ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কাঁদছে ক্যাম্পাস

প্রকাশিত: ০৬:২০, ৮ মে ২০১৬

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়  কাঁদছে ক্যাম্পাস

দুপুর গড়িয়ে বিকেল শুরু। মুর্হূতেই ধূসর হয়ে গেছে চারপাশ। প্রকৃতিও যেন স্তব্ধ হয়ে আছে। ক্যাম্পাসের গুমোট পরিবেশ যেন কাটছে না কোনভাবেই। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ কলা ভবনের সামনের চায়ের দোকান আর চত্বরগুলোতে চলছে আড্ডা। শিক্ষার্থীরাও আছেন। কিন্তু আড্ডায় নেই স্বতঃস্ফূর্ততা। কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। সেখানে নেই শিক্ষার্থীদের নিত্যদিনের ব্যস্ততা। তারা সকলেই প্রিয় স্যারকে হারিয়ে নির্বাক। শুধু এখানেই না, ক্যাম্পাসের প্রতিটি প্রান্তেই কয়েকদিন ধরে শূন্যতা আর নিস্তব্ধতা। নেই কোন কোলাহল আর তরুণ প্রাণের কথার শব্দমালা। শব্দ থাকবে কী করে? এই ক্যাম্পাসের একটি প্রিয় মুখ যে চলে গেছেন শব্দের বাইরের জগতে। যে জগত থেকে কেউ কখনও ফিরে আসে না। ইংরেজী বিভাগের অধ্যাপক রেজাউল করিম হত্যার পর এমনি স্তব্ধতার চাদরে ঢাকা পড়েছে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। স্যারের হত্যাকা-ের পর সবার মনে বিষাদের ছাঁয়া। সকলের স্বাভাবিক জীবনের বোধটুকু হারিয়ে গেছে প্রিয় স্যারকে হারিয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল শিক্ষার্থী রেজাউল করিম স্যারকে হারিয়ে বিমূর্ষ। সরব নেই একাডেমিক বিভাগের কার্যক্রমও। প্রিয় সহকর্মীকে হারিয়ে যেন তারাও হতভম্ব। কি যেন হারিয়ে গেছে তাদের মাঝ থেকে? এই নৃশংস হত্যাকা-ের পর শোককে শক্তিতে ধারণ করে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা মতিহারের সবুজ বুকে জেগে ওঠেছে প্রিয় শিক্ষকের হত্যার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচারের দাবিতে। হত্যার ছয়দিন পেরিয়ে গেলেও এখনও শোককে ধারণ করে স্যারের সহকর্মীরা ও তার শিক্ষার্থীরা এখনও বিক্ষুব্ধ। কেন তাদের স্যারকে হত্যা করা হলো? কি অপরাধ ছিল স্যারের? সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে ব্যাকুল। তারা মানতেই পারছে না কেন স্যারকে হত্যা করা হলো? ইংরেজী বিভাগের সামনে যেতেই দেখা গেল শোকের মাতম। বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা সকলেই ভারাক্রান্ত হৃদয়ে নিথর হয়ে বিলাপ করছে। কেন এমনটি হলো? তাদের সঙ্গে কথা বলতেই জানা গেল প্রিয় শিক্ষক সম্পর্কে হৃদয়গ্রাহী সব স্মৃতিকথা। একবার বিভাগের ছাত্রছাত্রীদের ছবি দেখানোর প্রকল্প হাতে নিয়েছিলেন তিনি। অফিস থেকে প্রজেক্টর কেনার অর্থ না পেয়ে নিজের টাকায় প্রজেক্টর কিনলেন। পরে বিকেলে দু’চারজন শিক্ষার্থীকে জোর করে বসিয়ে প্রিয় সিনেমাটা দেখালেন। তখন তার চোখে-মুখে কি যে আনন্দ, তা না দেখলে বোঝানো যাবে না! শিক্ষার্থীদের এমন স্মৃতি রোমন্থনে ভারি হয়ে উঠেছে রাবি’র আকাশ-বাতাস। সদ্য দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী সাবিনা সুলতানা বলছিলেন, বিভাগে মাত্র একবছর পার করেছি। এই অল্প সময়ে স্যারের ক্লাস করার সুযোগ হয়েছে। তিনি এতো সহজ করে সাহিত্য পড়াতেন যে ক্লাসে মনোযোগ দিয়ে শুনলে বুঝতে আর কমতি থাকে না। তিনি খুব মিশুক প্রকৃতির ছিলেন। এবারের পহেলা বৈশাখেও স্যার আমাদের কাছে এসে একসঙ্গে ছবি তুলেছেন। রানা আরও বলেন, ইংরেজী বিভাগ এ বছর প্রথমবার আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় প্রতিযোগিতায় সেমিফাইনালে উঠে, এ কারণে স্যার খুবই আনন্দিত হয়েছিলেন। তাঁর মতো