মোরসালিন মিজান ॥ ছোট ছোট ছেলে মেয়ে। বড় বড় পরীক্ষা। সকালে পরীক্ষা। বিকেলেও। এভাবে মোটামুটি অভ্যস্থ আজকের প্রজন্ম। এরপরও এসএসসি সামনে আসলে নাওয়া খাওয়া ভুলে যায় অনেকে। ভুলে যেতে হয়। টেনশন ক্রমশ বাড়ে। অস্থির হয়ে উঠে এমনকি অভিভাবকের মন। আর তারপর যখন ভালয় ভালয় পাস, আনন্দের সীমা থাকে না। বুধবার প্রকাশিত মাধ্যমিক পরীক্ষার ফল সেই হাসিরাশি আনন্দকে আবারও সামনে আনলো। স্কুলের আঙিনা বাসাবাড়ি বন্ধুদের আড্ডা বাবার অফিস- সর্বত্রই চলছে পরীক্ষা পাসের মিষ্টিমধুর উদ্যাপন। আজকের ভাল ছাত্র আগামী দিনের ভাল মানুষটি হয়ে ওঠবে এমন প্রত্যাশার কথাই উচ্চারিত হচ্ছে সর্বত্র।
দুই মাস আগে আটটি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডসহ মাদ্রাসা, কারিগরি ও বিআইএসই শিক্ষা বোর্ডের অধীনে ২০১৬ সালের এসএসসি, দাখিল ও এসএসসি ভোকেশনাল পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। ১০ শিক্ষা বোর্ডে মোট পরীক্ষার্থী ছিল ১৬ লাখ ৫২ হাজার ৮শ’ ৫৭ জন। ছাত্র ৮ লাখ ৪৩ হাজার ৯শ’ ৫ জন। ৮ লাখ ৮ হাজার ৯শ’ ৭ জন ছাত্রী। বলার অপেক্ষা রাখে না, পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর থেকে প্রত্যেকেই অপেক্ষায়। সেই অপেক্ষার অবসান হলো ৫৭ দিনের মাথায়। প্রকাশিত হলো এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল। গড় পাসের হার ৮৮ দশমিক ২৯ শতাংশ।
ফল প্রকাশের পর সারাদেশে ছড়িয়ে থাকা শিক্ষার্থীরা যেন হাফ ছেড়ে বাঁচে। অধিকাংশ স্কুল চত্বরে শুরু হয় আনন্দ উৎসব। রাজধানী ঢাকার নামীদামী স্কুলগুলোতে সমবেত হয় স্ব স্ব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। আগে থেকেই সহপাঠীরা মিলে কলেজে আসতে থাকে। বেলা ১টার দিকে মোবাইল ফোনে পাওয়া হয় ফল। এরপর যেন স্রোতের মতো আসতে থাকে শিক্ষার্থীরা। শুরু হয়ে যায় হৈ হুল্লোড়। হাতের দুই আঙুলে বিজয়ের চিহ্ন দেখিয়ে একজন অন্যজনকে জড়িয়ে ধরে। বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে চলে নাচ গান। মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল এ্যান্ড কলেজ, রাজউক উত্তরা মডেল স্কুল এ্যান্ড কলেজ, ভিকারুননিসা নূন স্কুল এ্যান্ড কলেজসহ বেশ কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ঘুরে দেখা গেছে এমন দৃশ্য। এবার ফলাফলের ভিত্তিতে সেরা কলেজ নির্বাচনের রীতিটি বাতিল করা হয়েছে। এ কারণে কলেজগুলোতে উদ্যাপনের ধরন প্রায় এক ছিল। রাজউক উত্তরা মডেল স্কুল এ্যান্ড কলেজের ক্যাম্পাসে সবাইকে ব্যস্ত দেখা গেল মোবাইল ফোনে। যে যার মতো করে ফল খোঁজাখুঁজি করছিল। হঠাৎ চিৎকারে ফেটে পড়ে সিদরাতুল মুনতাহা। জানায়, ফল পাওয়া গেছে এবং তা প্রত্যাশিত। গোল্ডেন জিপিএ ফাইভ প্রাপ্তির খবর নিশ্চিত করে সে বলে, নিজের সাধ্যের সবটুকু দিয়ে চেষ্টা করেছি। কোন ফাঁকি ছিল না। জানতাম রেজাল্ট ভাল হবে। তা-ই হয়েছে। কী যে আনন্দ লাগছে, কী যে...। কথা শেষ করতে পারে না মেয়েটি। ততক্ষণে আরও কয়েকজন কথা বলতে শুরু করে। তারাও জানায়, শ্রম কাজে লেগেছে। ফল সন্তোষজনক। একজন তো কেঁদেই ফেলল। এই কান্না আনন্দের। ভিকারুননিসা নূন স্কুল এ্যান্ড কলেজের সবাই মেয়ে। মেয়েরাই ভাল করেছে বেশি। সে কথা জানিয়ে মৌমিতা নামের এক শিক্ষার্থী বেশ গর্ব করে বলল, আমি পরীক্ষায় কখনও খারাপ করি না। এসএসসি পরীক্ষার পরও মনে হচ্ছিল, কোন ব্যাপার নয়। কিন্তু ফল ঘোষণার দিন যত এগিয়ে আসছিল, বুক কেমন যেন করতে শুরু করে। আজ সেই অশান্তি দূর হলো! এটা ভেবে ‘অস্থির’ লাগছে!
ফল প্রত্যাশীদের অনেকের সঙ্গেই এদিন এসেছিলেন বাবা মায়েরাও। সন্তানের ভাল খবরে আনন্দাশ্রু গড়িয়ে পড়তে দেখা গেছে অনেক অভিভাবকের চোখে। মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল এ্যান্ড কলেজ থেকে গোল্ডেন জিপিএ ফাইভ পাওয়া মেয়ে আয়শা বিনতে তালেবকে নিয়ে গর্ব করছিলেন মা রিনা তালেব। তিনি তার সংগ্রামের জায়গাটা তুলে ধরলেন এভাবেÑ বাচ্চাদের ছাড়া পৃথিবীর আর কিছু নিয়ে কখনও চিন্তা করি না। আমার মেয়ের আমি ছায়াসঙ্গী। মেয়েকে স্কুলে নিয়ে যাওয়া, কোচিং থেকে আনাÑ সবই করেছি। মেয়ে রাত দু’টো পর্যন্ত পড়ালেখা করেছে। আমিও দুটোর আগে ঘুমোতে যাইনি। পুরোটা সময় তাকে উৎসাহ যোগিয়েছি। কাছে থেকেছি। এত কিছুর পর যে ফল তাতে এই মা শুধু খুশি নন, গর্বিত! তার প্রতিটি উচ্চারণে মনে হয়েছে, তার চেয়ে সুখী মা আর নেই!
এভাবে প্রতিটি হাসি কান্না অভিন্ন ভাষা পেয়েছিল। দারুণ একটি দিন পার করেছে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা। এমন আনন্দঘন দিন তাদের জীবনে বার বার আসুক। সফলভাবে পাস করা ছেলে মেয়েরা মানুষ হওয়ার পরীক্ষায় পাস করুকÑ সকলের তা-ই প্রত্যাশা।