ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

শাহরিয়ার কবির

তামসযাত্রার বিরুদ্ধে

প্রকাশিত: ০৬:২১, ৯ মে ২০১৬

তামসযাত্রার বিরুদ্ধে

২০১৬-এর এপ্রিলে জঙ্গী মৌলবাদী সন্ত্রাসীরা বাংলাদেশে পাঁচজনকে হত্যা করেছে। ৭ এপ্রিল হত্যা করা হয়েছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তরুণ ব্লগার নাজিমউদ্দিন সামাদকে। ২৩ এপ্রিল হত্যা করা হয়েছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রেজাউল করিম সিদ্দিকীকে। ২৫ এপ্রিল হত্যা করা হয়েছে মানবাধিকার কর্মী জুলহাজ মান্নান ও তরুণ নাট্যকর্মী মাহবুব তনয়কে। ৩০ এপ্রিল টাঙ্গাইলের গোপালপুরে একই কায়দায় হত্যা করা হয়েছে নিখিলচন্দ্র জোয়ারদারকে, মহানবীর বিরুদ্ধে ‘আপত্তিকর’ মন্তব্যের অজুহাতে। গত ১৪ মাসে ভিন্নমতাবলম্বী, ভিন্ন ধর্মাবলম্বী কিংবা মুক্তচিন্তার ৩৬ জনকে হত্যার দায় স্বীকার করেছে আইএস (ইসলামিক স্টেট) ও আল কায়দার অনুসারী স্বদেশী সন্ত্রাসীরাÑ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ভাষায় ‘হোমগ্রোন টেররিস্ট।’ তালিকা প্রস্তুত করে মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী মুক্তচিন্তার লেখক, শিল্পী ও সাংবাদিকসহ বিভিন্ন পেশার মানুষদের হত্যার সূচনা ’৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাৎসি নেতা হিটলার ও হিমলার যেভাবে ইহুদি, কমিউনিস্ট ও ভিন্নমতাবলম্বী বুদ্ধিজীবীদের হত্যার জন্য ‘এসএস’ (শুটয্স্টাফেন) নামক ঘাতক বাহিনী গঠন করেছিলেন একইভাবে নাৎসি দর্শনের একনিষ্ঠ ভক্ত জামায়াতে ইসলামীর গোলাম আযম ও নিজামীরা গঠন করেছিলেন ঘাতক ‘আলবদর’ বাহিনী। পাকিস্তানী সামরিক জান্তার জেনারেলদের সঙ্গে বসে তখন তারা দেশের শীর্ষস্থানীয় বুদ্ধিজীবী ও পেশাজীবীদের তালিকা প্রস্তুত করে একে একে হত্যা করেছেন। যে উদ্দেশ্যে জামায়াত ’৭১-এ ‘আলবদর’, ‘রাজাকার’ প্রভৃতি ঘাতকবাহিনী গঠন করেছিল একই উদ্দেশ্যে তারা শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে সূচিত জামায়াতবিরোধী নাগরিক আন্দোলন প্রতিহত করবার জন্য প্রথমে ‘হরকাতুল জিহাদ’ এবং পরে বিভিন্ন নামে গুপ্তঘাতক বাহিনী গঠন করেছে। জামায়াতের বিভিন্ন প্রকাশনা, গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও ওয়াজ মাহফিলে শহীদ জননী জাহানারা ইমামসহ তাঁর আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ নেতৃবৃন্দ এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারক বুদ্ধিজীবীদের নাম উল্লেখ করে তাদের ‘নাস্তিক’, ‘মুরতাদ’, ‘কাফের’, ‘ভারতের চর’, ‘ইসলামের দুষমন’ ইত্যাদি আখ্যা দিয়ে হত্যার জন্য দলীয় কর্মী ও সমর্থকদের উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। ১৯৯৯ সালে ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’র এককালীন সভাপতি এবং যুদ্ধাপরাধীদের দুষ্কর্ম অনুসন্ধানের জন্য কবি সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে গঠিত জাতীয় গণতদন্ত কমিশনের অন্যতম সদস্য, বরেণ্য কবি শামসুর রাহমানকে হত্যা চেষ্টা, এর পাঁচ বছর পর প্রথাবিরোধী লেখক ও ভাষাবিজ্ঞানী অধ্যাপক হুমায়ূন আজাদকে হত্যা, তৎকালীন বিরোধী দলের নেতা আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনাকে উপর্যুপরি হত্যা চেষ্টা, উদীচী ও ছায়ানটের সম্মেলন এবং বাংলা বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বোমা হামলা ও হত্যাকাণ্ড থেকে শুরু করে সাংবাদিক হত্যা, অধ্যাপক হত্যা, বিচারক ও আইনজীবী হত্যা, সংস্কৃতিকর্মী হত্যা, সংখ্যালঘু ধর্মীয় সম্প্রদায় ও আহমদিয়া মুসলিম হত্যাÑ সবই ছিল জামায়াতের বিভিন্ন ঘাতক বাহিনীর কাজ। জামায়াতের দর্শন ‘মওদুদীবাদ’ ’৭১-এর গণহত্যা ও বুদ্ধিজীবী হত্যা থেকে শুরু করে সাম্প্রতিককালের মুক্তচিন্তার ও ভিন্নমতের মানুষদের হত্যাকাণ্ডকে শুধু বৈধতা প্রদান নয়, অবশ্য কর্তব্য হিসেবে নির্দেশ করে। গত শতাব্দীর তিরিশের দশক থেকে মিসরের মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রতিষ্ঠাতা ও তাত্ত্বিক হাসান আল বান্না ও সাঈদ কুত্ব্ এবং দক্ষিণ এশিয়ায় জামায়াতে ইসলামীর প্রতিষ্ঠাতা তাত্ত্বিক আবুল আলা মওদুদী বিশুদ্ধ ইসলামী শরিয়াভিত্তিক যে সমাজ ও রাষ্ট্রগঠনের তত্ত্ব নির্মাণ করেছেন তার অনুপ্রেরণা ও দিকনির্দেশনা তারা পেয়েছেন সৌদি ইসলামী তাত্ত্বিক মোহাম্মদ ইবনে আবদাল ওয়াহাব (১৭০৩-১৭৯২ খ্রিস্টাব্দ), তাকিউদ্দিন আহমদ ইবনে তাইমিয়াহ (১২৬৩-১৩২৮ খ্রিস্টাব্দ) এবং আহমদ ইবনে হাম্বল (৭৮০-৮৫৫ খ্রিস্টাব্দ)-এর রক্ষণশীল রচনাবলী থেকে। বর্তমান যুগের আল কায়দা, তালেবান, বোকো হারাম বা আইএস-এর প্রতিষ্ঠাতারা হাসান আল বান্না, সাঈদ কুত্ব্ ও আবুল আলা মওদুদির মন্ত্রশিষ্য। এদের বাহ্যিক বিরোধ কখনও নীতিগত নয়Ñ সম্পূর্ণ কৌশলগত বা ব্যক্তিগত। দক্ষিণ এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য ও পশ্চিমের বহু গবেষক লিখেছেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ধনতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের স্নায়ুযুদ্ধকালে কিভাবে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও সমাজতান্ত্রিক শিবিরকে ঘায়েল করবার জন্য আমেরিকা মুসলিমপ্রধান বিভিন্ন দেশে ‘ওয়াহাবিবাদ’, ‘কুত্ব্বাদ’ ও ‘মওদুদিবাদ’-এর রাজনৈতিক ইসলাম এবং ইসলামের নামে সন্ত্রাসকে পৃষ্ঠপোষকতা করেছে। আমেরিকার প্রধান মিত্র সৌদি আরব এদের রচনাবলী বিভিন্ন আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ভাষায় অনুবাদ করে কোটি কোটি কপি সারাবিশ্বে প্রচার করেছে। ১৯৫০ সালেই আমেরিকা কামাল আতাতুর্কের কট্টর ধর্মনিরপেক্ষ তুরস্ককে বাধ্য করেছিল নিষিদ্ধ ঘোষিত ধর্মভিত্তিক রাজনীতি এবং ধর্মীয় সংগঠনকে অবাধে কাজ করার সুযোগ প্রদানের জন্য। ১৯৪৭ সালে দক্ষিণ এশিয়ায় ধর্মীয় দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তানের জন্ম হলেও এই রাষ্ট্রের জনক মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ধর্ম ও রাষ্ট্রকে পৃথক রাখতে চেয়েছিলেন। জিন্নাহর মৃত্যুর পর জামায়াতের আবুল আলা মওদুদি নিজেকে পাকিস্তানের অন্যতম জন্মদাতা দাবি করে অন্য সব মোল্লার সঙ্গে মুসলিম লীগকে দিয়ে ১৯৪৯ সালেই ‘অবজেকটিভ রেজলুশন’-এর মাধ্যমে ইসলাম ও পাকিস্তানকে এক করে ফেলেছিলেন, যা ঘটেছিল আমেরিকার অভিপ্রায় অনুযায়ী। ১৯৬৭ সালে সর্ববৃহৎ মুসলিমপ্রধান রাষ্ট্র ইন্দোনেশিয়ায় সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট সুকর্ণকে হটিয়ে জেনারেল সুহার্তো ক্ষমতায় এসে কমিউনিস্ট নিধনের নামে ভয়াবহ গণহত্যা করেছেন এবং রাজনৈতিক ইসলামকে মদদ দিয়েছেন আমেরিকার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী। ১৯৫৬ সালে মিসরে গামাল আবদেল নাসের ক্ষমতায় এসে জামায়াতে ইসলামীর জ্ঞাতিভাই ‘মুসলিম ব্রাদারহুড’-এর যাবতীয় কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে, পশ্চিমা ষড়যন্ত্রের মোকাবেলা করে, জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে আরব বিশ্বের মহানায়কের মর্যাদা অর্জন করেছিলেন। তার মৃত্যুর পর মিসরে আনোয়ার সাদাত ক্ষমতায় এসে আমেরিকার পরামর্শ অনুযায়ী মুসলিম ব্রাদারহুড এবং অন্যান্য ইসলামী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের কারাগার থেকে মুক্তি দিয়ে ‘দেশসেবার সুযোগ’ সৃষ্টি করেছিলেন। অথচ ‘ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি’র অজুহাতে এরাই তাকে হত্যা করেছিল এবং পরবর্তীকালে মিসরের ক্ষমতাও দখল করেছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ঘটাবার জন্য আমেরিকা মধ্য এশিয়ার মুসলিম প্রধান কাজাখস্তান, কিরঘিজস্তান, উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান তুর্কমেনিস্তান ও চেচনিয়ায় উগ্রপন্থী রাজনৈতিক ইসলামকে মদদ দিয়েছে। মধ্য এশিয়ায় একে একে জন্ম নিয়েছে ‘ইসলামিক রিবার্থ পার্টি’, ‘হিজবুল্লাহ’, ‘ইসলাম লশকরলার’, ‘ইসলামিক মুভমেন্ট অব উজবেকিস্তান’, ‘হিজবুত তাহরির’ প্রভৃতিÑ মূল লক্ষ্য ছিল সমাজতন্ত্র বা ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদী শক্তি যাতে এসব দেশে কখনও শিকড় গাড়তে না পারে। সোভিয়েত ইউনিয়নের কফিনে শেষ পেরেকটি আমেরিকা ঠুকেছিল আফগানিস্তানে সোভিয়েত সমর্থক ড. নজিবুল্লাহর সমাজতান্ত্রিক সরকারকে উৎখাত করার জন্য ‘আল কায়দা’ ও ‘তালেবান’দের পৃষ্ঠপোষকতা করে। মূলত পাকিস্তান ও সৌদি গোয়েন্দা সংস্থার সার্বিক সহযোগিতায় আমেরিকা ইসলামের নামে যেভাবে ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের দানব সৃষ্টি করেছে তার মাসুল এখন ইউরোপ ও আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের নিরীহ মানুষদের দিতে হচ্ছে। ২০০১ সালে নিউইয়র্কের টুইন টাওয়ার ধ্বংসের পর আমেরিকা ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের’ ঘোষণা দিয়ে যেভাবে আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ইরাক ও মধ্যপ্রাচ্যে সামরিক আধিপত্য বিস্তার করে ড্রোন হামলা চালাচ্ছে, উপদ্রুত এলাকার বিপর্যস্ত মানুষ মার্কিনবিরোধিতার অন্য কোন পথ খুঁজে না পেয়ে ক্রমশ আল কায়দা ও তালেবানদের প্রতি সহানুভূতিশীল হচ্ছে। আল কায়দা ও তালেবানদের গর্ভ থেকেই জন্ম হয়েছে ‘আইএস’-এর। ইরাকে আমেরিকা ‘আইএস’-এর বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান পরিচালনা করলেও সিরিয়ায় ক্ষমতাসীন ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়াবাদী ‘বাথ পার্টি’র আসাদ সরকারকে উৎখাতের জন্য আইএস ও আমেরিকা যুগপৎ লড়াই করছে। একইভাবে ‘আল কায়দা’ ও ‘আইসএস’ অনেক সময় জামায়াতে ইসলামীর সমালোচনা করে। কখনও ওয়াহাবিবাদী সালাফীরাও মুসলিম ব্রাদারহুডের সমালোচনা করে। আমেরিকার স্টেট ডিপার্টমেন্টসহ পশ্চিমা অনেক গবেষক এবং সন্ত্রাসবিষয়ক থিংক ট্যাংক কৌশলগত এসব বাহ্যিক বিরোধকে নীতিগত বিরোধ বিবেচনা করে ‘জামায়াতে ইসলামী’ ও ‘মুসলিম ব্রাদারহুড’কে ‘মডারেট’ ইসলামী দলের সনদ দিয়ে কেন ধূম্রজাল সৃষ্টি করে তারও উদ্দেশ্য আছে। বাংলাদেশে জঙ্গী মৌলবাদী সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘জিরো টলারেন্স’ বা ‘শূন্য সহিষ্ণুতার ঘোষণা দিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রশংসিত হয়েছেন। তিনি বহুবার বলেছেন জামায়াতে ইসলামী কোন রাজনৈতিক দল নয়, সন্ত্রাসী সংগঠন। জামায়াত যে যাবতীয় সন্ত্রাসের গডফাদার এবং মুক্তিযুদ্ধের যাবতীয় অর্জন ধ্বংস করে বাংলাদেশকে আবার পাকিস্তানের মতো মৌলবাদী, সাম্প্রদায়িক মনোলিথিক মুসলিম রাষ্ট্র বানাতে চায় এ কথা আমরা গত ২৪ বছর ধরে বলছি। ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পাশাপাশি বার বার জামায়াত-শিবিরচক্রের মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসী রাজনীতি নিষিদ্ধকরণের দাবি জানাচ্ছি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারক বাংলাদেশের মূল সংবিধানে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাঁর সহযোগীরাÑ যাঁরা মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছেন তাঁরা শুধু জামায়াত নয় ধর্মের নামে রাজনৈতিক দল গঠনও নিষিদ্ধ করেছিলেন। ১৯৭৫-এ বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর সহযোগীদের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জেনারেল জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে ধর্মের নামে রাজনীতির ওপর সাংবিধানিক নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে, সংবিধান থেকে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ ও ‘জাতীয়তাবাদ’ মুছে ফেলে, এর আরম্ভে ‘বিসমিল্লাহ...’ এবং ‘সর্বশক্তিমান আল্লাহ্-র ওপর পূর্ণ বিশ্বাসের কথা বলে বাংলাদেশের সমাজ ও রাজনীতির ‘পাকিস্তানীকরণ’ ও ‘ইসলামীকরণ’ প্রক্রিয়া আরম্ভ করে যে সর্বনাশ ডেকে এনেছিলেন তার মাসুল এখনও আমাদের দিতে হচ্ছে। সাবেক পূর্ব পাকিস্তানে মওদুদির জামায়াতে ইসলামী প্রতিষ্ঠা করেছিলেন মওলানা আবদুর রহিম। মুক্তিযুদ্ধোত্তর ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামী প্রতিষ্ঠা করেছেন জেনারেল জিয়াউর রহমানÑ বঙ্গবন্ধুকে হত্যা না করলে যা কখনও সম্ভব হতো না। জেনারেল জিয়া ও জেনারেল এরশাদ সম্পূর্ণ রাজনৈতিক মতলবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সংবিধানের ইসলামীকরণ করে ইসলাম ধর্মকেও কলঙ্কিত করেছেন। কোরানে এই ধরনের রাজনৈতিক বেশ্যাবৃত্তির অনুমোদন নেই। যে আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছে, ’৭২-এর অনন্যসাধারণ সংবিধান প্রণয়ন করেছে, সেই আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা যখন সুপ্রীমকোর্টের রায় অগ্রাহ্য করে অবৈধভাবে ক্ষমতাদখলকারী দুই সামরিক জেনারেল কৃত সংবিধানের মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক দুষ্কর্মের বৈধতা প্রদান করেন এই বলে যে, ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বাতিল’ কিংবা ‘জামায়াতে ইসলামী নিষিদ্ধকরণের’ কোন অভিপ্রায় তাদের নেই, তখন আশঙ্কা হয়Ñ বাংলাদেশের তামসযাত্রারও বুঝি কোন বিকল্প নেই। যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি এবং জামায়াত নিষিদ্ধকরণের দাবিতে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাজধানীর শাহবাগ চত্বরে যখন তরুণ ব্লগার ও ছাত্রজনতার মহাজাগরণ ঘটেছিল, তখন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ভাস্বর