ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সিঙ্গাপুর ফেরত বাংলাদেশী কেউ আইএস সম্পৃক্ত নয়

প্রকাশিত: ০৫:৪৫, ৮ মে ২০১৬

সিঙ্গাপুর ফেরত বাংলাদেশী কেউ আইএস সম্পৃক্ত নয়

শংকর কুমার দে ॥ সিঙ্গাপুর থেকে দুই দফায় ফেরত পাঠানো ৩২ বাংলাদেশীর কারও বিরুদ্ধেই আন্তর্জাতিক জঙ্গী সংগঠন ইসলামিক স্টেট (আইএস) বা আল কায়েদার সম্পৃক্ততার কোন তথ্যপ্রমাণ পায়নি পুলিশ। তাদের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে তার মধ্যে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গী সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলাটিমের সঙ্গে নানাভাবে সম্পৃক্ত। সিঙ্গাপুর থেকে ফেরত পাঠানো ৫ জঙ্গীকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। দুই দফায় সিঙ্গাপুর থেকে ফেরত পাঠানো ৩২ বাংলাদেশীকে জিজ্ঞাসাবাদ ও অনুসন্ধানের ভিত্তিতে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) তৈরি করা এক প্রতিবেদন থেকে এ ধরনের তথ্য জানা গেছে। ডিবি সূত্র জানায়, শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে সিঙ্গাপুরে গিয়ে তারা মিলিত হতো সিঙ্গাপুরের মোস্তফা সেন্টারের বিপরীতে সেরাঙ্গুন এলাকার এ্যাঙ্গুলিয়ার একটি মসজিদে। প্রতি সপ্তাহের রবিবার তারা একত্রিত হয়ে বৈঠক করত এই মসজিদে। তারা জিহাদী বয়ান, ওয়াজ ও জিহাদী ভিডিও দেখাসহ নতুন সদস্য সংগ্রহ করে সংগঠনের কার্যক্রমে অনুপ্রাণিত করত এবং অর্থ সংগ্রহ ও জিহাদী বই প্রকাশ-প্রচার করত। বাংলাদেশের কথিত আনসারুল্লাহ বাংলাটিমের প্রধান জসিমউদ্দিন রাহমানীর অনুসারী ছিল। তাদের অনেকের ব্যবহৃত মুঠোফোন থেকে জসিমউদ্দিন রাহমানীর সফট কপি পাওয়া গেছে। তারা ড. জাকির নায়েক, আবুল কালাম, শাহ মতিউর রহমান মাদানী, আমানউল্লাহ্ বিন ইসমাঈল, আব্দুর রাজ্জাক বিন ইউসুফের ওয়াজ শুনত ও তাদের কর্মকা-ে অনুপ্রাণিত হয়ে লা-মাযহাব (কোন মাযহাব অনুসরণ করে না) পালনে আহলে হাদিসের অনুসারী হয়। ডিবি সূত্র জানায়, গত বছরের ডিসেম্বরে সিঙ্গাপুর থেকে দেশে ফেরত পাঠানো ২৭ জনের মধ্যে ১৪ জনের জঙ্গী সংশ্লিষ্টতা থাকায় তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। প্রাথমিক তদন্ত ও যাচাই-বাছাই শেষে বাকি ১৩ জনকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। তবে তাদের সার্বক্ষণিক গোয়েন্দা নজরদারিতে রাখা হয়েছে। ডিবির জিজ্ঞাসাবাদ ও অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্যে উল্লেখ করা হয়, গ্রেফতারকৃতরা সিঙ্গাপুরে যাওয়ার আগে জঙ্গী মতাদর্শ এবং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিল না। সেখানে গিয়ে কিছুটা উগ্র মতাদর্শের সঙ্গে উদ্বুদ্ধ হয়। তবে বাংলাদেশে বা সিঙ্গাপুরে নাশকতামূলক কর্মকা- চালানোর যে অভিযোগ করা হয়েছে সে বিষয়ে এখনও কোন তথ্য পাওয়া যায়নি। তাদের কয়েকজনের কাছে আনসারুল্লাহ বাংলাটিমের প্রধান মুফতি