ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

জাফর ওয়াজেদ

রবীন্দ্রবিরোধিতা নস্যাতে বঙ্গবন্ধু

প্রকাশিত: ০৪:২২, ১০ মে ২০১৬

রবীন্দ্রবিরোধিতা নস্যাতে বঙ্গবন্ধু

বঙ্গবন্ধু ও রবীন্দ্রনাথ বাঙালী জাতি ও জাতিসত্তার বিকাশে নিরলস শ্রম দিয়েছেন। বাঙালীর ইচ্ছা, আকাক্সক্ষা, স্বপ্ন, সাধ পূরণে এগিয়ে এসেছিলেন স্ব-স্ব মহিমায় আলোক শিখা প্রজ্বলিত করে। দুই সময়ের দুই মহামানব বাংলাদেশের অন্তরের মধ্যে পূর্ণ জাগরণ সঞ্চারিত করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ যে দেশনায়কের স্বপ্ন দেখেছিলেন নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর মধ্যে, তা ক্রম প্রসারিত হয়ে রবীন্দ্রভাবনার দেশনায়কে পরিণত করেছিল শেখ মুজিবকে। নেতাজী সংবর্ধনা সভায় ১৯৩৮ সালের জানুয়ারিতে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘বহুকাল পূর্বে আর এক সভায় আমি বাঙালী সমাজের অনাগত অধিনায়কের উদ্দেশে বাণীদূত পাঠিয়েছিলুম। তার বহু বছর পরে আজ আর এক অবকাশে বাংলাদেশের অধিনেতাকে প্রত্যক্ষ বরণ করছি।.... দেশের দুঃখকে তুমি তোমার আপন দুঃখ করেছ, দেশের সার্থক মুক্তি অগ্রসর হয়ে আসছে তোমার চরম পুরস্কার বহন করে।’ একই সভায় এমনটাও বলেছেন, ‘একজনের কেন্দ্র কর্ষণে দেশের সকল লোকে এক হতে পারলে তবেই হবে অসাধ্যসাধন। যাঁরা দেশের যথার্থ স্বাভাবিক প্রতিনিধি তাঁরা কখনই একলা নন। তাঁরা সর্বজনীন, সর্বকালে তাঁদের অধিকার। তারা বর্তমানের গিরিচূড়ায় দাঁড়িয়ে ভবিষ্যতের প্রথম সূর্যোদয়ের অরুণাভাসকে প্রথম প্রণতির অর্ঘ্যদান করেন।’ নেতাজী থেকে সেই অরুণাভাস শেখ মুজিবে উন্নীত হওয়ার পর বাঙালী একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের অধিকারী হতে পেরেছে। রবীন্দ্রনাথ সেই কবি, যিনি ছিলেন দূরদর্শী। ভাবীকালকে তিনি দেখতে পেতেন বর্তমান কালের প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে। বলেছেনও তাই নেতাজীর উদ্দেশে, ‘দুর্গতির জালে রাষ্ট্র যখন জড়িত হয়, তখনই পীড়িত দেশের অন্তর্বেদনার প্রেরণায় আবির্ভূত হয় দেশের অধিনায়ক।’ রবীন্দ্রভাবনার সেই অধিনায়ক হিসেবে তেত্রিশ বছর পর শেখ মুজিব পাদ প্রদীপের আলোয় দাঁড়িয়ে বাঙালী জাতির স্থপতি থেকে জাতির পিতায় পরিণত হয়েছিলেন। নেতাজীর মধ্যে যে স্বপ্ন বাসনা তিনি অবলোকন করতে চেয়েছিলেন, তা শেখ মুজিবে এসে মূর্ত হয়ে উঠেছিল। ‘নানা কারণে আত্মীয় ও পরের হাতে বাংলাদেশ যত কিছু সুযোগ থেকে বঞ্চিত, ভাগ্যের সেই বিড়ম্বনাকে সে আপন পৌরুষের আকর্ষণে ভাগ্যের আশীর্বাদে পরিণত করে তুলবেÑ এই চাই। আপাত পরাভবকে অস্বীকার করায় যে বল জাগ্রত হয়, সেই স্পর্ধিত বলই তাকে নিয়ে যাবে জয়ের পথে।’ রবীন্দ্রনাথের সেই আশা পূরণ হয়েছিল ১৯৭১ সালে শেখ মুজিবের শক্তিমত্তায়। রবীন্দ্রনাথের বাঙালী পূর্ণতা পেয়েছিল তাঁরই বলিষ্ঠ নেতৃত্বে। তাই দেখি, স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে পা রেখে বঙ্গবন্ধু প্রথম জনসমাবেশে রবীন্দ্রনাথের কবিতা তুলে ধরেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘সাত কোটি সন্তানেরে হে মুগ্ধ জননী/রেখেছ বাঙালী করে মানুষ করনি।’ এই কাব্যোচ্চারণ করে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘কবিগুরু, তুমি এসে দেখে যাও, তোমার বাঙালী আজ মানুষ হয়েছে।’ কি আত্মপ্রত্যয় আর স্পর্ধিত উচ্চারণ, তা কেবলই বঙ্গবন্ধুর পক্ষে সম্ভব। রবীন্দ্রনাথ যেমনটা চেয়েছিলেন, ‘দুঃসময়ে একান্তই চাই এমন আত্মপ্রতিষ্ঠা শক্তিমান পুরুষের দক্ষিণ হস্ত, যিনি জয়যাত্রার পথে প্রতিকূল ভাগ্যকে তেজের সঙ্গে উপেক্ষা করতে পারেন।’ আর তা পেরেছিলেন স্বয়ং বঙ্গবন্ধু। যাঁর অঙ্গুলি নির্দেশে একটি জাতি সশস্ত্র যুদ্ধে নেমে পড়েছিল। নেতাজী সুভাষ বসুর অসমাপ্ত যুদ্ধ সমাপ্ত হয়েছিল বলা যায়, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বেই। নেতাজীর প্রতি বাঙালীর শ্রদ্ধা, ভক্তির যে ভাবÑ শেখ মুজিব তা আত্মস্থ করতে পেরেছিলেন। প্রবল জীবনী শক্তির প্রমাণ রেখেছিলেন। এই শক্তির কঠিন পরীক্ষা হয়েছিল জেল-জুলুম, হুলিয়া, নির্যাতন-নিপীড়ন এবং মৃত্যু হুমকির আগ্রাসনে। যার কোন কিছুই তাঁকে হতোদ্যম করেনি। বাঙালির পারস্পারিক বিরোধের সমাধান হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর মাধ্যমে। আত্মসংশয়ের নিরসন হয়েছিল তাঁরই মাধ্যমে। হীনতা ও দীনতা ধিক্কৃত হয়েছিল তাঁরই আদর্শে। বাঙালী অদৃষ্ট কর্তৃক অপমানিত হয়ে মরবে না, এই আশাতে পুরো দেশ জাগিয়ে তুলেছিলেন বঙ্গবন্ধু। তাই ‘সাংঘাতিক মার খেয়েও বাঙালী মারের উপরে মাথা তুলবে’ বলে রবীন্দ্রনাথ যে আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলেন, শেখ মুজিবের নেতৃত্বে দুর্নিবার শক্তিতে বাঙালী একাত্তরে গর্জে উঠেছিল দীপ্ত তারুণ্যে। রবীন্দ্রনাথের আশাবাদী চিন্তাকে মূর্ত করেছিলেন বঙ্গবন্ধু স্বয়ং। ‘দেশের পুরনো জীর্ণতাকে দূর করে তামসিকতার আবরণ থেকে মুক্ত করে নববসন্তে তার নতুন প্রাণকে কিশলয়িত করার সৃষ্টি কর্তৃত্ব’ গ্রহণ করেছিলেন বঙ্গবন্ধুই। নতুন যুগের উদ্বোধনের ভার বিধাতা শেখ মুজিবের ওপরই অর্পণ করেছিলেন এবং তা রবীন্দ্র প্রেরণাজাত করে। বাঙালীর স্বভাবে যা কিছু শ্রেষ্ঠ, তার সরলতা, তার কল্পনাবৃত্তি, নতুনকে চিনে নেয়ার উজ্জ্বল দৃষ্টি, রূপসৃষ্টির নৈপুণ্য, অপরিচিত সংস্কৃতির দানকে গ্রহণ করার সহজ শক্তি, এই সকল ক্ষমতাকে ভাবের পথ থেকে কাজের পথে প্রবৃত্ত করতে পেরেছিলেন রবীন্দ্র গুণমুগ্ধ শেখ মুজিব। আর এই মুজিবের হাত ধরে রবীন্দ্রনাথ এসেছিলেন তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ কর্মস্থান হিসেবে পরিচিত পূর্ব বাংলায়। পাকিস্তান যুগে যেখানে তাঁর প্রবেশাধিকারকে সঙ্কুচিত এবং বিজাতীয় বলে অবজ্ঞা করা হয়েছিল। নিষিদ্ধতার ঘেরাটোপে রবীন্দ্রনাথ ওপার হতে কুণ্ঠিত হয়েছিলেন নিশ্চয় সেদিন। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশের অধীনতা থেকে মুক্ত হয়ে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলের মানুষ স্বাধীনতার আনন্দে উদ্বেল হয়েছিল। সে সময় প্রশ্ন দেখা দিয়েছিল, ভাষা-সংস্কৃতির দিক দিয়ে ‘বাঙালী’ পরিচয় থাকবে নাকি পাকিস্তানী হবে? ১৯৪৮ থেকে আত্মপরিচয় নিয়ে দ্বন্দ্ব প্রকটিত হতে থাকে। প্রদেশের নাম পূর্ববঙ্গ বহাল থাকলেও বঙ্গভাষার ব্যবহার রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে অস্বীকৃত হলো। ফলে বাঙালী তার অস্তিত্ব সম্পর্কে সন্দিহান হয়ে ওঠে। দেশের সাধারণ মানুষও সেই সংশয় থেকে মুক্ত হয়নি। তাদের মধ্যে জাতিসত্তার স্বরূপ অনুসন্ধান শুরু হলো। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন এবং রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা স্বীকৃতি পাওয়ার পর পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী শঙ্কিত ও সাবধানী হয়ে ওঠে। পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে পূর্ববাংলার সাংস্কৃতিক মিল ভাঙ্গার উদ্দেশ্যে নানা ছক কাটা শুরু করে। স্কুলের পাঠ্যবইগুলোয় বিশেষ বদল হতে লাগল। রবীন্দ্রনাথের লেখা গেল কমে। ‘উড়াও উড়াও কওমী নিশান’, ‘ভাঙ্গিল জিন্দান টুটিল জিঞ্জির’, ‘কলিজানের খুনে ওয়াতানের ধূলি, ‘আরব ইরান তুর্কী মিসর, কণ্ঠে আমার পায় খুঁজে স্বর’ ইত্যাদি কাব্যের বিস্তার ঘটতে থাকে। বাংলাভাষাকে বিকৃত করা শুরু হয়। বাঙালী শিক্ষিতজনদের আশরাফ ভাবাপন্নরা রবীন্দ্রনাথের চেয়ে পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় সংহতি অধিক প্রয়োজনীয় বলে রব তুলতে থাকেন। বাংলাভাষী মুসলমানকে বাঙালী বলতেও কুণ্ঠাবোধ হতো তাদের। সৈয়দ আলী আহসান তো লিখলেনই ‘মনে রাখতে হবে যে, পাকিস্তান সৃষ্টি হয়েছিল স্বাতন্ত্র্যবোধের ওপর ভিত্তি করে। এই স্বাতন্ত্র্যবোধের পরিচয় মিলবে আমাদের সাহিত্যে ও কাব্যে। ... নতুন রাষ্ট্রের স্থিতি প্রয়োজনে আমরা আমাদের সাহিত্যে নতুন জীবন ও ভাবধারার প্রকাশ খুঁজব। সেই সঙ্গে এটাও সত্য যে, আমাদের সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখার এবং হয়তবা জাতীয় সংহতির জন্য যদি প্রয়োজন হয়, আমরা রবীন্দ্রনাথকেও অস্বীকার করতে প্রস্তুত রয়েছি। সাহিত্যের চাইতে রাষ্ট্রীয় সংহতির প্রয়োজন আমাদের বেশি।’ সংবাদপত্রেও রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে তুমুল বাদবিসংবাদ শুরু হয়। পক্ষে-বিপক্ষে নানা যুক্তির অবতারণা পাঠকের মানসিকতায় অবশ্য রবীন্দ্রনাথই জারিত হয়েছেন। রবীন্দ্রবিরোধীরা সাহিত্য সম্মেলন করে রবীন্দ্রচর্চা ও পাঠকে নিষিদ্ধের পর্যায়ে নিয়ে যেতে তখন উদগ্রীব। এদের অনেকে পরে রবীন্দ্র অনুগতও হয়েছেন। গ্রন্থও লিখেছেন। মুক্তচিন্তার সাহিত্যিকরা বাঙালী সাহিত্য-সংস্কৃতি বিরোধীদের বিপক্ষে আন্দোলন শুরু করে পাকিস্তান সাহিত্য সংসদের ব্যানারে। রবীন্দ্রনাথের গান