নৌযান শ্রমিকদের লাগাতার ধর্মঘট স্থগিতের পর ফের কর্মচঞ্চল হয়ে উঠেছে দেশের নৌবন্দরগুলো। যাত্রী সাধারণের জন্য এটি একটি সুসংবাদ বটে। তবে বেঁকে বসেছে পণ্যবাহী নৌযান মালিকদের সংগঠন। নৌযান শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির প্রতিবাদে তারা পণ্যবাহী জাহাজ না চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। নৌযান শ্রমিকদের দাবি খুব বেশি ছিল না। ক শ্রেণীর শ্রমিকদের জন্য সর্বনিম্ন মজুরি ১০ হাজার টাকা নির্ধারণ, সরকারী কর্মচারীদের ন্যায় আনুষঙ্গিক কিছু সুযোগ-সুবিধাসহ ১৫ দফা দাবি। নৌমন্ত্রীর আশ্বাসে শ্রমিকরা ধর্মঘট প্রত্যাহার করে কাজে যোগ দিলেও বেঁকে বসেন বাংলাদেশ কার্গো ভেসেল ওনার্স এ্যাসোসিয়েশনের নেতারা। তাদের বক্তব্য, শ্রমিকদের মজুরি বাড়ানোর সিদ্ধান্ত ‘চাপিয়ে’ দেয়া হয়েছে। এত মজুরি দিয়ে তাদের পক্ষে জাহাজ চালানো নাকি সম্ভব নয়। পরে সরকারী হস্তক্ষেপে এর আপাত সমাধান হয়।
অন্যদিকে বহুল আলোচিত ভ্যাট আইন, যা কার্যকর হতে যাচ্ছে আগামী জুলাই থেকে তা নিয়ে আপত্তি জানিয়েছেন এফবিসিসিআই সভাপতি। এ নিয়ে ব্যবসায়ী মহলের আপত্তি অবশ্য বরাবরই ছিল। নতুন আইন অনুযায়ী, সবরকম পণ্য ও সেবার ক্ষেত্রে ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা হবে। ব্যবসায়ীরা এর বিরোধিতা করে বলছেন, দেশের ৮৫ শতাংশ ব্যবসায়ীর পক্ষে উপকরণ রেয়াত নেয়া সম্ভব নয়। এর জন্য সবক্ষেত্রে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট অযৌক্তিক। বরং অর্থনৈতিক বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে ১৫ শতাংশের পরিবর্তে হ্রাসকৃত হারে বাস্তবায়ন করতে হবে। ব্যবসায়ীরা অবশ্য শুরু থেকেই এই দাবি জানিয়ে আসছেন। তাদের আপত্তির কারণে সরকার দু’বছর আগে একটি কমিটি গঠন করে। উক্ত কমিটির সুপারিশেও বাংলাদেশের বাস্তবতায় হ্রাসকৃত হারে ভ্যাট আদায়ের পক্ষে সুপারিশ করা হয়েছে। একই সঙ্গে বলা হয়েছে প্যাকেজ প্রথায় ভ্যাট আদায় করার জন্য। অবশ্য এ সম্পর্কিত চূড়ান্ত সিদ্ধান্তটি আসতে হবে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে। কেননা এ বিষয়ে এফবিসিসিআইয়ের পক্ষ থেকে চিঠি দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চাওয়া হয়েছে।
উপরোক্ত দুটো বিষয় কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। বরং প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই লক্ষ্য করা যাচ্ছে পেশীশক্তি, সংঘশক্তির প্রাধান্য ও আধিপত্য। দেশে আইন আছে। আইন মানার জন্য বিচারালয়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ বিভিন্ন সংস্থা আছে। আবার আইন ভাঙার প্রবণতাও আছে পদে পদে। রাজধানীতে ট্রাফিক সিগন্যাল না মানার প্রবণতা পরিলক্ষিত হয় প্রায় অনেক ক্ষেত্রে। পথচারীরা প্রায়ই পথচারী সেতু বা ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার করেন না। শুধু সাধারণ যানবাহন নয়, মন্ত্রীর গাড়ি পর্যন্ত চলে রংসাইড দিয়ে। মাত্রাতিরিক্ত যাত্রী বোঝাই লঞ্চ-ট্রেন-বাস-স্টিমার চলা প্রায় নিত্যদিনের ঘটনা। বছরের পর বছর ঝুলিয়ে রেখে প্রকল্পের মেয়াদ ও ব্যয় বাড়ানোর চিত্র চোখে পড়ে খোদ রাজধানীতেই। যানবাহনে ও পণ্য পরিবহনে পুলিশ এবং মস্তানের চাঁদাবাজি চলে একই সমান্তরালে। ঢাকার চারপাশের নদ-নদী বালু, তুরাগ, বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা ভয়ঙ্কর দূষিত হয়ে পড়ে হাজারিবাগ ট্যানারিসহ মিল-কারখানার কঠিন ও তরল বর্জ্য মিশেছে, নদীর পাড় বেদখল হয়ে যায় ভূমিদস্যুদের আগ্রাসনে। রাজধানী বাঁচানোর অভিপ্রায়ে রাজউক তথা সরকার ড্যাপ প্রণয়ন করলেও তা চলে যায় হিমাগারে প্রভাবশালীদের চাপে। অন্যদিকে আবার সরকার তেলের দাম কমালেও যানবাহনের ভাড়া কমে না যাত্রীসাধারণ অসংগঠিত বলে। সংঘশক্তি না থাকায় অথবা দুর্বল বিধায় সমাজ ও রাষ্ট্রের সর্বত্রই যেন পরিলক্ষিত হচ্ছে কালোটাকা ও পেশীশক্তির আস্ফালন ও আধিপত্য। দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হলে, সুশাসন কায়েম করা সম্ভব হলে, সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে শুভবুদ্ধি ও চেতনা জাগ্রত হলে সংঘশক্তি প্রাধান্য পাবে, কালোটাকা ও পেশীশক্তি দুর্বল হবে। সর্বস্তরে গণতান্ত্রিক চেতনা ও ন্যায়প্রবণতা প্রতিষ্ঠিত হবে। সবার সম্মিলিত ঐক্য ও চেতনায় সংঘশক্তির বিকাশ সম্ভব।