ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

নারী ভোটারের দীর্ঘ লাইন, শান্তিপূর্ণ ভোট মুন্সীগঞ্জ ও বগুড়ায়

প্রকাশিত: ০৫:৩৮, ৮ মে ২০১৬

 নারী ভোটারের  দীর্ঘ লাইন,  শান্তিপূর্ণ ভোট মুন্সীগঞ্জ ও  বগুড়ায়

সমুদ্র হক ॥ সকালের এক পসলা বৃষ্টি গ্রীষ্মের দুপুরের দাবদাহ কমিয়ে জানান দেয় নির্বাচনের দিনটি ভালই কেটে যাবে। হলোও তাই। বগুড়ার শেরপুর ও নন্দীগ্রামের ১৫টি ইউনিয়নের ভোটগ্রহণ দু’একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া শেষ পর্যন্ত শান্তিপূর্ণভাবেই শেষ হয়েছে। দুপুরের পর বৃষ্টির মধ্যেও ভোটাররা কাদা-পানিতেও আনন্দের সঙ্গে কেন্দ্রে গেছে। বগুড়ার দক্ষিণে জাতীয় মহাসড়কের ধারে শেরপুর উপজেলার ভেতরে কিছুদূর গিয়ে গাড়িদহ ইউনিয়নের মহীপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্র। সকাল সাড়ে নয়টার দিকে গিয়ে দেখা যায় পুরুষের চেয়ে নারী ভোটারদের দীর্ঘ লাইন। ভোটার আয়েশা বেগম বললেন, ‘দুপরত (দুপুরে) রোদ উঠে বেশি গরম পড়লে লাইনত দাঁড়ে থাকতে কষ্ট হবি, তাই বৃষ্টির পর ঠা-ায় ঠা-ায় আচ্চি (এসেছি)।’ তার সঙ্গে তাল মেলালেন আরও কয়েকজন। আরেক গৃহিণী নূরজাহান বললেন, তাড়াতাড়ি ভোট দিলে বাড়িতে গিয়ে ঘর গৃহস্থালি করা যাবে। পুরুষদের ভোটের লাইনে থাকা আব্দুল কুদ্দুস বললেন, অনেক কিষান পাট-ধান কাটছে। তারা দুপুরের পর ভোটকেন্দ্রে আসবে ভোট দিতে। উপজেলা নির্বাচন অফিসার মোঃ আনিসুর রহমান বললেন, ‘ইলেকশন সুষ্ঠুভাবেই হচ্ছে। ভোটাররা সুশৃঙ্খলভাবে ভোট দিতে পারছেন। সকাল দশটার দিকে শুভগাছা ভোটকেন্দ্রে লোকজনের ছোটাছুটি দেখে ভেতরে গিয়ে জানা যায়, দুই মেম্বার প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে চড়া কণ্ঠে বাগ্বিত-ার রেশ ধরে ভোটারদের মধ্যে ভীতির সঞ্চার হওয়ায় কিছু না বুঝেই ছোটাছুটি শুরু করে দেয়। পরে বাগ্বিত-ার লোকজনই ভোটারদের কেন্দ্রে নিয়ে আসে। এ সময় পুলিশ ও র‌্যাব তৎপর হয়ে ওঠে। সকাল সাড়ে দশটার দিকে কিছুটা কাঁচা রাস্তা ধরে শাহবন্দেগী ইউনিয়নের ধড়মোকাম উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে নারী-পুরুষের দীর্ঘ লাইন চোখে পড়ে। প্রিসাইডিং অফিসার জানালেন, এই কেন্দ্রে ভোটার সংখ্যা দুই হাজার ২শ’ ৩৫ জন। উল্লিখিত সময়ের মধ্যে প্রায় ৪০ শতাংশ ভোটগ্রহণ করা গেছে। এই দিন সকালে বৃষ্টি হওয়ায় ভোটাররা আগেভাগেই কেন্দ্রে আসে। এই কেন্দ্রে চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আল আমীনকে কেন্দ্র