তারুণ্যের এই অভ্যুত্থানকে স্বাগত জানিয়েছিলেন। ভীতসন্ত্রস্ত জামায়াত তখন কওমি মাদ্রাসার শিক্ষক ছাত্রদের সংগঠন ‘হেফাজতে ইসলাম’কে মাঠে নামিয়েছে। হেফাজতপ্রধান আহমদ শফী মধ্য ফেব্রুয়ারিতেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে খোলা চিঠি লিখে আমাদের ‘নাস্তিক’, ‘মুরতাদ’, ‘কাফের’ আখ্যা দিয়ে আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন। ২০১৩-এর এপ্রিল ও মে মাসে আন্দোলনের নামে রাজধানীসহ সারাদেশে জামায়াত-বিএনপির মদদে হেফাজতীদের মহাতাণ্ডব ও সন্ত্রাস আমরা দেখেছি। ৪ মে বিএনপিপ্রধান সরকার উৎখাতের ৪৮ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দিয়েছিলেন। ৫ মে রাজধানীর প্রাণকেন্দ্রে হেফাজতের তাণ্ডবের আগুনে যখন বায়তুল মোকাররম মসজিদ পুড়ছিল, শত শত কোরান হাদিসের বই পুড়ছিলÑ খালেদা জিয়া হেফাজতীদের সমর্থনে ঢাকবাসীদের রাজপথে নেমে আসার আহ্বান জানিয়েছিলেন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের কঠোর হুঁশিয়ারি এবং আইন শৃঙ্খলাবাহিনীর সময়োচিত পদক্ষেপের কারণে শেখ হাসিনার মহাজোট সরকার কিভাবে অকালপতন থেকে রক্ষা পেয়েছিল সে বিষয়ে হেফাজতের গ্রেফতারকৃত নেতারাই পুলিশের কাছে স্বীকারোক্তি প্রদান করেছিলেন। পরদিন ৬ মে প্রধানমন্ত্রীও বলেছিলেন, হেফাজত জামায়াতকে আর ছাড় দেয়া হবে না। জঙ্গীসন্ত্রাস দমনে সরকার কঠোর হলে আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কী করতে পারে তার প্রমাণ আমরা তখন পেয়েছিলাম। এরপর জানি না চাপ কোত্থেকে এসেছেÑ পাকিস্তান, সৌদি আরব না আমেরিকা; আমরা দেখলাম সরকার কয়েক মাসের ভেতরই হেফাজততোষণের নীতি গ্রহণ করেছে। হেফাজতের হুমকিতে শিক্ষানীতি ও নারীনীতি বাস্তবায়ন বন্ধ হয়ে গেল, গণজাগরণ মঞ্চ ভেঙ্গে দেয়া হলো, ৫-৬ মের মহাতাণ্ডব ও সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্রের জন্য যেসব হেফাজত নেতাকে গ্রেফতার করা হয়েছিল সবাইকে ছেড়ে দেয়া হলো। এরপর হেফাজতকে রেলের জমি দেয়া হলো, টাকা দেয়া হলোÑ এ সবই তখন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। পুরনো বাংলা প্রবাদে আছেÑ কেউটে সাপের লেজ দিয়ে কান চুলকোতে নেই। জামায়াত-হেফাজতের তাণ্ডব আমরা ২০১৩ সালে একভাবে দেখেছি, ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে পরে আরেকভাবে দেখেছি। ২০১৫ সালের প্রথম তিন মাস খালেদা জিয়ার অবরোধের সময় জ্যান্ত মানুষ পোড়ানো এবং গণপরিবহনে আগুন লাগানোর ঘটনায় একরকম দেখেছি, আবার মুক্তিচিন্তার লেখক প্রকাশকদের চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যার ভেতর অন্যভাবে দেখেছিÑ যার জের এখনও চলছে। বিএনপির বদৌলতে বাংলাদেশে রাজনীতি করার সুযোগ পেয়ে জামায়াত মাকড়সার মতো জন্মদাতাকে হজম করে এখন দলে দলে আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশ করছে। বিএনপির জামায়াতীকরণ সাঙ্গ হওয়ার পর আওয়ামী লীগের জামায়াতীকরণ আমাদের দেখতে হচ্ছে। জামায়াত হেফাজতের ১৩ দফা এজেন্ডার সঙ্গে গলা মিলিয়ে ওলামা লীগ ঘোষণা দিয়েছেÑ বাংলাদেশে বাংলা নববর্ষ উদযাপন করা যাবে না, রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বাতিল করা যাবে না, কাদিয়ানিদের অমুসলিম ঘোষণা করতে হবে, হিন্দুদের লেখা বই পড়া যাবে না, প্রধান