ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আওয়ামী লীগের কাউন্সিল ও মাল্টিডাইমেনশনাল পার্টি -স্বদেশ রায়

প্রকাশিত: ০৩:৪১, ১২ মে ২০১৬

আওয়ামী লীগের কাউন্সিল ও মাল্টিডাইমেনশনাল পার্টি -স্বদেশ রায়

কিছুদিন আগে বিএনপির একটি কাউন্সিল হয়েছে। বিএনপিকে রাজনৈতিক দল হিসেবে হিসাব করলে ভুল হবে। আখেরে রাজনীতির হিসাব মিলবে না। বিএনপি আগে ছিল সুবিধাবাদী ও লুটেরাদের একটি প্লাটফর্ম। যেহেতু আইয়ুব খানের আমল থেকে এ দেশে সুবিধাবাদী ও লুটেরা শ্রেণী গড়ে তোলা হয়েছিল তাই তাদের প্রভাব ও প্রতিপত্তি সর্বোপরি তাদের মেকানিজমের কারণে বিএনপি এক ধরনের জনপ্রিয়তাও পায়। এখন যে বিএনপি আছে সেটা বিশ্ব সন্ত্রাসবাদের একটি শাখা, বাংলাদেশের সন্ত্রাসবাদের মূল কেন্দ্রস্থল এবং ছাতা। তাই তাদের কাউন্সিল কেমন হলো এ নিয়ে মাথা ঘামিয়ে বাংলাদেশের ভবিষ্যত রাজনীতির কোন হিসাবও মিলবে না, কোন পরিবর্তনও হবে না। বিএনপি সময়ের গর্ভে বিলীন হয়ে যাবে। কিন্তু বিএনপির কাউন্সিল শেষ হতে না হতেই দেশের সর্ব বৃহৎ রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের কাউন্সিল সামনে এসে গেছে। আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র, কাউন্সিলের স্ট্রাকচার- সবই হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দীর চিন্তার ফসল। পরবর্তীকালে সময় পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে নানা সময়ে এর পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু মৌল ভিত্তি ঠিকই আছে। এবার আওয়ামী লীগ যখন এই কাউন্সিল করতে যাচ্ছে এ সময়ে দেশের লোক সংখ্যা প্রায় ১৭ কোটি ছুঁই ছুঁই। ১০ কোটি তরুণ কর্মক্ষম। দেশে শিক্ষিত না হোক শিক্ষার হার বেড়েছে। জিডিপি ৭ পার্সেন্ট। মাথাপিছু আয় প্রায় দেড় হাজার ডলার। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু তৈরি হচ্ছে। আগামী দুই বছরের মধ্যে এটা শেষ হলে জিডিপি বেড়ে যাবে আরও দুই পার্সেন্ট। সব মিলিয়ে আওয়ামী লীগের এই কাউন্সিলের পরবর্তী তিনটি বছর দেশে আরও অনেক পরিবর্তন ঘটবে। দেশের জিডিপি তখন ডাবল ফিগারে পৌঁছাবে। একটি দেশ যখন জিডিপিতে ডাবল ফিগারে যায় তখন স্বাভাবিকই তার দেশের মাথাপিছু আয় দুই হাজার ডলারের ওপরে চলে যায়। অর্থাৎ আগামী তিন বছরে দেশের মূল চালিকাশক্তি হয়ে যাচ্ছে অর্থনীতি। অর্থনীতি যখন কোন দেশের মূল চালিকাশক্তি হয়, তখন স্বাভাবিক কতকগুলো পরিবর্তন হয় যেমন, রাজপথের নৈরাজ্যমূলক রাজনীতি বন্ধ হয়ে যায়। আর অর্থনীতির শক্তির সঙ্গে সঙ্গে যদি সংস্কৃতির