পরিদর্শন করতে দেখা গেল। বললেন, শান্তিপূর্ণভাবেই ভোটগ্রহণ হচ্ছে। তবে উল্টো কথা বললেন বিএনপি দলীয় প্রার্থী আব্দুর রহমান। শেরপুর বাসস্ট্যান্ডে তার সঙ্গে কথা হয়। বললেন, আওয়ামী লীগের ক্যাডাররা ভোটকেন্দ্রে গিয়ে ব্যালট পেপারে সিল দিয়েছে। এ বিষয়ে ভোটকেন্দ্রের পোলিং অফিসারগণ বললেন, বাইরের কেউ ব্যালট পেপারে সিল দেয়নি। ভোটাররা ভোটকক্ষে গিয়েই পছন্দের প্রার্থীদের ভোট দিয়েছে। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে মির্জাপুর ইউনিয়নের সুখানগাড়ী সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে গিয়ে চোখে পড়ে বেশ সুনসান অবস্থা। লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন অল্প ভোটার। কর্তব্যরত এক আনসার সদস্যকে লাঠি হাতে অলস সময় কাটাতে দেখা গেল। আলোকচিত্রীকে দেখে তিনি ছবি তোলা হবে ভেবে দাঁড়িয়ে পোজ দিলেন। বললেন, এই কেন্দ্রে সকাল ৮টা থেকেই লোকজন এসে ভোট দিয়ে যায়। অভিজ্ঞতা থেকে বললেন, ‘গ্রামের ভোটকেন্দ্র। কিষান পাট-ধান কাট্য খাওয়া-দাওয়া করে রয়েসয়ে বিকেলের দিকে আস্যে ভিড় করবি।’ এরই মধ্যে মোজাম্মেল হক নামের এক ভোটার তার সঙ্গীকে বললেন, ‘তাড়াতাড়ি ভোট দিয়্যে আয় হে। অয়া থাকিস ন্য। ভিউত যাওয়া লাগবি। বাকি ধান কয়ডা কাট্যে আনি চল।’ বোঝা গেল এই সময়টায় ধান কাটা শেষের দিকে। এরই মধ্যে নির্বাচনও হচ্ছে। এই ইউনিয়নের রিটার্নিং অফিসার উপজেলা সমবায় অফিসার মোঃ ফেরদৌস রহমান বললেন, আবহাওয়া কিছুটা শীতল থাকায় ভোটাররা বেশ ভালভাবেই ভোট দিতে পারছে। শেরপুর থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার ভেতরে ভবানীপুর ইউনিয়ন। অপরিসর সরু কাঁচা সড়ক দিয়ে যাওয়ার পর হলদিবাড়ী ভোটকেন্দ্রে গিয়ে চোখে পড়ল ভোটাররা বেশ খোশমেজাজেই কেন্দ্রের বাইরে জট পাকিয়ে কে নির্বাচনে জিতবে তার বিশ্লেষণ শুরু করে দিয়েছে। এলাকার প্রাচীন কীর্তি ভবানীপুর মন্দিরের কাছে প্রায় মেলার মতো বসেছে। কয়েকটি দোকানপাট আছে। নির্বাচনকে ঘিরে চায়ের দোকান বসেছে বেশ কয়েকটি। আড্ডা হচ্ছে প্রতিটি পয়েন্টে। ইউনিয়নের দিঘাই প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে দুপুর সাড়ে বারোটার দিকে গিয়ে জানা যায়, প্রায় ৫০ শতাংশ ভোট প্রদান হয়েছে। প্রিসাইডিং অফিসার আশা করছেন, শেষ পর্যন্ত সুন্দরভাবেই ভোটগ্রহণ করা যাবে নির্ধারিত সময় বিকেল ৪টার মধ্যেই। এই ইউনিয়নের রিটার্নিং অফিসার উপজেলা প্রানিসম্পদ অফিসার একেএম আনোয়ারুল হক জানালেন, মাঠপর্যায়ের