তখন কোথাও কোথাও গাওয়া শুরু হয়। বাঙালীর রবীন্দ্রনাথকে পাওয়ার কাজটি শুরু হয় পঞ্চাশের দশকে। সত্তরের দশকে এসে তা ব্যাপ্তি লাভ করে। ষাটের দশক ছিল রবীন্দ্রনাথ থাকবেন কি থাকবেন না প্রশ্নের সংগ্রাম। ১৯৫৬ সালে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা থাকাকালে ঢাকায় আগত পাকিস্তানের বিরোধী নেতাদের সম্মানে এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন, তাতে রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিবেশন করা হয়। বঙ্গবন্ধুর বিশেষ অনুরোধে সান্জিদা খাতুন ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটির পুরোটাই গেয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর পাঠাভ্যাসে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন তাঁর গান, কবিতা, ছোটগল্প ও প্রবন্ধ নিয়ে। পূর্ববঙ্গবাসী এমনিতেই রবীন্দ্রনাথের গানকেই শীর্ষে ঠাঁই দিয়েছে। শেখ মুজিব নিজেও গুনগুন করে গাইতেন রবীন্দ্রনাথের গান। বঙ্গবন্ধুর জনসভায় রবীন্দ্রনাথের গানও পরিবেশিত হতো। বাঁধা গায়ক ছিলেন সুপুরুষ শিল্পী জাহিদুর রহিম। ১৯৬৩ সালে ‘ছায়ানট’ সঙ্গীত বিদ্যায়তন পত্তনের পর রবীন্দ্রসঙ্গীত সামগ্রিকভাবে বাঙালী সংস্কৃতি চর্চার বিস্তার ঘটতে থাকে। তার আগে ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষ পালনের মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথকে ধারণ করার ক্ষেত্রে সচেষ্ট হন শিক্ষিত বাঙালীর প্রগতিশীল। ততদিনে বঙ্গবন্ধু পূর্ববাংলার মানুষের অধিকার আদায়ের দাবিকে সামনে নিয়ে এসেছেন। সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বাঙালী সংস্কৃতির পক্ষে শেখ মুজিব তখন সোচ্চার। তাঁর ভাষণে রবীন্দ্রনাথের কবিতাও উদ্ধৃত হতে থাকে। ‘হে মোর দুর্ভাগা দেশ’ বলে ভরাট গলা, দরাজস্বরে বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে যখন আবৃত্তি করতেন, গুণমুগ্ধ শ্রোতারা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে তা শ্রবণ করত। ১৯৬৭ সালের ২৩ জুন পাকিস্তান সরকার রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রচারের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করল। পাকিস্তান সংসদে সে সময়ের তথ্যমন্ত্রী ঢাকার নবাববংশের খাজা শাহাবুদ্দিন বললেন, ‘রবীন্দ্রসঙ্গীত আমাদের সংস্কৃতির অঙ্গ নয়’। ক্ষোভ বিক্ষোভের কারণ হয়ে দাঁড়ায় তা বাংলাভাষীর জন্য। কারণ বাঙালী সংস্কৃতির ওপর এ যেন মারণাঘাত। রবীন্দ্রনাথ যে বাঙালীর অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ তা বাঙালীমাত্রই অবহিত। জন্ম শতবর্ষপূর্তি উপলক্ষে রবীন্দ্রনাথ এমনিতেই সাধারণের মধ্যে সর্বপ্রথম একটি জীবন্ত সত্তায় পরিণত হন। তখন থেকেই রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে একটি শক্তি পাকিস্তানী সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় বিতর্ক শুরু করে। সংবাদপত্রগুলোয় এর প্রকাশ দেখা যায়। এমনটিও পত্রিকায় লেখা হয় যে, ‘রবীন্দ্রনাথের দোহাই পাড়িয়া অখ- বাংলার আড়ালে আমাদের তমদ্দুনিক জীবনের বিপদ ডাকিয়া আনার সুযোগ দেয়া চলিবে না।’ ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের সময় রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রচার বন্ধ থাকে। ১৯৬৬ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা দাবির ঘোষণা পূর্ববঙ্গের স্বাধিকার আন্দোলনে রূপ নেয়। রাজনৈতিক আন্দোলনের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে উঠতে থাকে। ‘রেডিও ও টেলিভিশন থেকে পাকিস্তানবিরোধী রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রচার নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং ভবিষ্যতে রবীন্দ্রনাথের অন্য গানের প্রচারও হ্রাস করা হবে’Ñ খাজা শাহাবুদ্দিনের এ ঘোষণা প্রগতিশীল রাজনীতিক ও সংস্কৃতিমনাদের ক্ষুব্ধ করে। প্রতিবাদ সভা, বিবৃতি দান, পথসভা, মিছিল চলতে থাকে। তবে একই সময়ে রবীন্দ্রসঙ্গীত নিষিদ্ধের পক্ষে পাকিস্তানী শাসকের ঘোষণাকে প্রশংসিত করে ও রবীন্দ্রনাথের বিরোধিতা করে একদল কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, পেশাজীবী অপ তৎপরতা চালায়। আওয়ামী লীগ প্রতিবাদ জানিয়ে বলে ‘ক্ষমতাবলে হয়তো সাময়িকভাবে রেডিও ও টেলিভিশন হইতে রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রচার বন্ধ করা যাইতে পারে। কিন্তু গণচিত্ত হইতে রবীন্দ্রসঙ্গীতের সুমধুর আবেদনকে কোন কালেই মুছিয়া ফেলা যাইবে না।’ সংস্কৃতির ওপর এই সরকারী হামলাকে রোধ করার জন্য জনগণের কাছেও আবেদন জানায় আওয়ামী লীগ। সারাদেশেই রাজনীতিক থেকে বিভিন্ন পেশার মানুষ এই বিষয়ে কাছাকাছি আসার ক্ষেত্র পায়। সরকারী নিষেধ ঘোষণার বিরোধিতা করে পরদিন ১৯ বুদ্ধিজীবী বিবৃতি দিয়েছিলেন। তাদের বক্তব্যের বিরোধিতা করে ও নিষেধাজ্ঞা বহাল রাখার কুযুক্তি দেখিয়ে যে পাঁচ অধ্যাপক বিবৃতি দেন, এরাই ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের পক্ষে দেশে-বিদেশে দূতিয়ালি, দালালি করেছে। কণ্ঠশিল্পীদের একটি অংশও নিষেধাজ্ঞার পক্ষে বিবৃতি দেন। যাদের একটা বড় অংশ একাত্তরে পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বন করেছিল। ১৯৬৭ সালের ১ জুলাই ‘পয়গাম’ পত্রিকায় প্রকাশিত তিরিশ মাওলানার বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়, ‘রবীন্দ্রনাথের বহু সঙ্গীত মুসলিম তমদ্দুনকে অবজ্ঞা প্রদর্শন করিয়া হিন্দু সংস্কৃতি (ও যৌন ভোগলালসার) জয়গান গাহিয়াছে। সুতরাং পাকিস্তান সৃষ্টির প্রথম দিন হইতেই এই সকল সঙ্গীতের আবর্জনা হইতে রেডিও-টেলিভিশনকে পবিত্র রাখার প্রয়োজন ছিল।’ রবীন্দ্রসঙ্গীত নিষিদ্ধের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠে বঙ্গবন্ধুর দল আওয়ামী লীগসহ ন্যাপ। শাসকগোষ্ঠী এক পর্যায়ে রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রচারের অনুমোদন দেয় রবীন্দ্রজয়ন্তীকে সামনে রেখে; তাও সীমিত সময়ে। ১৯৬৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সামরিক কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর রেসকোর্স ময়দানে এক বিরাট জনসভায় ভাষণ দেন বঙ্গবন্ধু। রবীন্দ্রনাথ প্রসঙ্গে বলেন, ‘আমরা মির্জা গালিব, সক্রেটিস, শেক্সপীয়ার; এরিস্টটল, দান্তে, লেনিন, মাও সেতুং পড়ি জ্ঞান আহরণের জন্য। আর দেউলিয়া সরকার আমাদের পাঠ নিষিদ্ধ করিয়া দিয়াছেন রবীন্দ্রনাথের লেখা; যিনি একজন বাঙালী কবি এবং বাংলায় কবিতা লিখিয়া যিনি বিশ্বকবি হইয়াছেন। আমরা এই ব্যবস্থা মানি নাÑ আমরা রবীন্দ্রনাথের বই পড়িবই, আমরা রবীন্দ্রসঙ্গীত গাহিবই এবং রবীন্দ্রসঙ্গীত এই দেশে গীত হইবেই।’ তিনি রেডিও-টেলিভিশনে রবীন্দ্রসঙ্গীতের ওপর থেকে সর্বপ্রকার বিধিনিষেধ প্রত্যাহার করে অবিলম্বে রেডিও-টিভিতে পর্যাপ্ত পরিমাণ রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রচারেরও দাবি জানান। বঙ্গবন্ধুর এই ঘোষণায় সারাদেশে সুপবন বইতে থাকে। এমনিতে গণঅভ্যুত্থানে আইয়ুবের পতন এবং আগরতলা মামলা থেকে মুক্তি পেয়ে বঙ্গবন্ধু তখন জনপ্রিয়তার শীর্ষে। তাঁর দাবিকে তাই কর্তৃপক্ষ অগ্রাহ্য করতে পারেনি। ১৯৬৯ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলা একাডেমিতে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পর এই প্রচারের সময় আরও বাড়ে। অনুষ্ঠানে পূর্ববাংলার শিল্পীদের গাওয়া একসেট রবীন্দ্রসঙ্গীতের গ্রামোফোন রেকর্ড উপহার দেয়া হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘রবীন্দ্রনাথ ছাড়া বাংলা ভাষা ও গান অসম্পূর্ণ।’ বঙ্গবন্ধুর হুঙ্কারে রবীন্দ্রনাথ ফিরে এলেও পাকিস্তানী সরকারের স্বীকৃতি কবি পাননি। তবে স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে তাঁর গান দেদীপ্যমান। বঙ্গবন্ধুর হাত ধরেই রবীন্দ্রনাথের পূর্ব বাংলায় আসা। রবীন্দ্রনাথ যে বাঙালীর অন্তরতর প্রাণসত্তা, বঙ্গবন্ধু তা বুঝেছিলেন। রবীন্দ্রনাথকে তিনি আত্মস্থ করেছিলেন তাঁর জীবন ও কর্মে। বঙ্গবন্ধুর সেই কথাটি মনে আসে, বলেছিলেন এক সাক্ষাতকারে স্বাধীনতার পর পরই, ‘‘আমার রবীন্দ্রপ্রীতি ছোটবেলা থেকেই। মনে আছে, আমি তখন স্কুলের নিচু ক্লাসে পড়ি। হঠাৎ একটি সাধারণ কবিতার অতি সাধারণ দুটি লাইন (যা পরবর্তীকালে বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে অনেক ক্ষেত্রে ব্যবহার করতেন) আমাকে মুগ্ধ করে দিয়েছিল- ‘তুমি মহারাজ সাধু হলে আজ, আমি আজ চোর বটে!’ গ্রামের ছেলে আমি, সাদামাটা লোক। মনে হলো, এত সাদামাটা কথায় বাস্তুহারা এক দুঃখী মানুষের কথা তো আর কেউ লেখেননি। আমি সেই প্রথম মানুষকে ভালোবাসতে শিখলাম। তাছাড়া রবীন্দ্রনাথের ওই যে লেখা- ‘নমঃ নমঃ নমঃ সুন্দরী মম জননী বঙ্গভূমি/গঙ্গার তীর স্নিগ্ধ সমীর জীবন জুড়ালে তুমি’Ñ পড়ার পরই আমি দেশকে ভালবাসতে শিখলাম। রবীন্দ্রনাথকে আমি ভালোবাসি তাঁর মানবপ্রেম ও দেশপ্রেমের জন্য। তারপর বড় হয়ে পড়লাম, ‘হে মোর দুর্ভাগা দেশ।’ আমাদের দেশের দুর্ভাগা মানুষের প্রতি এত দরদ আর কার আছে?’’ সাক্ষাতকারের শুরুতেই বলেছিলেন, ‘কবিগুরুই আমার সবচেয়ে প্রিয়।’ প্রশ্নকর্তা শুরুতেই বলেছিলেন, ‘আপনার রবীন্দ্রপ্রেমের কথা আমরা জেনেছি তাই আজ রাজনীতি নয়, আপনার সঙ্গে আলোচনা করব রবীন্দ্রনাথ নিয়ে।’ জবাবে বঙ্গবন্ধু তার রবীন্দ্রপ্রীতিকে তুলে ধরেছিলেন। অখ- গীতবিতান, সঞ্চয়িতা এবং সমগ্র রবীন্দ্র রচনাবলী কলকাতা থেকে নিয়ে এসে উপহার দেন বঙ্গবন্ধুকে সাক্ষাৎ প্রার্থীজন। উপহার পেয়ে খুশি বঙ্গবন্ধু কখনও খোলেন সঞ্চয়িতার পাতা, কখনও দেখেন রবীন্দ্রনাথের ছবি। একবার বলেন, ‘আচ্ছা, রবীন্দ্রনাথের এই চোখ দুটিতে কী আছে বলুন তো? দেখুন, দেখুন চেয়ে দেখুন, চোখ দুটিতে জ্বলজ্বল করছে মানুষের প্রতি ভালোবাসা। এ জন্যই তো তাঁকে আমি এত ভালোবাসি। আর এই সঞ্চয়িতা সঙ্গে থাকলে আমি আর কিছুই চাই না। নাটক নয়, উপন্যাস নয়, কবিগুরুর কবিতাই আমার সব সময়ের সঙ্গী ছিল। কবিতার পর কবিতা পড়তাম আর মুখস্থ করতাম। এখনও ভুলে যাইনি। এই প্রথম মিয়াঁওয়ালি জেলের ক’মাস সঞ্চয়িতা সঙ্গে ছিল না। বড় কষ্ট পেয়েছি। জানেন তো, আমার একটি প্রিয় গানকেই ‘আমার সোনার বাংলা’ আমি স্বাধীন দেশের জাতীয় সঙ্গীত করেছি। আর হ্যাঁ, আমার আর একটি প্রিয় গান ডিএল রায়ের ‘ধনধান্য পুষ্পভরা।’ দুটো গানই আমি গুনগুন করে গেয়ে থাকি।’ সাক্ষাতকালে শেখ হাসিনা বললেন, ‘আব্বা, মনে আছে তোমার, একটা বইÑ রবীন্দ্রনাথেরÑ তাতে সব জেলের ছাপ ছিল?’ শেখ সাহেব সঞ্চয়িতার পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে মুখ না তুলেই বললেন, মনে থাকবে না, ও বইখানা তো ওরা পোড়ায় দিছে।’ সাক্ষাতপ্রার্থী সিলেটে জন্ম ছড়াকার, সাংবাদিক, শান্তিনিকেতনের একদা ছাত্র অমিতাভ চৌধুরী। স্বাধীনতার পরই ১৯৭২ সালের মার্চ মাসে ঢাকায় এসেছিলেন। বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সঙ্গে সাক্ষাত করেছিলেন। লিখেছেন তিনি, “শেখ মুজিব রবীন্দ্রনাথকে কতটা ভালোবাসতেন, তার পরিচয় আমরা পেয়েছি গোড়া থেকেই। মনে আছে, ১৯৭১ সালে তিনি যখন পাকিস্তানের মিয়াঁওয়ালি জেলে বন্দী, তখন বার বার আবৃত্তি করতেন ‘নাই নাই ভয়, হবে হবে জয়, খুলে যাবে এই দ্বার।’ ১৯৭২ সালের ৯ জানুয়ারি তিনি যখন লন্ডনের হোটেলে, তাঁকে ফোন করেছিলাম (অমিতাভ তখন আনন্দবাজার পত্রিকার বার্তা সম্পাদক)। বঙ্গবন্ধুর মুখে ‘জয় বাংলা’ শব্দটা শুনে আমি শিহরিত হয়েছিলাম এবং তিনি যখন ওই টেলিফোনেই বলতে শুরু করলেন, ‘উদয়ের পথে শুনি কার বাণী, ভয় নাই ওরে ভয় নাই... তখন আমি বাকরুদ্ধ।’’ বঙ্গবন্ধুর সাহসী প্রত্যয় ও উচ্চারণের তোড়ে রবীন্দ্রনাথ এই বাংলায় এসেছিলেন হাজারো প্রতিবন্ধকতাকে ভেঙ্গে। বঙ্গবন্ধু ও রবীন্দ্রনাথ আজও অম্লান বাঙালীর জীবনে-দর্শনে।
×