ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মুনতাসীর মামুন

উদ্ভট উটের পিঠে কি চলেছে স্বদেশ?

প্রকাশিত: ০৪:২৩, ১০ মে ২০১৬

উদ্ভট উটের পিঠে কি চলেছে স্বদেশ?

(গতকালের পর) তাদের প্রকাশ্য গণ-দলের পরিচিতি দিতে চেয়েছিলেন এই পাকিস্তানীমনা সামরিক স্বৈরশাসক যাতে তারা রাষ্ট্রে রেসপেকটিবিলিটি পায়। বিএনপি নেতারা এবং জিয়া এ্যাপোলজিস্টরা দুটি কথা বলেনÑ জিয়া বহুদলীয় গণতন্ত্র কায়েম করেছিলেন এবং তিনি বঙ্গবন্ধুকে সম্মান করতেন। মাই ফুট। জিয়া পারমিট বা লাইসেন্সবাজির ‘গণতন্ত্র’ প্রবর্তন করতে চেয়েছিলেন। কেননা এছাড়া তার উপায় ছিল না। যদি তিনি গণতন্ত্রের মানসপুত্র হতেন তাহলে তখনই বলতেন, অবাধ নির্বাচন হবে এবং যেসব দল ১৯৭২ সালে স্বীকৃত ছিল তারা রাজনীতি শুরু করতে পারবে। অনেকে এখন ভুলে গেছেন, গণতন্ত্রের লাইসেন্সের জন্য যখন আওয়ামী লীগ প্রথম দরখাস্ত করে তখন এই পাকিস্তানী বশংবদ জেনারেল তা নাকচ করে দিয়েছিলেন, কারণ তাতে ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দটি লেখা ছিল। যাক সেসব প্রসঙ্গ। জিয়া ও পাকিস্তানের আরেক তাবেদার এরশাদ নামের লে. জেনারেল একই কাজ করেছিলেন। আপনাদের ভা-ারে যত গালিগালাজ আছে, তা দিলেও এ ধরনের ক্ষমতা দখলকারীদের জন্য তা যথেষ্ট নয়। এরপর খালেদা জিয়া আসেন গোলাম আযমের সমর্থনে। মাঝখানে আওয়ামী লীগের কিছুদিন ডিফেনসিভ ব্যাটিং। তারপর খালেদা-নিজামীর ছক্কা মারার বছর। এই বিশাল সময় বাংলাদেশবিরোধী মনোভাব মনোজগতে তারা ছড়িয়ে দিতে পেরেছে দৃঢ়ভাবে। মাদ্রাসা শিক্ষা এতে বড় ভূমিকা রেখেছিল। এবং এখনও রাখছে। জিয়া ও এরশাদ সব সময় শেখ হাসিনা বা আওয়ামী লীগকে নাজেহাল করতে চেয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর প্রতি জিয়াউর রহমানের দৃষ্টিভঙ্গি কী ছিল তার বিবরণ পাওয়া যায় প্রাক্তন সচিব বোরহান আহমদের লেখায়। তিনি লিখেছেন, বঙ্গবন্ধুর প্রতি জিয়া বিদ্বেষ পোষণ করতেন, তার একটি উদাহরণ হলো বঙ্গবন্ধুর ছবি বঙ্গভবনের স্টোররুমে প্রেরণ। এরশাদ ক্ষমতায় এসে সেনাবাহিনীর অফিসারদের উদ্দেশে বলেছিলেনÑ ‘ডব রিষষ ংঃধু রহ ঢ়ড়বিৎ ভড়ৎ ধনড়ঁঃ ঃড়ি ুবধৎং ধহফ ঃযবহ যধহফড়াবৎ চড়বিৎ ঃড় ধ ঢ়ড়ষরঃরপধষ ঢ়ধৎঃু নঁঃ ড়নারড়ঁংষু হড়ঃ ঃড় অধিসর ষবধমঁব ধহফ অধিসর ষবধমধব রিষষ ফবংঃৎড়ু ঃযব অৎসবফ ঋড়ৎপবং.’ জাতীয় পার্টির সঙ্গে দহরম মহরম করলেও যে এই ভাঁড়টিকে ক্ষমতার অংশীদার করা হয়নি তার জন্য প্রধানমন্ত্রী ধন্যবাদ পেতে পারেন। এই দৃষ্টিভঙ্গি জাতীয় পার্টি, বিএনপি-জামায়াত নেতাদের মধ্যে বহমান। শেখ হাসিনাকে বারবার হত্যার চেষ্টা তার উদাহরণ। ষড়যন্ত্র যে জোরদার তার সর্বশেষ উদাহরণ সিঙ্গাপুরে বাঙালী শ্রমিকদের ষড়যন্ত্র। এই অভিজ্ঞতা কর্তব্য নির্দেশ করে। সেই কর্তব্য কতটুকু পালিত হচ্ছে বা হবে কিনা, এবং তার প্রতিক্রিয়া কত মারাত্মক হচ্ছে সে বিষয়েই পরবর্তী অধ্যায়ে আলোচনা করব। ॥ পাঁচ ॥ বাইরে থেকে অনেক কথা বলা যায়, আবেগী হওয়া যায়, সেটি সত্য। ব্যক্তিগতভাবে চিন্তা করে দেখুন, নিজ পরিবার চালাতেই কত ব্যতিব্যস্ত থাকতে হয়। তাহলে যিনি একটি দেশ চালান তার কী অবস্থা! দেশের অভ্যন্তরে জামায়াত-বিএনপি জঙ্গী বা হেজাবি ষড়যন্ত্র ক্ষমতা দখলের, দেশে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির চেষ্টা, দলে বিশৃঙ্খলা, আন্তর্জাতিক চাপ বিশেষ করে আমেরিকার, তার ওপর দেশের উন্নয়নÑ সবকিছুতে যাকে নজর রাখতে হয়, এবং ভোটের রাজনীতি করতে হয়, তাকে অনেক বিষয়ে সমঝোতা করতে হয়, ছাড় দিতে হয়। সেটি না বোঝার কোন কারণ নেই। কিন্তু, ছাড় কতটুকু দিতে হবে, সমঝোতা কোন পর্যায় পর্যন্ত হবে? এ বিষয়টিই উদাহরণ দিয়ে দেখনো যাক। দেশের মানুষ ইসলামের কিছু হলে মার মার করে ওঠে। আওয়ামী লীগেও ইসলাম রক্ষার জন্য মারমুখী গ্রুপ আছে। তখনও ছিল। ১৯৭২ সালের সংবিধান রচিত হলে, আওয়ামী লীগ সদস্যরাই প্রস্তাব করেছিলেন ‘পরম করুণাময় আল্লাহ’র নাম সংবিধানের ওপরে রাখতে। বঙ্গবন্ধু সেটি রাখেননি। এবং মনেও করেননি ইসলাম বিপন্ন হবে। অর্থাৎ তিনি ছাড় দেননি। তখনও তাকে যারা ভোট দিয়েছিলেন তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান ছিলেন। শেখ হাসিনা চার মূলনীতি ফেরত এনেছেন। কিন্তু ইসলাম রাষ্ট্রধর্ম রেখে দিয়েছেন। আমরা বুঝতে পারি, বাস্তব অবস্থায় তিনি এখন তা সরাতে পারবেন না। সেটি আমরা মেনেও নিয়েছি যদিও সাংবিধানিক দিক থেকে বিষয়টি সাংঘর্ষিক। কিন্তু, হেফাজত দমনের পর থেকে মনে হলো ভোটের বিষয়টি বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে এবং ছাড় বেশি দেয়া হচ্ছে। মুক্তমনা বা ‘ব্লগার’দের