জসিমউদ্দিন রাহমানীর লেখা বই পাওয়া গেছে। তারা আনসারুল্লাহ মতাদর্শের অনুসারী। গ্রেফতারকৃতরা জিজ্ঞাসাবাদে কেউ কেউ জানিয়েছে, তারা মুফতি রাহমানীর বক্তব্য শুনতে ও তার লেখা বই পড়তে পছন্দ করত। ডিবি সূত্র জানায়, গত ২৯ এপ্রিল পাঁচ বাংলাদেশীকে দেশে ফেরত পাঠায় সিঙ্গাপুর কর্তৃপক্ষ। তারা হলোÑ মিজানুর রহমান ওরফে গালিব হাসান চৌধুরী (৩৮), রানা মিয়া ওরফে পাইলট (২৯), আলমগীর হোসেন (৩১), তানজিমুল ইসলাম (২৪) ও মাসুদ রানা ওরফে সন্টু খান (৩১)। তাদের প্রত্যেকেই ২০০৭ থেকে ২০১১ সালের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে কাজের অনুমতি নিয়ে সিঙ্গাপুরে যায়। তাদের বিরুদ্ধেও আইএস ও আল কায়েদার সংশ্লিষ্টতা ও বাংলাদেশে গুপ্তহত্যা ও সন্ত্রাসী হামলা চালানোর ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনে সিঙ্গাপুর পুলিশ। দেশে আসার পর এ পাঁচ বাংলাদেশীকে আটক করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। পরে তাদের বিরুদ্ধে গত ৩ মে সন্ত্রাস দমন আইনে রামপুরা থানায় মামলা দায়ের করা হয়। সিঙ্গাপুর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উদ্ধৃতি দিয়ে সিঙ্গাপুরের স্ট্রেইট টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশেকে একটি ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করছিল উগ্রবাদী জঙ্গীরা। আর সেজন্য দেশের বাইরে সিঙ্গাপুরে জড়ো হচ্ছিল তারা। এর আগে ২৭ বাংলাদেশীকে আটক করার পর মাত্র চার মাসের মাথায় আবারও সিঙ্গাপুরে জঙ্গী সন্দেহে আরও ১৩ বাংলাদেশীকে আটক করা হয়। সন্দেহভাজন এসব ব্যক্তির মূল পরিকল্পনা ছিল সিরিয়ায় গিয়ে জঙ্গীগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটে (আইএস) যোগ দেয়া। নিজেদের দলকে তারা ‘ইসলামিক স্টেট ইন বাংলাদেশ’ (আইএসবি) নামে অভিহিত করেছিল। মধ্যপ্রাচ্য সফর করা কঠিন মনে হওয়ায় তারা বাংলাদেশে ফিরে সহিংস কায়দায় সরকার উৎখাতের চিন্তা করে তারা। এবার দ্বিতীয় দফায় ১৩ জনকে আটক করে সিঙ্গাপুর কর্তৃপক্ষ। আর আটজনকে সিঙ্গাপুরে জিজ্ঞাসাবাদ করার পর দুই বছরের আটকাদেশ দিয়ে সে দেশের কারাগারে রাখা হয়েছে। এর মধ্যে পাঁচজনকে ঢাকায় পাঠানোর পর গ্রেফতার করে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। পুলিশ সদর দফতরের একজন কর্মকর্তা বলেন, সারাবিশ্বে আইএসের নামে উগ্রবাদীরা যখন ধর্মের নামে জিহাদ ঘোষণা করেছে, তখন সিঙ্গাপুরে বাংলাদেশী জঙ্গী-সন্ত্রাসীরা নতুন করে সংগঠন তৈরি ও তার বিস্মৃতি ঘটানোর চেষ্টা করার খবরটি ভাবমূর্তি ক্ষুণœ করছে। একদিকে স্বাধীনতাবিরোধীরা যে কোন উপায়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচালের অপচেষ্টা চালাচ্ছে, অপরদিকে সিঙ্গাপুরে আইএসের বাংলাদেশী সংগঠন গঠনের চেষ্টা চালানোর খবরের ঘটনার সতত্যার প্রশ্নের চেয়েও বিব্রতকর অবস্থার দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
×