শক্তি মেলানো যায় তাহলে যে কোন ধরনের মৌলবাদ বা পশ্চাৎপদ চিন্তার স্বাভাবিক মৃত্যু ঘটে। পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা এগুলোর উন্নতি হয়। আগামী তিন বছরে সেগুলোই ঘটবে। এ ধরনের একটি ভবিষ্যতকে সামনে রেখে আওয়ামী লীগ তাদের কাউন্সিল করতে যাচ্ছে। এই কাউন্সিল যদি বিগত আরও পাঁচটা কাউন্সিলের মতো হয় তাহলে তা দেশের জন্য, দেশ পরিচালনার, এমনকি ভবিষ্যত রাজনৈতিক নেতৃত্বের জন্যও ভাল হবে না। তাই আওয়ামী লীগ শুধু নয়, জনগণের ভেতর থেকে উঠে আসা যে কোন রাজনৈতিক দলকে এখন কাউন্সিল করে নতুন করে রাজনৈতিক কাঠামো তৈরি করতে হলে একটু চিন্তা করতে হবে। প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দলের এসব বিষয় নিয়ে চিন্তা করার জন্য যথেষ্ট সক্ষমতা আছে। সে ধরনের সেল আছে। তার পরেও আমরা যারা বাইরে থেকে রাজনীতিকে দেখি, দেশকে দেখি, দেশের ভাল ও মন্দ নিজের মতো দেখার সুযোগ পাই তাদেরও কিছু কিছু চিন্তা কখনও কখনও মাথায় আসে। এগুলো ভুল কি সঠিক তা প্রমাণ করবে ভবিষ্যত। তবে সেগুলোকে শেয়ার করার অধিকার সবার আছে। যেমন রাজনৈতিক দল হিসেবে ধরা যাক আওয়ামী লীগকে, তারা ইতোমধ্যে ঘোষণা দিয়েছে তারা তাদের বঙ্গবন্ধু এ্যাভিনিউর অফিসটি ভেঙ্গে ফেলে মাল্টিস্টোরেজ বিল্ডিং করতে যাচ্ছে। ধরে নেয়া যাক আওয়ামী লীগের সেখানে ষোলো তলা, বিশ তলা বা পঁচিশ তলা একটি অফিস হলো। এখন এই অফিসটিতে যদি শুধু বিকেলে অঙ্গ সংগঠনের কিছু লোক আসে আর তারা চা খায়, কিছু ব্রেন স্ট্রম করেন তাতেই যদি শেষ হয়, তাহলে কি এই মাল্টিস্টোরেজ বিল্ডিং করার কোন সার্থকতা আছে? নেই। আওয়ামী লীগের এই অফিসটিকে একটি দশটা-পাঁচটার অফিস হতে হবে। যদি এ অফিসটি দশটা-পাঁচটার একটি অফিস হয় তাহলে কিন্তু এই মাল্টিস্টোরেজ বিল্ডিংয়ের সার্থকতা আছে। এখন শুধুই কি একটি বিল্ডিং পরিবর্তন হচ্ছে বলেই দলের পরিবর্তন করতে হবে তা কিন্তু নয়। বিল্ডিংটি একটি উদাহরণ মাত্র। আর সে উদাহরণটি একটি উন্নয়নের উদাহরণ। অর্থাৎ বিদ্যুতহীন একটি ভাঙ্গা বিল্ডিং থেকে একটি সুসজ্জিত আধুনিক মডেলের মাল্টিস্টোরেজ বিল্ডিং মূলত একটি উন্নয়নের প্রতীক। তাই এ উন্নয়নের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দলকে উন্নত করতে হবে বা উন্নত কাঠামো দিতে হবে। এ মুহূর্তে আওয়ামী লীগের মতো একটি বড় দলকে তার কাঠামো নিয়ে ভাবতে হলে, প্রথমেই কতকগুলো বিষয় মাথায় রাখতে হবে। এক. দেশের লোক সংখ্যা সতেরো কোটি কিন্তু দেশটি ইউনিটারি- এই দেশকে প্রদেশে ভাগ করার মতো কোন ভুল সিদ্ধান্ত নেয়া ঠিক হবে না। এই