ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সুকান্ত গুপ্ত

র বী ন্দ্র জ ন্ম বা ষির্ কী সন্ধ্যার মায়া

প্রকাশিত: ০৭:১৪, ১০ মে ২০১৬

র বী ন্দ্র  জ ন্ম বা ষির্ কী  সন্ধ্যার মায়া

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সন্ধ্যাসঙ্গীত হতে তাঁর প্রকৃত কাব্যজীবন শুরু করেন। এর কারণ এই নয়- সন্ধ্যাসঙ্গীত তাঁর পরিণত শক্তির রচনা। সন্ধ্যাসঙ্গীত এর পর আমরা পাই মানসী, সোনার তরীর মতো অতি পরিণত রচনা। সন্ধ্যাসংগীত রচনার কাল পূর্বজ কবিগণের অনুকরণ করে আসছিলেন- কবিতার ধরনে এবং ছন্দে। যা অবশ্য তৎকালীন কবিগুণের চিরায়ত প্রথা ছিল। বাংলা ১২৮৮ সালের গ্রীষ্মকালে রবীন্দ্রনাথ তাদের বাড়ির তৃতীয় তালার ছাদের ঘরগুলোতে একা থাকতেন। সেই সময়ে তিনি শ্লেটে স্বেচ্ছামত কবিতা লিখতে আরম্ভ করেন, এক-দুইটি কবিতা লেখার পর তিনি নিজের কাব্য প্রতিভার স্বতন্ত্রতা উপলব্ধি করতে পারলেন। খেলার ছলে তিনি কাব্যের যে নতুন রূপ সৃষ্টি করেছিলেন তা তিনি নিজে দেখে আশ্চর্য হয়েছিলেন। তখনই বুঝেছিলেন এ সৃষ্টি তাঁর একান্ত নিজস্ব। আদিকবি ব্রহ্মা যেমন নিজের মানস সৃষ্টি সরস্বতীকে দেখে অহোরূপম! অহোরূপম! ইতি প্রাত পুনঃ পুনঃ রবীন্দ্রনাথ ও তেমনি সেদিন নিজের স্বাধীন রচনা দেখে বিস্মিত ও আনন্দিত হয়েছিলেন। ঐ সময়ে কবির বয়স ১৯ বছর পূর্ণ। এ সম্পর্কে তিনি জীবনস্মৃতিতে লেখেছেন- ‘কিন্তু’ এমনি করিয়া দুটো একটা কবিতা লিখতেই মনের মধ্যে ভারি একটা আনন্দের আবেগ আসিল, আমার সমস্ত অন্তঃকরণ বলিয়া উঠিল বাঁচিয়া গেলাম। যাহা লিখিতেছি এ দেখিতেছি সম্পূর্ণ আমারই। এই স্বাধীনতার প্রথম আনন্দের বেগে ছন্দোবন্ধকে আমি একেবারেই খাতির করা ছাড়িয়া দিলাম।... আমার কাব্যলেখার ইতিহাসের মধ্যে এই সময়টাই আমার পক্ষে সকলের চেয়ে স্মরণীয়। কবি জীবনের ইতিহাস আলোচনা এমন স্থান হতে করতে হয় যেখানে তাকে অপসারিত অবস্থায় পাওয়া যায়। কবিতা যখন পরিণত হয়ে উঠল সে অন্য কথা। তখন তাকে বিশ্লেষণ করে শিল্পের ইন্দ্রজাল ভেঙ্গে ফেলে তার মূল উপাদান দেখার সুযোগ হয় না। কবির সন্ধ্যাসঙ্গীতের কিছু কবিতা কলিকাতার বাড়িতে ও কিছু কবিতা চন্দন নগরে গঙ্গার ধারে এক বাগান বাড়িতে লেখা। সন্ধ্যাসঙ্গীত রচনার পূর্বে কবি, কবি বিহার লাল চক্রবর্তী প্রভৃতির ভাব ভাষা ও ছন্দ অনুকরণ করে কবিতা রচনা করেছিলেন। সন্ধ্যাসঙ্গীতের