ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

রবীন্দ্রজয়ন্তীর আনুষ্ঠানিকতায় উজ্জ্বল রাজধানীর সংস্কৃতি ভুবন

প্রকাশিত: ০৬:১০, ৯ মে ২০১৬

রবীন্দ্রজয়ন্তীর আনুষ্ঠানিকতায় উজ্জ্বল রাজধানীর সংস্কৃতি ভুবন

স্টাফ রিপোর্টার ॥ রবিবার ছিল বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৫৫তম জন্মজয়ন্তী। কবিগুরুকে শ্রদ্ধা জানিয়ে নানা অনুষ্ঠান হয়েছে রাজধানীতে। আপন সৃষ্টির আলোয় স্মরণ করা হয়েছে কবিকে। জানানো হয়েছে হৃদয়ের ভালবাসা। গানের সুরে, কবিতার ছন্দে কিংবা নৃত্যশৈলীতে প্রকাশিত হয়েছে কবি বন্দনা। বিশ্বকবির জন্মদিনের নিবেদনে উজ্জ্বল রূপ নিয়েছে শহরের সংস্কৃতি ভুবন। ঢাকার নানা প্রান্তে হয়েছে রকমারি অনুষ্ঠান। ছায়ানট নিবেদিত রবীন্দ্র উৎসব ॥ ‘শুভ কর্মপথে ধর নির্ভয় গানÑ এই আহ্বানে শনিবার থেকে শুরু হয় ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানটের দুই দিনব্যাপী রবীন্দ্র উৎসব। রবিবার কবিগুরুর জন্মদিনে এই উৎসবের সমাপ্তি হয়। সমাপনী অনুষ্ঠানের বিশেষ আকর্ষণ ছিল আমার রবীন্দ্রনাথ শিরোনামে অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের কথার সঙ্গে তাঁর প্রিয় গানের উপস্থাপনা। ‘আমি কী এমন লোক যে আমার পছন্দের গান মানুষকে ডেকে শোনাতে হবে, তারপরও তারা যে ভেবেছেন এ কথা এটা আমার জন্যে আনন্দের, সম্মানের’Ñ এভাবেই বিনয় প্রকাশ করে কথা শুরু করেন আনিসুজ্জামান। গান ও আবৃত্তির পাশাপাশি বরেণ্য এই শিক্ষাবিদ ও লেখকের পছন্দের গান পরিবেশন ও তাঁর কথন নিয়ে ভিন্নধর্মী আয়োজনটি রবীন্দ্রপ্রেমীদের বিশেষভাবে আলোড়িত করেছে। রবীন্দ্রনাথের গান কেন ভাল লাগে এ প্রসঙ্গে আনিসুজ্জামান বলেন, হিন্দুস্তানী সঙ্গীতের সঙ্গে বাংলা গানের প্রধান পার্থক্য হিন্দুস্তানী গান সুর প্রধান আর বাংলা গান বাণী প্রধান। রবীন্দ্রনাথ এই বাংলা গানকে চরম উৎকর্ষে পৌঁছে দিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ নিজেই বলেছেন, আমি ধ্রুপদী গানের খাঁচাটা ভেঙেছি, বাসাটা রেখেছি। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ দাক্ষিণাত্যের গান থেকে যেমন নিয়েছেন তেমনি পাশ্চাত্যের নানা ধারা থেকে তিনি নিজের গানে ঢুকিয়েছেন। বাংলার বাউল, ভাটিয়ালি গানের স্পর্শও রয়েছে রবীন্দ্রনাথের গানে। যারা মনোযোগ দিয়ে রবীন্দ্রনাথের গান শোনে না তারাই বলেন, এ গান মনোটোনাস। তাঁর কথা শেষে একে একে প্রিয় মানুষের প্রিয় গান গেয়ে শোনান দেশের জনপ্রিয় রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পীরা। এটিএম জাহাঙ্গীর গেয়ে ওঠেন ‘ও আমার দেশের মাটি’। এরপরে লাইসা আহমেদ লিসা শোনান ‘তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা’, সত্যম কুমার দেবনাথ শোনান ‘জগতে আনন্দযজ্ঞে আমার নিমন্ত্রণ’। এ পর্যায়ে আবারও কথা বলেন আনিসুজ্জামান। তার কথার পরে ইলোরা আহমেদ শুক্লা গেয়ে শোনান ‘হৃদয়ে নন্দন বনে’, সুতপা সাহা