কেউ খুন হলেই নীতিনির্ধারক পর্যায় থেকে মুক্তমনাদের সাবধান করে দেয়া হয় তারা যেন ধর্মকে গালাগাল না করেন। এর সঙ্গে আমি একমত। কিন্তু ধর্ম নিয়ে আলোচনা মাত্রই খারাপ এটি তো হতে পারে না। ইসলামে ‘ইজতেহাদ’ ও ‘তকলিছ’ নিয়ে দ্বন্দ্ব চলছে হাজার বছর ধরে। আব্বাসীয় যুগের প্রথম দিকে ‘ইজতেহাদ’ প্রাধান্য পাওয়ায় ওই সময় শিক্ষা-সংস্কৃতি বিকশিত হয়। ইসলামী ইতিহাসে একমাত্র স্বর্ণযুগ সে আমলই। তারপর ইমাম গাজ্জালী প্রমুখের আবির্ভাব ও তকলিছের প্রভাব পড়ায় সেই ‘স্বর্ণযুগ’ ম্লান হতে থাকে এবং এক সময় তা অপসৃত হয় ও তার জায়গায় খুনোখুনি প্রাধান্য পায়। প্রত্যেক শাসকই ‘ইসলাম রক্ষা’র নামে নেমে পড়েন। ধরে নেয়া যাক [যা সত্য নয়] মুক্তমনারা ধর্মবিদ্বেষী বা ধর্মের অবমাননা করেন। তা’হলে প্রশ্নÑ এর বিপরীতে জামায়াতীরা যা করছে তা কি ধর্মের উন্নয়ন? তারাই তো খুনের ইসলামের প্ররোচনা দিচ্ছে। কিন্তু, তাদের সম্পর্কে একটি বাক্যও উচ্চারণ করা হয় না। নীতিনির্ধারকদের বক্তৃতার পরও পুলিশ কমিশনার একই বক্তব্য দেন। এই যে ভঙ্গিটা, এটা যারা খুন করে তাদের উৎসাহিত করে এবং জনমানসে এই ধারণা হয় যে, যারা মুক্তবুদ্ধির চর্চা করে, প্রগতির কথা বলে তারা ধর্মবিদ্বেষী। হেজাবিদের ভাষায় ‘নাস্তিক’। জঙ্গীরা সরকারের এই মনোভাবের কারণে খুনোখুনির বিষয়টা ‘নাস্তিক-আস্তিকের’ লড়াইয়ে নামিয়ে এনেছে। ব্যাপারটা কী ভয়ানক কেউ চিন্তা করছেন না। যার মৃত্যু হয়, তার পরিবারকে বারবার বলতে হয়, ভিকটিম নাস্তিক ছিলেন না, আস্তিক ছিলেন। এ কেমন বিচার! ধর্মে কি নাস্তিকদের বিদেয় করে দেয়া হয়েছে, তা তো নয়। এখানে মূল লক্ষ্যটি হচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সবাইকে ধীরে ধীরে ‘নাস্তিকে’ পরিণত করা এবং খুনীরা যে ইসলাম রক্ষা করতে পারবে এবং খুন করা জায়েজ করা। ছোট একটি বিষয় মনে হতে পারে, কিন্তু ইমপ্লিকেশনটা দেখুন। আর যারা খুন হচ্ছে সবাই কি ধর্মের সমালোচনা করছেন? ধর্মের নামে কুসংস্কার তো অবশ্যই বর্জনীয়। তা উল্লেখ করলে ধর্মবিরোধী হবে কেন? ক্রসফায়ারের অর্থ কী আমরা জানি। ক্রসফায়ারে অনেকেই বিদ্ধ হন। তার অর্থ এ নয় যে, আমরা ক্রসফায়ারের সমর্থক। বিষয়টি ভিন্ন। জঙ্গীদের ধরা হয়, তারপর তারা জামিনে বেরিয়ে যাওয়ার সুযোগ পায়। (চলবে)
×