একক চরিত্র রেখে রাজনৈতিক দলের চরিত্র বা কাঠামো ১৭ কোটি বা বিশ কোটি মানুষকে মাথায় নিয়ে পরিবর্তন করতে হবে। দুই. দেশে এখন পেশাজীবীর সংখ্যা ও চরিত্র বেড়েছে। তাই সে বিষয়টিও মাথায় রাখতে হবে। তিন. দেশের দশ কোটি মানুষ মূলত তারুণ্যের সীমারেখার ভেতর ঘুরছে। চার. পাঁচ কোটি বয়স্কের দিকে ঝুঁকছে। পৃথিবীজুড়ে বয়স্ক নিয়ে চিন্তা আবার বদলে গেছে। এখান থেকে দুই বছর আগেও মনে করা হতো বয়স্করা রাষ্ট্র বা সমাজের জন্য বোঝা হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এখন বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, বিজ্ঞানের কারণে কাজের ধরনে ও চলাচলে যে পরিবর্তন এসেছে তাতে বয়স্করা বেশি প্রডাকশন দিচ্ছেন। তাই বয়স্কদের বাদ দেয়ার মতো ভুল সিদ্ধান্ত নেয়ারও সময় এখন নয়। পাঁচ. অন্যদিকে অর্থনীতি, শিক্ষা ও সংস্কৃতির পরিবর্তন ঘটছে। তাই এখন যে কোন রাজনৈতিক দলকে সাজাতে হলে, তারুণ্য, বয়স্ক, অর্থনীতি, পেশা, শিক্ষা ও সংস্কৃতি মিলিয়ে ভাবতে হবে। পাশাপাশি বাংলাদেশের কোন বড় রাজনৈতিক দলের জন্য আরও দুটো জটিল বিষয় হলো এক. এখানে কোন প্রদেশ নেই অথচ প্রায় সতেরো কোটি মানুষ। আবার দশ কোটি তরুণ, পাঁচ কোটি বয়স্ক। তাই এ দুইয়েরও মিলন ঘটাতে হবে। পাশাপাশি যখন কোন দেশের অর্থনীতি বড় হয়ে যায়, তখন যেমন সরকারকে অনেক বেশি যোগ্য ও সরকারের নানা বিভাগ তৈরি করতে হয় তেমনি সরকার পরিচালনা মূল কেন্দ্রস্থল ও ব্রিডিং গ্রাউন্ড রাজনৈতিক দলকে সেভাবেই তৈরি করতে হয়। নিজস্ব আকার পরিবর্তন করতে হয়। নানা বিভাগ তৈরি করতে হয়। বাংলাদেশ একক দেশ কোন প্রদেশ নেই বলেই কিন্তু এখানে রাজনৈতিক দলগুলো তাদের রাজনৈতিক জেলা তৈরি করে। এ্যাডমিনিস্ট্রেডিভ জেলার থেকে রাজনৈতিক জেলার সংখ্যা অনেক বেশি। এখন মনে হয় ভেবে দেখার সময় এসেছে এই সংখ্যা আরও বাড়ানো। আওয়ামী লীগের মতো বড় দলের যে সংখ্যক রাজনৈতিক জেলা আছে, এই কাউন্সিলের ভেতর দিয়ে গঠনতন্ত্রে পরিবর্তন এনে তা কমপক্ষে চারগুণ করা প্রয়োজন। রাজনৈতিক জেলার সংখ্যা চারগুণ করলে ১৭ কোটির একটি জনসংখ্যার যে অনুপাতে মানুষকে রাজনৈতিক সংগঠনে অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন সে অনুপাতের কাছাকাছি যাবে। বাস্তবে চারগুণ না পাঁচগুণ বাড়ানো দরকার তা রাজনৈতিক দলগুলো আরও ভাল বুঝবে। তবে জনসংখ্যার অনুপাতে রাজনৈতিক সংগঠনে অন্তর্ভুক্তি ছাড়া কোন রাজনৈতিক দল ওই দেশের রাজনীতির প্রতিনিধিত্ব করতে পারে না। জনসংখ্যার অনুপাত এবং সাংগঠনিক ক্ষেত্রের কর্মী বা নেতার অনুপাত যদি সমঞ্জস না হয় তাহলে