শিক্ষক পাওয়া খুবই দুষ্কর। তিনি যথাসময়ে ক্লাস নিতেন। শিক্ষার্থীদের নিয়ে একসঙ্গে সঙ্গীত, লেখালেখি চর্চা করতেন। তিনি এতো সুন্দর করে সেতার বাজাতেন যে কেউ শুনলে মুগ্ধ হতে বাধ্য। এমন মানুষ পাওয়া খুবই কঠিন। ’ স্যারের সঙ্গে শেষ কথা হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশিষ্ট নাট্যজন মলয় কুমার ভৌমিকের সঙ্গে। তিনি স্মৃতিচারণ করে বলেন, তিনি ছিলেন নিভৃতচারী। তিনি কখনও তেমন করে কারোর সঙ্গে মিশতেন না। তিনি তাঁর একাডেমিক কাজ আর নিজের ভাললাগা নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। আসলে তিনি ছিলেন খুবই নিরীহ। এমন সজ্জ্বন ব্যক্তির দেখা খুব কমই মিলে। তিনি আরও বলেন, আমার লেখা যখনই কোন পত্রিকায় প্রকাশিত হতো তিনি পড়তেন। এবং সঙ্গে সঙ্গে আমাকে জানাতেন যে লেখাটি কেমন হয়েছে। ভাল খারাপ সবটুকু আমাকে বলতেন। যা আমাকে অনুপ্রাণিত করত। এ ধরনের মানুষ আমাদের সমাজের জন্য খুব বেশি প্রয়োজন ছিল।’ খেলার মাঠেও সঙ্গী ছিলেন স্যার খেলাধুলা তিনি খুব ভালবাসতেন। ইংরেজী বিভাগের সব ধরনের খেলাধুলায় তার মাঠে থাকা চাই। আর মাঠে তার উৎসাহ দেখে কে? দল হেরে যাবে জেনেও কখনও মাঠ ছেড়ে চলে আসতেন না। ছেলেদের সাহস পাবে এই ভেবে মাঠে থাকতেন। এমনটি বলছিলেন ইংরেজী বিভাগ থেকে মাস্টার্স শেষ করা শিক্ষার্থী আসিফ ফয়সাল। আরও যুক্ত করলেন, ‘খারাপ খেললে বিরক্ত হতেন, কিন্তু উঠে পড়তেন না। শেষটা দেখার জন্য মাঠে বসে থাকতেন। তুলতেন টিমের সঙ্গে গ্রুপ ছবি। আবার খেলার প্রয়োজনে কোন কিছু কেনার দরকার হলে টাকা দিতেন। সেই টাকা দিয়ে ব্যাট, বল, হ্যালমেট কিনতাম। তার উপস্থিতি আমাদের অনেক বেশি অনুপ্রাণিত করত। কিন্তু ঘাতকের আঘাত সেই অনুপ্রেরণাকে নষ্ট করে দিল। বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী মুস্তাফিজুর রহমান বলছিলেন, আমি হতবাক। এমনভাবে স্যারের মৃত্যু হবে ভাবতেই কষ্ট লাগে। বিভাগে পড়ার সুবাদে তার বাসায় যাওয়া হতো। তিনি সবসময় আমাকে সন্তানের মতো দেখতেন। স্যারের সঙ্গে অনেকবার একসঙ্গে সিনেমা দেখেছি। প্রত্যেকবার স্যার নিজেই সিনেমার টিকেট ক্রয় করতেন। কিন্তু শেষবার আমি নিজে টিকেট কিনেছিলাম আর দুজনে একসঙ্গে সিনেমা দেখেছিলাম। আসলে কখনও সুযোগই হতো না নিজে টিকেট ক্রয় করে স্যারকে নিয়ে সিনেমা দেখার।’ সেতার আর স্যার একই সুতোয় গাঁথা বিদ্যুত গতিতে হাত উঠানামা করছে সেতারের তারে। মুর্হূতেই সেই হাতের ছোঁয়ায় ছড়িয়ে পড়ে সুরের মূর্ছনা। চারপাশ যেন আলোড়িত সে সুরের মূর্ছনায়। আকস্মিকভাবেই ২২৭নং কক্ষ থেকে ভেসে আসা সেতারের সুরে আকর্ষিত হতো বিভাগের শিক্ষার্থীরা। আর সময় পেলেই দল ধরে ছুটে আসত শিক্ষার্থীরা প্রিয় স্যারের ব্যক্তিগত কক্ষে। দেখতেন স্যারের সেতার বাজানো আর বিভোর হয়ে শুনতেন সেতারের সুর। শুধু নিজেই বাজাতেন না, পাশে বসা শিক্ষার্থীদের শেখাতেন কিভাবে সেতার বাজাতে হয়। ‘তুমিই শ্রেষ্ঠ বাবা’ ক্লান্তচোখে আর আবেগজড়িত কণ্ঠে অধ্যাপক রেজাউল করিম সিদ্দিকীর মেয়ে রিজওয়ানা হাসিন শতভি বলেন, ‘আব্বু আমাদের সব ধরনের শিক্ষা দিয়েছিলন। তিনি গ্রামের বাড়িতে গিয়ে দাদিকে বলতেন দেখ তো এই টুপিটা কেমন হয়েছে? তার ইচ্ছায় বাসায় সাংস্কৃতিক চর্চা হতো। আব্বু সবসময় পড়তেন। তিনি প্রতিদিন সকাল ৭টা ৪০মিনিটে বাসার সামনে থেকে বাসে উঠতেন। এখন আর আমার আব্বু সকালে ঘুম থেকে উঠবে না। তিনি কোনদিন আমাদের কোন ধরনের অভাব রাখেননি। সবকিছুই পূরণ করেছিলেন। কান্নাজড়িত কণ্ঠেই শতভি বলেন, সন্তান হিসেবে বলব ‘তুমিই শ্রেষ্ঠ বাবা।’ ে আলী ইউনুুস হৃদয়
×