ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

নিজামীর ফাঁসির বাকি এক ধাপ- প্রাণভিক্ষা

প্রকাশিত: ০৫:৪২, ৯ মে ২০১৬

নিজামীর ফাঁসির বাকি এক ধাপ- প্রাণভিক্ষা

বিকাশ দত্ত ॥ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় হত্যা, ধর্ষণ এবং বুদ্ধিজীবী গণহত্যার দায়ে আপীল বিভাগ কর্তৃক মৃত্যুদ-প্রাপ্ত জামায়াতে ইসলামীর আমির শীর্ষ নেতা আলবদর বাহিনীর প্রধান বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সাবেক মন্ত্রী মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসির রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগে খারিজ হওয়ার পর এখন মাত্র একটি ধাপ বাকি আছে। সেটি হলো রাষ্ট্রপতির নিকট প্রাণভিক্ষার আবেদন। রিভিউয়ের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ হওয়ার পর তা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে কারাগারে যাবে। কারা কর্তৃপক্ষ তখন নিজামীকে রায়ের কপি পড়ে শোনাবেন। এর পর জানতে চাইবেন তিনি রাষ্ট্রপতির নিকট প্রাণভিক্ষা চাইবেন কি-না। প্রাণভিক্ষা চাইলে নিয়ম অনুযায়ী তা রাষ্ট্রপতির নিকট পাঠনো হবে। আর না চাইলে দ- কার্যকর করতে আইনগত কোন বাধা থাকবে না। সরকার দিনক্ষণ নির্ধারণ করে দ- কার্যকর করবে। একটি সূত্র জানিয়েছে, রিভিউর পূর্ণাঙ্গ রায় বের হওয়ার পর শীঘ্রই দ- কার্যকর হতে পারে। এক্ষেত্রে জেল কোডের নিয়ম প্রযোজ্য হবে না। রবিবার সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা পর্যন্ত রিভিউর পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়নি। ৫ মে মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসির রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগ খারিজ করে দেয়। রিভিউ খারিজ হওয়ার পর পরই ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার ও কাশিমপুর-২ কারা কর্তৃপক্ষ দ- কার্যকরের জন্য প্রস্তুত। তারা শুধু সরকারের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় রয়েছে। কারা সূত্রে জানা গেছে, মতিউর রহমান নিজামী সুস্থ আছেন। কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার-২-এর সূত্রে জানা গেছে, নিজামীকে রাতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে স্থানান্তর করা হচ্ছে। রিভিউ খারিজের পর আইনমন্ত্রী এ্যাডভোকেট আনিসুল হক বলেছেন, রায় কার্যকরে আইনী প্রক্রিয়ায় এখন একটাই ধাপ বাকি রয়েছে। তিনি বলেন, রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা চাওয়া ছাড়া আর কোন আইনী সুযোগ নেই। এর আগেও অনেকগুলো রায় হয়েছে এবং রায় কার্যকর করা হয়েছে। এ রায়ও তেমনি কার্যকর হবে। অন্যদিকে এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছেন, ‘মতিউর রহমান নিজামী যদি প্রাণভিক্ষা চান, তা রাষ্ট্রপতির ওপর নির্ভর করবে। না চাইলে দ- কার্যকর হবে। সরকার দিনক্ষণ নির্ধারণ করে দ- কার্যকর করবে।’ এক্ষেত্রে জেল কোড প্রযোজ্য হবে না। আইন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, দ- কার্যকর করতে জেল কোডের প্রয়োজন নেই। রায় বাস্তবায়নে সাত দিনের অপেক্ষার সুযোগও নেই। ফৌজদারি কার্যবিধিতে বলা আছে, ফৌজদারি কার্যবিধির আন্ডারে যখন দ- হয় এবং তখন ক্যাপিটাল পানিশমেন্ট হয় মানে মৃত্যুদ- দেয়া হয় তাহলে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলিয়ে তার মৃত্যুদ- কার্যকার করা হয়। এখানে সে রকম কিছু নেই। আর একটা কথা আছে, জেল কোড, জেল কোডের ৯৮১নং রুলে বলা আছে, তাদের মার্সি পিটিশন করবেন কি-না জিজ্ঞাসা করা হবে। তারা যদি মার্সি পিটিশন করে তাহলে মার্সি পিটিশন দেয়ার জন্য যতটুকু সময় লাগে দেয়া হবে। যেহেতু জেল কোডে বলা আছে সাত দিন, জাজমেন্টে বলা আছে জেল কোড নট এ্যাপ্লাই। সেহেতু আইনে যে ব্যাখ্যা সেটা হলো সাত দিন অপেক্ষা করার সুযোগ নেই। ২০১০ সালের ২১ জুলাই মতিউর রহমান নিজামীর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের তদন্ত শুরু হয়। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল নিজামীর মৃত্যুদ- প্রদান করে। এর পর আসামি আপীল বিভাগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে আপীল করেন। আপীলেও ট্রাইব্যুনালের দ- বহাল রাখা হয়। আপীলের রায়ের বিরুদ্ধে এর পর রিভিউ করা হয়। সর্বশেষ ৫ মে আপীল বিভাগ রিভিউ আবেদন খারিজ করে দেয়। দীর্ঘ ছয় বছর ধরে তদন্ত ও আইনী যুদ্ধে মতিউর রহমান নিজামী পরাজয়বরণ করেন। এখন শুধুমাত্র একটি ধাপ- রাষ্ট্রপতির নিকট প্রাণভিক্ষা চাওয়া। তার প্রধান আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেছেন, প্রাণভিক্ষাটা শুধুই তার নিজস্ব বিষয়। এর আগে আরও চারটি মামলার দ- কার্যকর করা হয়েছে। তার মধ্যে জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরী রাষ্ট্রপতির নিকট কৃতকর্মের জন্য প্রাণভিক্ষা চেয়েছিলেন। অন্যদিকে জামায়াতের দুই সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লা ও মুহাম্মদ কামারুজ্জামান তাদের কৃতকর্মের জন্য রাষ্ট্রপতির নিকট প্রাণভিক্ষা চাননি। মতিউর রহমান নিজামীর মামলাটি চূড়ান্ত রায় হওয়া আপীল বিভাগের ষষ্ঠ মামলা। এর আগে মীর কাশেমসহ সাতটি মামলা নিষ্পত্তি হলেও মীর কাশেমের আপীলের চূড়ান্ত রায় প্রকাশিত হয়নি। ছয়টি রায়ের মধ্যে চারটিতে জামায়াতের দুই সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কাদের মোল্লা ও মুহাম্মদ কামারুজ্জামান, জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ এবং বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরীর ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। আপীল বিভাগের আরেক রায়ে জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর সাজা কমিয়ে আমৃত্যু কারাদ- দেয়া হয়েছে। ওই রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশিত হওয়ার পর দু’পক্ষই রিভিউ আবেদন করেছেন। শুনানি চলার মধ্যেই মুক্তিযুদ্ধকালীন জামায়াতের আমির গোলাম আযম ও বিএনপির সাবেক মন্ত্রী আবদুল আলীমের মৃত্যু হওয়ায় তাদের আপীলের নিষ্পত্তি হয়ে গেছে। আপীলের রায়ে বলা হয়, যে আট অভিযোগে তিনি (নিজামী) ট্রাইব্যুনালে দোষী সাব্যস্ত হয়েছিলেন, তার মধ্যে ১, ৩ ও ৪ নম্বর অভিযোগে তিনি খালাস পেয়েছেন। আর ২, ৬, ৭, ৮ ও ১৬ নম্বর অভিযোগে তার দ- বহাল রয়েছে। এর মধ্যে ২, ৬ ও ১৬ নম্বর অভিযোগে পাবনার বাউশগাড়ি, ডেমরা ও রূপসী গ্রামের প্রায় সাড়ে ৪০০ মানুষকে পাকিস্তানী সেনারা হত্যা ও ৩০-৪০ জন নারীকে ধর্ষণ; পাবনার ধুলাউড়ি গ্রামে নারী, পুরুষ ও শিশুসহ ৫২ জনকে হত্যা এবং পরিকল্পিতভাবে বুদ্ধিজীবী গণহত্যার দায়ে নিজামীর ফাঁসির রায় বহাল রেখেছে আপীল বিভাগ। ৪ নম্বর অভিযোগে পাবনার করমজা গ্রামে নয়জনকে হত্যা, ধর্ষণ ও লুটপাটের অভিযোগে ট্রাইব্যুনালে মৃত্য্যুদ- হলেও আপীলে তিনি খালাস পেয়েছেন। ট্রাইব্যুনালের রায়ে ১, ৩, ৭ ও ৮ নম্বর অভিযোগে আটক, নির্যাতন, হত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধের ষড়যন্ত্র ও সংঘটনে সহযোগিতার চারটি অভিযোগে নিজামীকে যাবজ্জীবন কারাদ- দেয়া হয়েছিল। সর্বোচ্চ আদালত প্রথম দুটিতে খালাস দিয়ে পরের দুটিতে সাজা বহাল রেখেছে।
×