এই নির্বাচনে নারী ভোটাররা স্বতঃস্ফূর্তভাবেই ভোটকেন্দ্রে আসে। ইউনিয়নের প্রতিটি কেন্দ্রেই সুষ্ঠুভাবে ভোটগ্রহণ করা হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পুলিশ র‌্যাব বিজিবিকে টহল দিতে দেখা যায়। শেরপুর উপজেলার প্রবীণ ব্যক্তি সাহিত্যিক ডাঃ রহমতুল বারী বললেন, তিনি নিজ উদ্যোগে খোঁজখবর করে জেনেছেন ইলেকশন সুষ্ঠুভাবেই হচ্ছে। শেরপুর মহিলা কারিগরি ও প্রযুক্তি কলেজের অধ্যক্ষ বেলাল হোসেন আশাবাদী হয়ে বলেন, এভাবে প্রতিটি ইলেকশন আনন্দঘন পরিবেশে হলে ইলেকশন বড় উৎসবে পরিণত হবে। পদ্মাপাড়ে ভোট দিয়েছেন সবাই ফুরফুরে মেজাজে ॥ মীর নাসিরউদ্দিন উজ্জ্বল, দীঘিরপাড় (মুন্সীগঞ্জ) থেকে জানান, সেলিনা বেগম (৪৫) জীবনে অন্তত নয়বার ভোট দিয়েছেন। তবে এবারের ভোট দিয়ে তার বেশ ভাল লাগছে। ভোটের পড়ন্ত বেলা বিকেল সাড়ে ৩টায় স্বামীর সঙ্গে এলেন ভোটকেন্দ্রে। ফুরফুরে মেজাজে ভোট দিয়ে বেরোলেন। বললেন, এমন সুষ্ঠু পরিবেশে ভোট দিয়ে যেমন শান্তি, যারা বিজয়ী হবেন কিংবা বিজয়ী হতে পারবেন না তাদের মধ্যেও একটা বিশেষ শান্তি কাজ করবে। এটি একেবারে পদ্মাঘেঁষা দীঘিরপাড় ইউপি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। এই ভোটকেন্দ্রের ১১৭৪ ভোটের মধ্যে তখন ৯শ’র বেশি ভোটার ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছেন। সব প্রার্থীর এজেন্টও খুশি। এর একটু পাশেই দীঘিরপাড় বাসস্ট্যান্ড। রাস্তার পূর্বপারে নৌকার ক্যাম্প। ওপারে ধানের শীষের ক্যাম্প। দুই ক্যাম্পেই প্রার্থী ও নেতাকর্মীবেষ্টিত। নির্বাচন শেষে এখান থেকেই বিজয় আর পরাজয়ের স্বাদ গ্রহণে প্রস্তুত। সহাবস্থান। দুই প্রার্থীই খুশি। তাদের সঙ্গে কথা বলতে বলতেই ঘড়ির কাঁটায় বিকেল ৪টা। ভোটগ্রহণ শেষ। সবদিক থেকে খবর এলো সুষ্ঠু নির্বাচন হয়েছে। উভয় মেরুতেই স্বস্তি। নৌকা এবং ধানের শীষের কা-ারি দুই প্রার্থীই খুশি। দীঘিরপাড়ের ভোটার সাজেদ খান, পারভেজ হালদার, সাগর হালদার, মোহাম্মদ হোসেন খান, আরিফুর রহমান সকলের মুখে একই সুরÑ এত সুষ্ঠু ভোট ইতিহাসে বিরল। শাহিন খান বললেন, এককথায় বলা যায়- প্রকৃত গণতন্ত্রের ভোট উৎসব হয়েছে এবার দীঘিরপাড়ে। আর সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ভুতু হালদার জানালেন, ব্রিটিশ আমল থেকেই ভোট সুষ্ঠু হয় এখানে। তবে এবার বেশিই সুষ্ঠু হয়েছে, ইতিহাস। তারই পুত্র বর্তমান চেয়ারম্যান আরিফ হালদার নৌকা নিয়ে নির্বাচন করছেন। তার প্রতিদ্বন্দ্বী সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান ওয়ালী উল্লাহ খান ধানের শীষ নিয়ে নির্বাচন করছেন। তিনি আগে নির্বাচন করেছেন ভুতু হালদারের সঙ্গেও। তিনি বলেন, নির্বাচন এত সুষ্ঠু হয়েছে নির্বাচিত না হলেও কষ্ট নেই। ভোটের জয় হয়েছে। উভয় মেরুই সবগুলো অর্থাৎ নয়টি কেন্দ্রের ভোটেই সন্তুষ্ট। দুপুর এবং বিকেলে খানিকক্ষণ গ্রীষ্মের বৃষ্টি হলেও ভোটে ব্যাঘাত হয়নি। বরং দাবদাহের পরিবর্তে প্রশান্তি ছড়িয়েছে। পদ্মায় পানি বৃদ্ধি আর ঢেউয়ের দাপাদাপি থাকলেও প্রশান্তি ছড়িয়ে দেয় প্রার্থীদের মাঝে। দীঘিরপাড় স্বাস্থ্যকেন্দ্রের প্রিসাইডিং অফিসার রানা সফিউল্লাহ কলেজের প্রভাষক গোলাম হাসনাইন জানান, সব দলেরই এজেন্ট সহযোগিতা করেছে বলেই এত সুষ্ঠু হয়েছে। উৎসবমুখর পরিবেশে ভোট কাস্টও হয়েছে ভাল। চতুর্থ দফায় শনিবার মুন্সীগঞ্জে ১৫ ইউপিতে ভোটগ্রহণ হয়েছে। এর মধ্যে দীঘিরপাড় ইতিহাস সৃষ্টি করলেও অন্যান্য ইউনিয়নে বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা ঘটেছে। ১৪৯টি কেন্দ্রে মধ্যে তিনটি কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ বাতিল করা হয়েছে ব্যালট পেপার ছিনতাইয়ের কারণে। এগুলো হলোÑ টঙ্গীবাড়ি উপজেলার যশলং ইউপির টুনিসার নয়াদীঘিরপাড় এবং সেরাজাবাদ প্রাথমিক বিদ্যালয় ও সদর উপজেলার রামপালে কাজী কসবা প্রাথমিক বিদ্যালয়। এছাড়া সংঘর্ষ এবং ককটেল বিস্ফোরণ, জাল ভোটসহ কয়েকটি কেন্দ্রে বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা ঘটে। তবে গ্রীষ্মের সকালে ধলেশ্বরী তীরের নয়াগাঁও সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে গিয়ে মন ভরে যায়। সবচেয়ে আলোচিত পঞ্চসার ইউপির এই কেন্দ্রেটিতে নারী-পুরুষের লম্বা লাইন দেখে যে কেউই বিস্মিত হবে। সকাল সাড়ে ৮টায় এই কেন্দ্রে দেখা মেলে এডিসি মোহা. হারুন-অর-রশীদের সঙ্গে। তিনি বলেন, ভোট শুরু হয় ৮টায়, কিন্তু সকাল ৭টা থেকেই এখানে লাইন পড়ে যায়। এই দৃশ্য ভোট উৎসবের চেয়ে বেশি কিছু বলতে হয়। ধর্ম-বর্ণ, যুবক, পৌঢ়, বৃদ্ধসহ নানা বয়সী মানুষ দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে ভোট প্রদান করে। ভোটারদের লম্বা লাইন লক্ষ্য করা গেছে প্রায় সব কেন্দ্রেই। তবে বেলা বাড়তেই এই লাইন ছোট হতে থাকে। রামপাল সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সকাল ১০টায় গিয়ে দেখা যায় লম্বা লাইন। দক্ষিণ দেওসার গ্রামের আশি বছরের বৃদ্ধা নুর বানু জানান, শরীরটা ভাল যাচ্ছে না, তারপারও ভোট দিতে কার না ভাল লাগে।
×