ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

রেলের জমি বরাদ্দে নীতিমালা মানা হচ্ছে না

প্রকাশিত: ০৫:৪৪, ৮ মে ২০১৬

রেলের জমি বরাদ্দে নীতিমালা মানা হচ্ছে না

মাকসুদ আহমদ, চট্টগ্রাম অফিস ॥ রেলের জমি বরাদ্দে নীতিমালা রয়েছে ঠিকই। কিন্তু নীতিমালা মানছে না মন্ত্রণালয়। নীতিমালার আলোকে ভূমি বরাদ্দের জন্য আবেদনকারীরা বছরের পর বছর অপেক্ষমাণ রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, বৈধ আবেদনকারীদের ভূমি বরাদ্দ না দিয়ে বছরের পর বছর ফাইলবন্দী করে রাখা হয়েছে। সেই সুযোগে রেল কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সিন্ডিকেট ছাড়াও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় থাকারাও পিছিয়ে নেই অবৈধ নির্মাণ থেকে। কিন্তু অবৈধ দখলদাররা রেল ভূমি বরাদ্দে কোন ধরনের আবেদন না করেই ভাড়া বাণিজ্য চালিয়ে আসছে। অথচ বছরে প্রায় শতকোটি টাকার রাজস্ব আদায়ের সম্ভাবনা রয়েছে অবৈধ দখলদারদের কাছ থেকে। ফলে রাজস্ব হারাচ্ছে রেল কর্তৃপক্ষ। শতকোটি টাকা রাজস্ব আদায়ের সম্ভাবনা এখন হিমঘরে। অভিযোগ রয়েছে, রেল মন্ত্রণালয় বার বার সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের ফলে ভূসম্পত্তি বিভাগও বেসামাল অবস্থায় রয়েছে। মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তহীনতার কারণে এ ধরনের ক্ষতি গুনতে হচ্ছে সরকারকে। উল্লেখ্য, গত বছরের অক্টোবরে ক্ষতিপূরণ ফি দিয়ে ও বিধিসম্মত নিয়মে যারা আবেদন করেছেন তাদের একটি তালিকা প্রণয়নের কথা ছিল। কিন্তু মন্ত্রণালয় তালিকার খবর না নিয়ে দফায় দফায় সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের কারণে ফাইলবন্দী রয়েছে ছয় মাস। রেল ভবনের এস্টেট বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, গত অক্টোবরে রেল মন্ত্রণালয়ের এক বৈঠকে বছরের পর বছর অপেক্ষমাণ থাকা আবেদনকারী ও ক্ষতিপূরণের মাধ্যমে রেল ভূমি ব্যবহারকারীদের তালিকা প্রণয়নের নির্দেশনা দেয়া হয়। এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের একান্ত সচিব, মহাপরিচালকের একান্ত সচিব ও জিএম পূর্ব এবং পশ্চিমকে চিঠি প্রেরণ করা হয়েছিল। এদিকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত গত রবিবারের বৈঠকে রেল ভূমিতে অবৈধ দখলদারদের বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা গ্রহণসহ সর্বোচ্চ সাত বছরের কারাদ-ে দ-িত করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, নীতিমালা অনুযায়ী বৈধভাবে আবেদনকারীদের লাইসেন্স প্রণয়নের বিষয়ে কোন ধরনের সিদ্ধান্ত না নেয়ার বিষয়টি। আবার রেল ভূমি বরাদ্দের নীতিমালা থাকার পরও কিভাবে বৈধ ও বিধিসম্মত আবেদনকারী ও ক্ষতিপূরণ প্রদানকারীদের বিরুদ্ধে কিভাবে আইনী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। উল্লেখ্য, রেলের প্রায় ২৪ হাজার একর জায়গার মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশই অবৈধ দখলদারের হাতে রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, রেল ভূমিতে প্রণয়নকৃত মাস্টারপ্ল্যানের আওতায় থাকা আবেদনকারী ও ক্ষতিপূরণের অর্থ আদায়কারীদের তালিকা প্রণয়নের জন্য স্টেশনভিত্তিক ও বিভাগওয়ারী ভূসম্পত্তি বিভাগকে তিন মাসের সময়সীমা বেঁধে দেয়া হলেও উপেক্ষিত হয়েছে। কোন ধরনের তালিকা প্রণয়ন না করায় ভূমি ব্যবহারকারীদের কাছ থেকে রাজস্ব আদায় করতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। এর কারণ হিসেবে দেখা গেছে, জনবল সঙ্কটের কারণে ভূসম্পত্তি বিভাগগুলো তালিকা প্রণয়ন করতে পারেনি। গত বছরের ২ নবেম্বর পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান ভূসম্পত্তি কর্মকর্তার দফতর থেকে বিভাগীয় ভূসম্পত্তি কর্মকর্তার দফতরে এ ধরনের তালিকা প্রণয়নের জন্য চিঠি প্রেরণ করা হয়। দীর্ঘ ছয় মাসেও তালিকা প্রেরণ করা হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে। আরও অভিযোগ রয়েছে, কিছু কিছু এলাকায় মাস্টারপ্ল্যান অনুমোদন করে টেন্ডার আহ্বান করা হলে ওই টেন্ডারের