শোনান ‘শাওন গগনে ঘোর ঘনঘটা’, সেঁজুতি বড়ুয়া ‘পুষ্প বনে পুষ্প নাই আছে অন্তরে’, সেমন্তী মঞ্জুরী ‘অধরা মাধুরী ধরেছি ছন্দোবন্ধনে’, মহিউজ্জামান চৌধুরীর ‘যেতে যেতে একলা পথে নিবেছে মোর বাতি’। এ গানের মধ্য দিয়েই শেষ হয় এই পর্ব। এর আগে দ্বিতীয় দিনের অনুষ্ঠান শুরু হয় ছায়ানটের শিল্পীদের সমবেত কণ্ঠে ‘ধ্বনিল আহ্বান মধুর গম্ভীর’ এ গানের মধ্য দিয়ে। ‘তোমার আনন্দ ওই এলা দ্বারে’ সম্মেলক কণ্ঠে এ গানে নৃত্য পরিবেশন করে শিল্পীরা। একক কণ্ঠে গান গেয়ে শোনান সৈকত মুখার্জী, মমি মঞ্জরী চৌধুরী, দীপ্তি দাশ, শিমু দে, অভয়া দত্ত, ঝুমা খন্দকার, সুমনা বিশ^াস প্রমুখ। রাম বসুর কবিতা ‘ভাষণ’ আবৃত্তি করেন জহিরুল হক খান। পরে জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে শেষ হয় অনুষ্ঠান। রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী সংস্থার আয়োজন ॥ ‘দূর করো সংশয়শঙ্কার ভার/যাও চলি তিমিরদিগন্তের পার’Ñ প্রতিপাদ্যে শেষ হলো রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী সংস্থার পাঁচ দিনব্যাপী সপ্তবিংশ জাতীয় রবীন্দ্র উৎসব। সুফিয়া কামাল জাতীয় গণগ্রন্থাগারের শওকত ওসমান স্মৃতি মিলনায়তনে রবিবার সমাপনী দিনের আয়োজন শুরু হয় সংস্থার শিল্পীদের সমবেত কণ্ঠের পরিবেশনা দিয়ে। একঝাঁক শিল্পী একসঙ্গে গেয়ে যায় ‘হে নূতন দেখা দিক আর-বার’ ও ‘ঐ মহামানব আসে’ শিরোনামের দুটি গান। সমাপনী আয়োজনে রবীন্দ্রসঙ্গীতে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ রবীন্দ্র সঙ্গীতশিল্পী পাপিয়া সারোয়ারকে বিশেষ সম্মাননা দেয়া হয় সংস্থার পক্ষ থেকে। এ সময় সংগঠনের প্রধান উপদেষ্টা আমিনা আহমেদ, সভাপতি তপন মাহমুদ ও সাধারণ সম্পাদক সাজেদ আকবার উপস্থিত ছিলেন। একই অনুষ্ঠানে প্রয়াত রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী কলিম শরাফী ৯৩ জন্মদিন উপলক্ষে সংক্ষিপ্ত অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। সেখানে সংস্থার শিল্পী কথামালা আর গানের মধ্য দিয়ে প্রয়াত এই শিল্পীকে স্মরণ করা হয়। সম্মাননা পর্ব শেষে শুরু হয় একক কণ্ঠের পরিবেশনা। এ পর্বে সাগরিকা জামালী গেয়ে শোনান ‘প্রভু আজি তোমার’, মাহজাবীন রহিম মৈত্রী গাইলেন ‘মধুর তোমার শেষ না পাই’, দিনাত ফেরদৌস ‘সে তো আমি চাই’, শফিকুর রহমান খান ‘লিখন তোমার ধুলায় হয়েছে ধূলি’। রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন পর্যারের গান পরিবেশন করেন রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা, তপন মাহমুদ, সাদী মহম্মদ, আমিনা আহমেদ, পাপিয়া সারোয়ার, বুলা মাহমুদ, তানজিমা তমা, শিমু দে, আবদুল ওয়াদুদ, হিমাদ্রি শেখর, পিযুষ বড়ুয়া, ইপ্সিতা মজুমদারসহ অনেকে। দলীয় সঙ্গীত পরিবেশন করে বৈতালিক ও রবিরাগ। রবীন্দ্রনাথের রচনাবলী থেকে পাঠ করেন ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায়। এবি ব্যাংক-চ্যানেল আই রবীন্দ্রমেলা ॥ বিশ্বকবির জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে চ্যানেল আই এবারও তাদের নিজস্ব কার্যালয়ে রবীন্দ্রমেলার আয়োজন করে। বিকেল একটানা ছয় ঘণ্টা রবীন্দ্রকেন্দ্রিক নানা আয়োজনে উৎসবমুখর ছিল। তেজগাঁওয়ের চ্যানেল আই ভবনের খোলা চত্বরে রবিবার পড়ন্ত বিকেলে একঝাঁক কমলা-হলুদ রঙের বেলুন আকাশে অবমুক্ত করার মধ্য দিয়ে মেলার উদ্বোধন হয়। রামেন্দু মজুমদার, আসাদ চৌধুরী, আতাউর রহমান, আলী ইমাম, হাবীবুল্লাহ সিরাজী, সৈয়দ সালাহউদ্দীন জাকী, মোরশেদুল ইসলাম, মনিরুল হক, ফরিদ আহমদ, রেজানুর রহমানসহ বিশিষ্টজনকে নিয়ে মেলার উদ্বোধন চ্যানেল আইয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফরিদুর রেজা সাগর, পরিচালক ও বার্তা প্রধান শাইখ সিরাজ, আবদুর রশিদ মজুমদার, জহিরউদ্দিন মাহমুদ মামুন, মুকিত মজুমদার বাবু, মেলার পৃষ্ঠপোষক এবি ব্যাংকের ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর (মার্কেটিং) মশিউর রহমান চৌধুরী। উদ্বোধনের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হতেই ভবনের খোলা প্রাঙ্গণে অস্থায়ী মঞ্চ থেকে পরিবেশিত হয় প্রবীণ-নবীন শিল্পীদের পরিবেশনায় রবীন্দ্রসঙ্গীত, রবীন্দ্র নৃত্যনাট্য, শিশুনৃত্য ইত্যাদি। শুরুতেই ক্যামব্রিয়ান স্কুলের শিক্ষার্থীরা ‘রাঙিয়ে দিয়ে যাও, যাও এবার যাবার আগে’, ‘রাঙা রাশি রাশি রাশি আশোকে পলাশে’ ও ‘তৃষ্ণার শান্তি সুন্দরকান্তি/তুমি এসো বিরহের সন্তাপ-ভঞ্জন’ গানের সঙ্গে নৃত্য পরিবেশন করে। এর পর একক গান পরিবেশন করেন সাদী মহম্মদ। তিনি গেয়ে শোনান ‘আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে’ গানটি। এর পর দেয়া হয় এবি ব্যাংক-চ্যানেল আই রবীন্দ্রমেলা আজীবন সম্মাননা। মননশীল সাহিত্যে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ আজীবন সম্মাননা দেয়া হয় আলোকিত মানুষ গড়ার কারিগর, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সভাপতি অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ এবং রবীন্দ্রসঙ্গীতে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ প্রখ্যাত কণ্ঠশিল্পী তপন মাহমুদকে। তাদের হাতের সম্মাননা স্মারক, অর্থ ও উত্তরীয় পরিয়ে দেন ফরিদুর রেজা সাগর, শাইখ সিরাজ ও সম্মাননার আরেক পৃষ্ঠপোষক প্রতিষ্ঠান আইএফআইসি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহ আলম সারোয়ার। এ সময় প্রখ্যাত রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা ও চ্যানেল আইয়ের পরিচালকবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। সম্মাননা পাওয়ার পর আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ অনুভূতি প্রকাশ করে বলেন, ‘এ সম্মাননা আমাকে না দিয়ে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রকে দিলে বেশি খুশি হতাম। এটাই আমার সম্মানের স্থান।’ মঞ্চে ফরিদুর রেজা সাগর ঘোষণা দেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রকে এক লাখ টাকার বই এবং দুস্থ রবীন্দ্র সঙ্গীতশিল্পীদের জন্য এক লাখ টাকা চ্যানেল আই থেকে প্রদান করা হবে। সম্মাননা গ্রহণ করে তপন মাহমুদ তার অনুভূতি প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, ‘এমন একজন ব্যক্তিত্বের সঙ্গে আমাকে সম্মানিত করা হলো, তাতে মনে হচ্ছে আমার উচ্চতা আকাশ ছুঁয়েছে।’ মেলা মঞ্চে তপন মাহমুদ, রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা, আজিজুর রহমান তুহিনের কণ্ঠে শোনা গেল রবীন্দ্রনাথের প্রেম, পূজা পর্যায়ের বিভিন্ন গান। মেলা মঞ্চে ‘প্রিয় রবীন্দ্রনাথের প্রেমের গান’ শিরোনামে রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যার কণ্ঠে একটি অডিও সিঁডির মোড়ক উন্মোচন করেন মেলায় আগত অতিথিরা। রবীন্দ্রনাথের ১০টি গান দিয়ে সাজানো হয়েছে এ্যালবামটি। গানগুলো বাছাই করে দিয়েছেন প্রফেসর ইমেরিটাস আনিসুজ্জামান। সিডিটি প্রকাশ করেছে ইমপ্রেস অডিও ভিশন। মেলায় ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্পের স্টল ছাড়াও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ২০টি স্টলে দিনব্যাপী প্রদর্শন করা হয় রবীন্দ্র গ্রন্থ, রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে লিখিত গ্রন্থ, রবীন্দ্র চিত্রকলা, রবীন্দ্রসঙ্গীতের রেকর্ড কাভার, রবীন্দ্র পোশাক, রবীন্দ্রনাথ সংক্রান্ত ভিডিও সিডি। ছিল রবীন্দ্রসঙ্গীতের গানের স্টল, রবীন্দ্র চলচ্চিত্র প্রদর্শনী, ঠাকুরবাড়ির রূপসজ্জা ইত্যাদি। কথা গান কবিতায় উদীচীর রবীন্দ্রজয়ন্তী উদযাপন ॥ কথায়, গানে ও কবিতায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মজয়ন্তী উদযাপন করে বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী। রবিবার সন্ধ্যায় তোপখানা রোডের উদীচী কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করে উদীচী ঢাকা মহানগর সংসদ। অনুষ্ঠানের শুরুতে ‘আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে বিরাজ সত্য সুন্দর’ গানটি পরিবেশন করেন উদীচী ঢাকা মহানগর সংসদের শিল্পীরা। এরপর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘সভ্যতার সঙ্কট’ প্রবন্ধটি পাঠ করেন উদীচী ঢাকা মহানগর সংসদের সহসভাপতি ও কেন্দ্রীয় সংসদের সহসাধারণ সম্পাদক অমিত রঞ্জন দে। এরপর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিল্প-সাহিত্য-রাজনীতি-অর্থনীতি ও তাঁর জীবনের নানা দিক নিয়ে আলোচনা করেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কাজল ব্যানার্জী, ডাঃ শাহীন রহমান, উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সাধারণ সম্পাদক প্রবীর সরদার, উদীচী ঢাকা মহানগর সংসদের সহসভাপতি অধ্যাপক এ এন রাশেদা প্রমুখ। অনুষ্ঠানে একক সঙ্গীত পরিবেশন করেন কুমারেশ নাগ, সুরাইয়ার পারভীন, বিপ্লব রায়হান, বর্ণালী নাগ, ফরহাদ, সন্দীপা বিশ্বাস প্রমুখ।
×