বিচারপতি হিন্দু হতে পারবেন না ইত্যাদি। আওয়ামী লীগের যে সব নেতা ও মন্ত্রী বলেছিলেন ওলামা লীগ আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠন বা সহযোগী সংগঠন নয়Ñ সংবাদ সম্মেলন করে তাদের মুণ্ডুপাত করা হয়েছে। ওলামা লীগের নেতারা আওয়ামী লীগের অফিসে বসে সংবাদ সম্মেলন করেন প্রধানমন্ত্রীর দোহাই দিয়ে। ওলামা লীগের প্রতি আওয়ামী লীগ বা প্রশাসনের বিশেষ কোন মহলের সম্পর্ক যদি না থাকে তাদের রাষ্ট্রদ্রোহিতামূলক কর্মকাণ্ডের জন্য কেন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না এর জবাব সরকারকে দিতে হবে। কারণ জঙ্গী মৌলবাদী সন্ত্রাস এবং মুক্তচিন্তার মানুষদের হত্যার ক্ষেত্র শুধু মুনতাসীর মামুনের ভাষায় ‘হে-জা-বি- (হেফাজত-জামায়াত-বিএনপি)-রা করছে নাÑ ওলামা লীগওয়ালারাও করছে।’ এপ্রিলে (২০১৬) যে পাঁচজন ব্লগার, সংস্কৃতিকর্মী, মানবাধিকার কর্মী, ভিন্ন ধর্মাবলম্বী ও অধ্যাপককে হত্যা করা হলো তাদের সম্পর্কে বলতে গিয়ে স্বয়ং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থেকে শুরু করে পরিচিতজন এবং টেলিভিশনের আলোচনায় অনেক ‘সন্ত্রাস বিশেষজ্ঞ’কে অদ্ভুত সব কথা বলতে শুনেছি। অধ্যাপক রেজাউল সম্পর্কে বলা হলো তিনি কোন দল করতেন না, নাস্তিক ছিলেন না, কখনও ধর্মের বিরুদ্ধে লেখেননি, মসজিদে চাঁদা দিতেন, নামাজ পড়তেন, নিভৃতে সঙ্গীতের চর্চা করতেনÑ তাঁকে কেন হত্যা করা হলো? বিষয়টি এমন যে, তিনি নাস্তিক হলে কিংবা নামাজ না পড়লে তাকে হত্যা যুক্তিসঙ্গত ছিল! কেউ কেউ এমনও বলেছিলেনÑ তাকে হত্যার অন্য কারণ থাকতে পারে। আমি তাদের জবাব দিয়েছিলাম, তিনি ‘কোমল গান্ধার’ নামে পত্রিকা প্রকাশ করেন, ‘সুন্দরম’ নামে সাংস্কৃতিক সংগঠন করেন, শিশুদের সঙ্গীত শিক্ষায় উৎসাহিত করেন, বাঙালিত্বের চেতনায় বিশ্বাস করেনÑ এসব কি তাকে হত্যার জন্য যথেষ্ট নয়? একইভাবে মানবাধিকারকর্মী জুলহাজ মান্নান সম্পর্কে স্বয়ং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, টেলিভিশনের ‘টক শো’-এ শুনেছি ‘বিশেষজ্ঞ’রা বলছেনÑ বাংলাদেশের সমাজে সমকামিতা গ্রহণীয় নয়, জুলহাজ সমকামী ও তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের অধিকার ও মর্যাদার জন্য আন্দোলন করে মৃত্যু ডেকে এনেছেন। জুলহাজ সমকামের নতুন সংজ্ঞা দিয়েছিলেন। তিনি সমপ্রেমের স্বীকৃতি চেয়েছেন। যারা বলেন বাংলাদেশে সমকামিতা নেই তারা বোধহয় আয়নায় মুখ দেখেন না। খবরের কাগজে হরহামেশা লেখা হচ্ছে মাদ্রাসার শিক্ষকরা কিংবা মসজিদের ইমামরা প্রতিনিয়ত কিভাবে বালকদের বলাৎকার করছেন। প্রতিবেশী ভারতসহ সমগ্র বিশ্বে মানবাধিকার আন্দোলনের নেতাকর্মীরা যখন সমকামী ও তৃতীয় লিঙ্গের সমঅধিকার ও মর্যাদা সম্পর্কে সোচ্চার তখন বাংলাদেশে তাদের একজনের হত্যাকা-কে জায়েজ করতে গেলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের ভাবমূর্তি কোন্্ তলানিতে গিয়ে ঠেকবে বুঝতে অসুবিধে হওয়ার কথা নয়। ধর্ম অনুমোদন করে নাÑ এই অজুহাত দেয়া হলে তো বিবর্তনবাদসহ যাবতীয় বিজ্ঞানপাঠ নিষিদ্ধ করা দেয়া উচিত, যা আল কায়দা ও আইএস তাদের খেলাফতে করতে চাইছে। পাকিস্তানের আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বুদ্ধিজীবী একবাল আহমেদ মোল্লা উমরের তালেবানদের রাজত্বকালে কিছুকাল কাবুলে ছিলেন। তিনি লিখেছেনÑ তখন আফগানিস্তানে রেডিওতে