বিরুদ্ধে অবৈধ দখলদাররা মামলা নিবন্ধনের মধ্য দিয়ে আদালত থেকে বিভিন্ন ধরনের স্থগিতাদেশ জারি করে টেন্ডার কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছে। এ ছাড়াও কিছু কিছু ভূমি উচ্ছেদ করা হলেও কর্তৃপক্ষের নজরদারি না থাকায় পুনরায় বেদখল হয়ে যাচ্ছে। এ ধরনের ঘটনায় অবৈধ দখলদারদের চক্রান্তে পড়ে বৈধলাইসেন্সধারীরাও রাজস্ব পরিশোধে অনীহা প্রকাশ করছে। জানা গেছে, ২০১২ সালের ১৯ ডিসেম্বর মহাপরিচালকের দফতরে পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান ভূসম্পত্তি কর্মকর্তার দফতর থেকে রেল ভূমি ব্যবহারে ক্ষতিপূরণ আদায় ও লাইসেন্স প্রদানের জন্য চিঠি প্রেরণ করা হয়। ওই চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০০৬ সালের ১৫ মার্চ জারিকৃত ও প্রচলিত নীতিমালায় ক্ষতিপূরণ আদায়ের বিধান রাখা হয়নি। কিন্তু রেলভূমি বরাদ্দের নির্দেশনা রয়েছে। ফলে পূর্বাঞ্চলীয় বিভিন্ন স্টেশন সংলগ্ন এমনকি বিভাগীয় শহরে অনুমোদিত মাস্টারপ্ল্যানভুক্ত ভূমিতে অবৈধভাবে ব্যবসা পরিচালনা করছে অনেকেই। আবার নীতিমালা অনুযায়ী আবেদনকারী ও ক্ষতিপূরণদাতা ব্যবসায়ীরা অনেক বছর ধরে ব্যবসা পরিচালনা করলেও বৈধতার জন্য লাইসেন্স দাবি করলেও তা দেয়া হয়নি। বরং ক্ষতিপূরণ আদায় বন্ধ রাখা হয়েছে। এক্ষেত্রে পরামর্শ দেয়া হয়েছে মাস্টারপ্লান অনুমোদন করে টেন্ডার আহ্বান করা হলে প্রায় শতকোটি টাকা রাজস্ব আদায় সম্ভব। সর্বশেষ গত বছরের অক্টোবর রেল মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত বৈঠকের সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে, রেল ভূমিতে থাকা ও মাস্টারপ্ল্যানের আওতাভুক্ত জায়গায় অবৈধভাবে বসবাসকারীদের তালিকা প্রণয়নের জন্য নির্দেশনা দেয়া হয়। সে নির্দেশনা অনুযায়ী গত বছরের ২৫ অক্টোবর পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান ভূসম্পত্তি কর্মকর্তার তত্ত্ব¡াবধানে এক সমন্বয় সভা অনুষ্ঠিত হয়। এ সভায় পূর্বাঞ্চলে এখতিয়ারবুক্ত সকল স্টেশন এলাকায় বৈধ ও অবৈধ দখলদারের তালিকা প্রণয়ন করে মাস্টারপ্ল্যান চিহ্নিতকরণ এবং অবৈধ দখলদারদের তালিকা প্রস্তুতের নির্দেশনা দেয়া হয়। মাস্টারপ্ল্যানভুক্ত জায়গায় যারা অবৈধভাবে ব্যবসা করছে তাদের তালিকা প্রণয়নেরও নির্দেশনা দেয়া হয়। মাত্র তিন মাস সময় বেঁধে দেয়া হলেও গত ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত ছয় মাস অতিক্রান্ত হয়েছে। এখনও পর্যন্ত বিভাগীয় ভূসম্পত্তি কর্মকর্তার দফতর থেকে কোন ধরনের তালিকা প্রণয়ন করা হয়নি। ফলে বৈধ আবেদনপত্রের ভিত্তিতে লাইসেন্সের অপেক্ষায় থাকারা যেমন মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় রয়েছে, তেমনি ক্ষতিপূরণ প্রদানকারীরাও চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে ব্যবসা পরিচালনা করছে। মূলত রেলের নীতিমালা অনুযায়ী বাংলাদেশী নাগরিককে ভ’ূমি বরাদ্দের নিয়ম রয়েছে। কিন্তু মুষ্টিমেয় স্বার্থান্বেষী মহলের কারণে নীতিমালা যেমন উপেক্ষিত হচ্ছে, তেমনি হয়রানির শিকার হচ্ছে বৈধভাবে লাইসেন্সের আবেদনকারীরা। এ ব্যাপারে পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান ভূসম্পত্তি বিভাগের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, নীতিমালা অনুযায়ী ক্ষতিপূরণ আদায় করা দখলদারদের কাছ ও বিধিসম্মতভাবে যেসব আবেদনকারী বরাদ্দের অপেক্ষায় রয়েছে তাদের লাইসেন্স প্রদানের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। এতে উভয় জোন থেকে প্রায় শতকোটি টাকা রাজস্ব আদায় সম্ভব। এ ছাড়া যারা অবৈধ দখলদার রয়েছে তাদের কাছ থেকেও শর্ত সাপেক্ষে রাজস্ব আদায় করা হলে আরও শতকোটি টাকা রাজস্ব আদায় সম্ভব। এ ব্যাপারে ২০১২ সালে মহাপরিচালকের দফতরে চিঠি প্রেরণ করা হয়েছিল। এরপর ২০১৫ সালের অক্টোবরে আবার মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ক্ষতিপূরণ প্রদানকারী ও বিধিসম্মত আবেদনকারীদের তালিকা প্রণয়নের কথা বলা হলেও গত রবিবার আবারও ব্যতিক্রমী সিদ্ধান্ত দেয়া হয়েছে।
×