী যে বাতাবরণ তৈরি করেছিল সেটি ‘বংশ’ পরম্পরায় এরশাদ-খালেদা চালিয়ে গেছেন। এদের কাছে আওয়ামী লীগ মানে হচ্ছে হিন্দু ভারতের প্রতিনিধিত্বকারী হিন্দু মনোভাবাপন্ন দল। বামপন্থীরা হলো নাস্তিক। দুটির অর্থই এক। আওয়ামী লীগ ও ‘বাম’ পন্থীরা ক্ষমতায় খুব কম ছিল। এখন সেটি বলা যাবে না। তারা কিন্তু এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টিই এড়িয়ে গেছে। প্রধানমন্ত্রী পুরো দৃষ্টি দিয়েছেন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির দিকে। তাতে তিনি সফল। তিনি বিদ্যুতকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। তাতে সফল। তিনি ক্রিকেটে বিনিয়োগ করেছেন, তাতে ডিভিডেন্ড পাচ্ছেন, হয়ত বোনাসও পাবেন। অর্থনীতিকে শেখ হাসিনা যে পর্যায়ে নিয়ে গেছেন বা যে ভিত্তি প্রদান করেছেন, তাতে অর্থনীতি ভেঙ্গে পড়ার সম্ভাবনা কম। প্রবৃদ্ধি এক পয়েন্ট বাড়তে পারে বা এক পয়েন্ট কমতে পারে- এই যা। এই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিই কি সব? তাহলে খুনোখুনি কেন হচ্ছে? সমাজ এত অমানবিক হয়ে পড়ছে কেন? ধর্মের প্রভাব পরিবৃদ্ধির কারণ কি? এই অর্থনৈতিক পরিবৃদ্ধির জন্যও তো আওয়ামী লীগকে ভোট দেয়ার দরকার। কিন্তু ভোট পাচ্ছে না কেন? হাইকোর্টে বিচারকরা কেন এত বিরূপ? হেজাবীরা যত সহজে নিস্তার পায়, আওয়ামী লীগ পরিচিতি থাকলে নিস্তার পায় না কেন? এসব এখন ভাববার সময় এসেছে। সুবিধাভোগী ও সুবিধাবঞ্চিত অনেকে বলেন, আওয়ামী লীগ সব সময় আত্মীয় ফার্স্ট। আমি বলব এটি ঠিক নয়। সব দলেই আত্মীয় ও বন্ধু ফার্স্ট। কিন্তু, দেখতে হবে, এর বাইরে কেউ যেতে পারছে কিনা? পারছে, না হলে, বর্তমানে পৃথিবীর খুব কম দেশই একটানা ৬ ভাগ প্রবৃদ্ধি ধরে রেখেছে। হেজাবী রাজনীতি না থাকলে এটি ৯-১০-এ যেত। বর্তমান সরকারের বিষয়গুলো সামগ্রিকভাবে বিচার করতে হবে। আমি বা আমরা গোটাকয়েক লোক কী পেলাম সেটা মুখ্য নয়। সামগ্রিকভাবে দেশ বা মানুষ কী পেল সেটি বড় বিষয়। এ সরকার থেকে দেশ-মানুষ পেয়েছে। আগের আমল থেকেও বেশি পেয়েছে এবং তা অব্যাহত থাকুক এটিই আমরা চাই। তাই লড়াইটা এখন ভিন্ন ফ্রন্টে নিয়ে যেতে হবে। ২০১৩ সালের ৫ মে হেফাজতীদের খেদানের পর মুজাহিদ, আহমদ শফি ও তার সাঙ্গাৎরা চুপটি করেছিল। সেই বছরে জঙ্গী হামলা হ্রাস পেয়েছিল, মুক্তমনা খুনও। তার পরের বছর থেকে এদের কথাবার্তার ধরন পাল্টাচ্ছে, তারা পুরনো ফর্মে ফিরে আসছে। তারপর থেকে খুনের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে। এর একটি কারণ, তারা ভাবছে ‘ইসলামী হুমকি’ দিলেই সরকার পিছু হটবে। বাস্তবে তাই হচ্ছে। এ থেকে উপসংহারে পৌঁছানো যায়, কঠোর হাতে তাদের দমন করার কৌশল সঠিক ছিল। সেই কৌশলে আবার ফিরে আসা বাঞ্ছনীয়। একই সঙ্গে শিক্ষা-সংস্কৃতির জিডিপিতে গুরুত্ব আরোপ করতে। শুধু সনদী শিক্ষা দিয়ে এই দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি গড়ে তোলা যাবে না। মাদ্রাসার ছাত্র দিয়ে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় টেকা যাবে না। একমুখী না হোক কয়েকমুখী করেন কিন্তু ১০-১১ মুখী শিক্ষা ব্যবস্থা চলতে পারে না। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শুধু বিজনেস শিক্ষার ওপর জোর দেয়া হচ্ছে, কোন বিশ্ববিদ্যালয়েই রাষ্ট্রভাষা ও মানবিক বিষয়কে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে না। মঞ্জুরি কমিশনের চাকরি যে রুটিন চাকরি এবং এর কোন ভিশন নেই সেটি নতুন করে বলার দরকার নেই। পাশ্চাত্যে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সময় এ দৃষ্টিভঙ্গি গুরুত্ব পেয়েছিল। পরে তারা অনুধাবন করে এতে সমাজ অমানবিক হয়ে যাচ্ছে। বাংলা বিভাগ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে থাকবে না, মানবিক বিষয় গুরুত্ব পাবে না, সে তো আর বিশ্ববিদ্যালয় থাকে না। প্রধানমন্ত্রী, হাইকোর্টের নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও বাচ্চার স্কুল ব্যাগের ওজন কমানো যায়নি। তাদের খেলাধুলার সুযোগ হরণ করা হয়েছে, সাংস্কৃতিক কর্মকা- অচল। এর ওপর যুক্ত হয়েছে স্বাধীনতার পক্ষের ও স্বাধীনতার বিরোধী পক্ষ প্রশ্ন যেটি পৃথিবীর কোথাও নেই। সমাজে যেমন অস্থিরতা বিরাজ করছে তা বোঝা যায় ঢাকার রাস্তার আইনহীনতা দেখালে, আইন কার্যকরে অনীহা দেখলে। মা সন্তানকে খুন করছে এই ফেনোমেনা কি আগে ছিল আমাদের সমাজে। ধর্ম ধর্ম করেও তো এই অমানবিকতা ঠেকানো যাচ্ছে না। এ পরিপ্রেক্ষিতে উচিত শিক্ষা সংস্কৃতি ক্ষেত্রে জিডিপি বৃদ্ধি। সেনাবাহিনী পুলিশ থেকে এই দুই ক্ষেত্রে বিনিয়োগ যে ডিভিডেন্ড দেবে তা আর কোন ক্ষেত্র দেবে না। এটা খুব আশ্চর্যের বিষয় যে, শিক্ষা, সংস্কৃতি, মুক্তিযুদ্ধ, নারী ও শিশু এবং ধর্ম মন্ত্রণালয়ের প্রধানরা বসে একটি সমন্বিত রূপ রেখা তৈরি করতে পারলে যা পাকিস্তানী ছিটমহল গড়া প্রতিরোধ করবে এবং সংস্কৃতির বিকাশ ঘটাবে। এ ক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধি না করতে পারলে দেশটি অর্থনীতিতে এগিয়ে যাবে। হয়ত মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশে পরিণত হবে কিন্তু বাংলাদেশ হবে না এবং এটি একমাত্র বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর পক্ষেই সম্ভব, অন্য কারও পক্ষে নয়। কারণ, তার মতো আস্থা অর্জন আর কেউ করতে পারেন না। যে দল, যে নেতা মানুষকে বড় করতে চান সে নেতাই বড় হয়ে ওঠেন, দল প্রধান শক্তিতে পরিণত হয়। যে দল, যে নেতা মানুষকে বড় করতে চায় না সে দলের বিনাশ হয় এবং নেতা হারিয়ে যান। বঙ্গবন্ধুর দল দেশকে মুক্ত শুধু নয়, বড় করতে চেয়েছিল। বঙ্গবন্ধু দেশ আর দেশের মানুষ ছাড়া কাউকে ভাল বেসেছেন কিনা সন্দেহ। তাই তিনি এখনও বড় নেতা। শেখ হাসিনার কাছেও তাই প্রত্যাশা। তিনি মানুষকে বড় করতে চান, কিন্তু একরৈখিক চিন্তা বা পরিকল্পনায় তা কাক্সিক্ষত ফল দেবে না। চিন্তাটা হওয়া দরকার বহুমাত্রিক। মানুষকে সচেতন করে তোলা বড় কাজ, নাগরিক সমাজে স্পন্দন গণতন্ত্রের প্রাথমিক শর্ত। যে লক্ষ্যটির কথা বললাম সেখানে সরকার একা পৌঁছতে পারবে না যদি না আমরা সঙ্গী হই, সজীব হই। এবং সে নেতৃত্বটা আসতে হবে শেখ হাসিনার তরফ থেকে। সচেতন মানুষই তার হাত শক্তিশালী করতে পারবে, অন্যরা নয়। সচেতন হলে কি হতে পারে তার একটি উদাহরণ দিয়ে শেষ করছি। কয়েক দিন আগে এক মসজিদের ইমাম প্রয়াত প্রেসিডেন্ট জিল্লুর রহমান ও কয়েকজনকে রাজাকার এবং বর্তমান সরকার ও শেখ হাসিনাকে ভারতের দালাল বলে বক্তৃতায় বলছিলেন, মুসল্লিরা তাকে গণধোলাই দিয়ে মসজিদ থেকে বের করে দেয়। আমরা যারা শেখ হাসিনাকে সমর্থন করেছি এবং করছি তারা চাই না, তার নেতৃত্বাধীন দেশকে কেউ বলুক অদ্ভুত উটের পথে কি চলেছে স্বদেশ? (সমাপ্ত)
×