ওই সংগঠনের থেকে রাষ্ট্রের যে কোন অর্গান যে কোন মুহূর্তে শক্তিশালী হয়ে যেতে পারে। তখন রাজনীতির বদলে অরাজনৈতিক শক্তিই শক্তিশালী হয়ে ওঠে। জেলাভিত্তিক এ অনুপাত ঠিক করার পরে কেন্দ্রে এ অনুপাত ঠিক করতে হবে। কেন্দ্রে এ অনুপাত যদি কাঠামোর ভিত্তিতে ঠিক না করা হয়, তাহলে কিন্তু ওই হাঁটতে গেলেই গায়ে সহ সম্পাদকের ধাক্কা লাগবে। যতদূর জানি সহ-সম্পাদক তৈরিতে ওবায়দুল কাদেরেরও অনেক অবদান আছে। এখন তিনিই সত্য বলছেন যে, ‘গায়ে ধাক্কা লাগে’। এ জন্য সহ-সম্পাদকরাও দায়ী নন, ওবায়দুল কাদেরও দায়ী নন। কাঠামো তৈরির আগে এভাবে সংখ্যা বাড়ালে তার ফল এমনি হয়। এ জন্য কাউকে দোষ না দিয়ে আগামী কাউন্সিলে আওয়ামী লীগ দ্বিকাঠামোর সাংগঠনিক বিন্যাস চিন্তা করতে পারে। একটি সেক্রেটিয়েট কাঠামো একটি অর্গানাইজেশনাল কাঠামো। টেবিল ওয়ার্কে অভ্যস্ত বা অভ্যস্ত হতে পারবে এমনদের সংযোগ করতে হবে সেক্রেটিয়েট কাঠামোর মাধ্যমে। সেখানে একটি রাষ্ট্র কাঠামোতে যত বিষয় আছে সকল শাখা খুলতে হবে। এই সেক্রেটিয়েটের ভেতর দিয়ে যে নেতৃত্ব গড়ে উঠবে তারা রাষ্ট্র ও সরকারের সব ক্ষেত্রে কোন ধরনের নেতৃত্ব দিতে পারবে তা সহজে বোঝা যায়। পাশাপাশি মানুষকে সুসংগঠিত করার কাজটি সৃষ্টির আদি থেকেই চলমান। মানুষকে সুসংগঠিত না করলে মানুষ নিজেকেও প্রকাশ করতে পারে না আবার এগিয়েও যেতে পারে না (দু-একজন ছাড়া)। যেমন বুদ্ধ এককভাবে এগিয়ে গিয়েছিলেন তারপরেও বুদ্ধ সংঘ গড়েছিলেন এবং সম্ভবত পৃথিবীর ইতিহাসে বুদ্ধই প্রথম সংঘ বা অর্গানাইজেশনের গুরুত্ব উপলব্ধি করেন ও গড়েন। সভ্যতার ইতিহাসে এর আগে এভাবে আর কাউকে দেখা যায় না। এখনও মানুষকে এগিয়ে যেতে হলে সংঘের বা সংগঠনের দরকার। তাই সেক্রেটিয়েট কাঠামোর পাশাপাশি অর্গানাইজেশনাল কাঠামো নতুন আঙ্গিকে গড়তে হবে। অবশ্য সব দলের তা আছে, এখন তাকে আরও আধুনিক করতে হবে। আরও বেশি মেথডিক্যাল হতে হবে। সাংবাদিকের চিন্তা সব সময়ই একটু স্রোতে ভাসা পাতার মতো সাধারণ চিন্তা হয়, রাজনৈতিক দল তাদের চিন্তাবিদরা গভীরে গিয়ে আরও সঠিক চিন্তা করতে পারবেন। চিন্তা বাস্তবায়নের পথ তৈরি করতে পারবেন। তবে এটা সত্য, এই ধরনের মৌলিক পরিবর্তন ছাড়া আওয়ামী লীগের একটি কাউন্সিল কিন্তু কোন অর্থবহ কিছু হবে না। বরং আবারও সকল ভার শেখ হাসিনাকে বইতে হবে। আর তাঁর অবর্তমানে কী হবে তা কেউ জানে না। তবে শেখ হাসিনার ওপর আশা রাখা যায়, তিনি যেমন নতুন মাল্টিস্টোরেজ বিল্ডিং তৈরি করছেন অফিসের জন্য তেমনি মাল্টিডাইমেনশনের পার্টিও তিনি তৈরি করবেন। [email protected]
×