গান শোনা নিষিদ্ধ ছিল, মেয়েরা আপাদমস্তক কাপড়ে ঢেকেও পুরুষ সঙ্গী ছাড়া একা রাস্তায় বেরুতে পারত না। ছেলেদের ফুটবল খেলা নিষিদ্ধ করা হয়েছিল, কারণ তাদের নগ্ন ঊরু দর্শন করলে তালেবানদের ওজু নষ্ট হবে এই আশঙ্কায়। তালেবানদের ক্ষমতা দখলের আগে আফগানিস্তানের সমাজ অত্যন্ত আধুনিক ও উদার ছিল। গত শতাব্দীর তিরিশের দশকে বাদশা আমানউল্লা আফগানিস্তানে বল নাচের প্রচলন করেছিলেন, যার বিবরণ সৈয়দ মুজতবা আলীর উপন্যাসে আছে। ড. নজিবউল্লাহর সময় আফগানিস্তানে নারী জাগরণ কোন্্ পর্যায়ে গিয়েছিল তার কিছু খ-চিত্র ইন্টারনেটে এখনও রয়েছে। সমাজতন্ত্রী নজিবউল্লাহ ক্ষমতায় থাকার জন্য মোল্লাদের সঙ্গে অনেক সমঝোতা করেছিলেন। মোল্লাদের খুশি করার জন্য আফগানিস্তানের সংবিধানে ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’ তিনিই যুক্ত করেছিলেন। তারপরও মোল্লারা তাকে রেহাই দেয়নি। তারা কাবুলের জাতিসংঘের দফতরে আশ্রয় নেয়া ড. নজিবউল্লাহকে ধরে এনে প্রকাশ্য রাজপথে কী নৃশংসভাবে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করেছে সে দৃশ্য ইন্টারনেটে খুঁজলেই পাওয়া যাবে। মুসলিমপ্রধান দেশের গণতান্ত্রিক ও উদারনৈতিক শাসকরা যখনই মৌলবাদী সন্ত্রাসীদের সঙ্গে সমঝোতা করেছেন বা ছাড় দিয়েছেনÑ প্রথম সুযোগেই তারা তাদের হত্যা বা ক্ষমতাচ্যুত করেছে। পাকিস্তান আর আফগানিস্তানের ইতিহাস থেকে আমাদের বহু কিছু শেখার আছে। বাংলাদেশে জামায়াত এবং তাদের সহযোগী মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক অপশক্তিকে সন্তুষ্ট করবার জন্য জেনারেল জিয়া সংবিধান থেকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও চেতনা মুছে ফেলে জামায়াতকে সমাজ ও রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। তার সময়ে সেনাবাহিনীতে অভ্যুত্থান দমনের নামে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম অধিনায়ক কর্নেল তাহেরসহ শত শত মুক্তিযোদ্ধা সামরিক অফিসার ও জওয়ানকে হত্যা করা হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধে জামায়াত ও পাকিস্তানের পরাজয়ের প্রতিশোধ নেয়ার জন্য। তবু কি জিয়া শেষ রক্ষা করতে পেরেছেন? সে সময় মুক্তিযোদ্ধা সংসদের চেয়ারম্যান ছিলেন মুক্তিযুদ্ধে ৭ নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক লেঃ কর্নেল (অব.) কাজী নূর-উজ্জামান, রাষ্ট্রপতি জেনারেল জিয়া ছিলেন যার প্রধান পৃষ্ঠপোষক। কর্নেল জামান জিয়া হত্যার পর বিভিন্ন সভায় বলেছেন এই হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে জামায়াতের ইন্ধন ছিল। জিয়া হত্যার পর যে ১৩ জন সামরিক কর্মকর্তার বিচার ও ফাঁসি হয়েছিল তারা সবাই মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল সেনাবাহিনীতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির। রাষ্ট্রপতি জিয়া হত্যার জন্য তাদের বিচার হয়নি। প্রকৃতপক্ষে বিএনপি এ কারণেই জিয়া হত্যার বিচারে আগ্রহী হয়নিÑ কেঁচো খুঁড়তে গেলে জামায়াতি কালসাপ বেরিয়ে আসতে পারে। ক্ষমতায় যেভাবেই আসুক বিএনপি যে একটি বড় দল এবং বাংলাদেশের নির্বাচকম-লিতে তাদের শতকরা তিরিশ ভাগেরও বেশি সমর্থন আছে এটি বাস্তব সত্য। জামায়াত তোষণ করতে গিয়ে, জামায়াতের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে বিএনপি এখন হাঁটুভাঙা ‘দ’ হয়ে দফতরে বসে দম নিচ্ছে, বিবৃতি লিখছে আর সংবাদ সম্মেলন করছে। সিন্দাবাদের দৈত্যের মতো বিএনপির ঘাড়ে সওয়ার হয়েছে জামায়াত, যাকে ফেলে দেয়ার ক্ষমতা খালেদা জিয়ার নেই। ফেলতে তিনি পারবেনও না, কারণ পাকিস্তান কখনও জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির গাঁটছাড়া ছিঁড়তে দেবে না। বিএনপির দুর্দশা থেকেও আওয়ামী লীগের শেখার আছে। আমরা কেউ চাইব না আওয়ামী লীগের অবস্থা কখনও আজকের বিএনপির মতো হোক। জেনারেল জিয়া হত্যার প্রধান বেনিফিশিয়ারি জেনারেল এরশাদ ও বেগম খালেদা জিয়া। দুজনের পাকিস্তানপ্রেম বা জামায়াতপ্রেম গোপন কোনও বিষয় নয়। দুজনের কেউই জিয়া হত্যার বিচার করেননি। তবে বাংলাদেশকে পাকিস্তান বানাবার জন্য জিয়া যেভাবে সংবিধানের ইসলামীকরণ করেছেন সেটি ষোলকলা পূর্ণ হয়েছে জেনারেল এরশাদের দ্বারা। এরশাদ জামায়াত ও পাকিস্তানকে খুশি করবার জন্য সাপ্তাহিক ছুটি রোববারের বদলে শুক্রবার করেছেন, সংবিধানে ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’ যুক্ত করেছেনÑ যা তখন কোন ধর্মীয় গোষ্ঠীরও দাবি ছিল না। গত ২৩ মার্চ ২০১৬ ‘বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ ঐক্য পরিষদে’র সঙ্গে ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’র একটি আনুষ্ঠানিক বৈঠক ছিল। ঐক্য পরিষদ গঠিত হয়েছিল ১৯৮৮ সালে জেনারেল এরশাদের ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’ ঘোষণার প্রতিবাদে। তখন নির্মূল কমিটি ছিল না। ১৯৯২ সালে যারা নির্মূল কমিটি করেছেন তাদের প্রায় সবাই তখন ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’ ঘোষণার প্রতিবাদে ‘স্বৈরাচার ও সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী নাগরিক কমিটি’ গঠন করেছিলেন। সেই সময় এই নাগরিক কমিটির পক্ষ থেকে আমরা হাইকোর্টে একটি রিট করেছিলাম। আমাদের এই কমিটির ১৫ সদস্যবিশিষ্ট একটি প্রেসিডিয়াম ছিল। আমরা মামলা করেছিলাম প্রেসিডিয়াম সদস্যদের নামেÑ যাদের ভেতর ছিলেন সুপ্রীমকোর্টের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি কামালউদ্দিন হোসেন, কবি সুফিয়া কামাল, বিচারপতি দেবেশচন্দ্র ভট্টাচার্য, অধ্যাপক কবীর চৌধুরী, বিচারপতি কেএম সোবহান, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম অধিনায়ক মেজর জেনারেল (অবঃ) সিআর দত্ত বীরউত্তম, অধ্যাপক খান সারওয়ার মুরশীদ, সঙ্গীতশিল্পী কলিম শরাফী, ব্যারিস্টার ইশতিয়াক আহমেদ, অধ্যাপক বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, সাংবাদিক ফয়েজ আহমদ, অধ্যাপক বদরুদ্দিন উমর, অধ্যাপক আনিসুজ্জামান ও অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী । ২৩ মার্চ ঐক্য পরিষদের সঙ্গে আমাদের আলোচনার অন্যতম এজেন্ডা ছিল ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’-এর বিরুদ্ধে আমাদের পুরানো মামলার পুনরুজ্জীবন। আমাদের মনে হয়েছে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রের অন্যতম নীতি ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’র পুনঃসংযোজন এবং সুপ্রীমকোর্টের রায়ে সামরিক সরকার কর্তৃক জারিকৃত সংবিধানের সংশোধনী অবৈধ ঘোষণার ফলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সংবিধানের এই সাম্প্রদায়িক কলঙ্ক মুছে ফেলা সম্ভব হবে। (চলবে)
×