কবিতায় তিনি প্রথম সেই অনুকরণ বন্ধন ছেদ করে নিজের ইচ্ছায় অনুরূপ ছন্দ ও স্বকীয় ভাব অবলম্বন করেন। কবি বাল্যকালে বাড়ির মধ্যে নিতান্ত বন্দী অবস্থায় থাকতেন। এতে বাইরের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ স্থাপন করতে না পেরে নিজের মধ্যে আবিষ্ট হয়েছিলেন এবং একে তিনি হৃদয় অরণ্য বলে নির্দেশ করেছেন। এ সম্বন্ধে কবি কীটস্ বলেন- ‘‘ঞযব পরহধমরহধঃরড়হ ড়ভ ধ নড়ু রং যবধষঃযু ধহফ ঃযব হধঃঁৎব রসধমরহধঃরড়হ ড়ভ ধ সধহ রং যবধষঃযু নঁঃ ঃযবৎব রং ধ ংঢ়ধপব ড়ভ ষরভব নবঃবিবহ রহ যিরপয ঃযব ংড়ঁষ রং রহ ভবৎসবহঃ, ঃযব পযধৎধপঃবৎ ঁহফবপরফবফ ঃযব ধসনরঃরড়হ ঃযরপশ ংরমযঃবফ.’’- কবধঃং, চবৎভধপব ঃড় ঊফুসরড়হ. “ সন্ধ্যাসঙ্গীতের কবিতায় যেমন বাল্যকালের হর্ষময়তা আছে তেমনি আছে বিষাদের সুরও। সেই বিষাদের সুর প্রকাশ করেছে সন্ধ্যা, আত্মহারা, আশার নৈরাশ্য পরিত্যক্ত, দুঃখ আবাহন, হলাহল, পরাজয় সংগীত ইত্যাদি। আমাদের মনে অবস্থা বিশেষে আবেগ কাজ করে যা অব্যক্তের বেদনা যা অপরিস্ফুটতার ব্যাকুলতা। বাইরের সঙ্গে তার যখন অন্তরের সুর মেলে না সামঞ্জস্য যখন সুন্দর ও সম্পূর্ণ হয়ে উঠে না। তখন সেই অন্তর নিবাসীর পীড়ার বেদনায় মানস প্রকৃতি ব্যথিত হতে থাকে সন্ধ্যাসঙ্গীতে বিশ্বের সঙ্গে যোগের জন্যে অবরুদ্ধ অবস্থার অধীরতা প্রকাশ পেয়েছে। এই সম্পর্কে কবি বলেছেন- পাগল হইয়া বনে বনে ফিরি, আপন গন্ধে মম বস্তরী মৃগ সম। উৎসর্গ এখানে কবিতার ছন্দ এলোমেলো ভাব ভাষা পরিস্ফুট না হতে পারে কিন্তু এর মধ্যে কবির আত্মশক্তি আবিষ্কারের ও আত্মপ্রত্যয় লাভের মূল্য অবহেলা করার মতো নয়। মানুষের সঙ্গে বাইরের যোগ স্থাপন করে বিশ্ব প্রকৃতি ও মানব প্রকৃতি। এই দুইয়ের যোগ স্থাপনের জন্য কবি আকুল। তাঁর চক্ষুর সামনে বিশ্বপ্রকৃতি খেলা করছে কিন্তু তার মধ্যে কবি নিজেকে মিলাতে পারছেন না। সন্ধ্যা কবিতাটি সম্ভবত ১২৮৮ সালে বিরচিত। কবি সন্ধ্যাকে সম্বোধন করে বলেছেন যে, আমি যখন তোমার কাছে এসে বসি আমি তখন শিশু জগৎকে ঘুম পাড়াবার গান আমি শুনতে পাই কিন্তু তার অর্থ উপলব্ধি করতে পারি না। বুঝ গো সন্ধ্যার কাছে শিখেছে সন্ধ্যার মায়া এই আঁখি দুটি চাহিলে হৃদয়পানে মরমেতে পড়ে ছায়া তারা উঠে ফুটি। আগে কে জানিত বলো কত কী লুকানো ছিল হৃদয় নিভৃতে তোমার নয়ন দিয়া আমার নিজের হিয়া পাইনু দেখিতে।
×