ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আজ রবীন্দ্র জয়ন্তী

চির নূতনেরে দিল ডাক পঁচিশে বৈশাখ

প্রকাশিত: ০৫:৩৬, ৮ মে ২০১৬

 চির নূতনেরে দিল ডাক পঁচিশে বৈশাখ

মোরসালিন মিজান ॥ আজি মোর/ জন্মের স্মরণপূর্ণ বাণী,/ প্রভাতের রৌদ্রেÑ লেখা লিপিখানি/ হাতে করে আনি/ দ্বারে আসি দিল ডাক/...উদয় দিগন্তে ওই শুভ্র শঙ্খ বাজে।/ মোর চিত্ত-মাঝে/ চির নূতনেরে দিল ডাক/ পঁচিশে বৈশাখ। ডাক এসেছে চির নূতনের। আজ রবির আলোয় উদ্ভাসিত ২৫ বৈশাখ। ১৫৫তম রবীন্দ্রজয়ন্তী। ১২৬৮ বঙ্গাব্দের এই দিনে কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সঙ্গীতের এই কিংবদন্তি পুরুষ। রবীন্দ্রজয়ন্তী উপলক্ষে তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মোঃ আব্দুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। রবীন্দ্রনাথের লেখা, দর্শন, চিন্তাচেতনা, তথা বহুমাত্রিক আলোকছটার ঔজ্জ্বল্যে বাঙালীর জাতিসত্তা হয়েছে গৌরবান্বিত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা সাহিত্যকে বিশ্বের দরবারে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। বহু ভাষায় অনূদিত হয়েছে তাঁর সাহিত্য। ১৯১৩ সালে ‘গীতাঞ্জলি’ কাব্যগ্রন্থের জন্য সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার অর্জন করেন তিনি। তাঁর এ প্রাপ্তি বাংলা সাহিত্যকে বিরল গৌরব এনে দেয়। বাঙালীর চেতনার রং স্পষ্ট হয়েছিল রবির আলোয়। বাঙালীর প্রতিটি আবেগ আর সূক্ষ্ম অনুভূতিকে স্পর্শ করে আছেন তিনি। রবীন্দ্রনাথ এমন এক সময় জন্মগ্রহণ করেন যখন রাষ্ট্র ছিল পরাধীন। চিন্তা ছিল প্রথাগত ও অনগ্রসর। এই সময় বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে বিশ্বমানে উন্নীত করার পাশাপাশি জাতির চিন্তাজগতে আধুনিকতার বীজ বুনে দিয়েছিলেন তিনি। বাঙালীর মানস গঠনে পালন করেছিলেন অগ্রদূতের ভূমিকা। বাঙালীকে আবেগ-অনুভূতি প্রকাশের ভাষা দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁদের দেখার দৃষ্টিকে প্রসারিত করেছেন। সৃষ্টির প্রেরণা দিয়েছেন। বাঙালীর শিক্ষায়, নান্দনিক বোধে, সাংস্কৃতিক চর্চায়, দৈনন্দিন আবেগ-অনুভূতির অভ্যাসে এবং সাহিত্য-সঙ্গীত-শিল্পকলায় সারাক্ষণ আছেন তিনি। আছেন আমাদের নিশ্বাসে-বিশ্বাসে, বুদ্ধি-বোধে-মর্মে-কর্মে। তাই তিনি আমাদের লোক। তাকে আমরা পাই প্রেমে, প্রতিবাদে, আন্দোলনের অঙ্গীকারে এবং স্রষ্টার আরাধনার নিবিষ্টতায়। আমাদের গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধে আমরা তাঁকে পেয়েছি আত্মশক্তিরূপে। এই মহামানবের জন্মদিন উদ্যাপন মানে বাঙালীর আত্মপরিচয়ে প্রত্যয়দীপ্ত হওয়া। আজ তাই তাঁকে গভীর শ্রদ্ধা ও ভালবাসায় স্মরণ করবে সারা বিশ্বের বাঙালী। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজ কর্মের মাধ্যমে সূচনা করে গেছেন একটি কালের। একটি সংস্কৃতির। কৈশোর পেরোনোর আগেই বাংলা সাহিত্যের দিগন্ত বদলে দিতে শুরু করেন তিনি। তাঁর পরিণত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পরিণত হয়েছে বাঙালীর শিল্প-সাহিত্য। বাংলা ভাষার সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক রবীন্দ্রনাথের ৫২টি কাব্যগ্রন্থ, ৩৮ নাটক, ১৩ উপন্যাস ও ৩৬ প্রবন্ধ ও অন্যান্য গদ্য সঙ্কলন প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর সর্বমোট ৯৫ ছোটগল্প ও ১৯১৫ গান যথাক্রমে গল্পগুচ্ছ ও গীত বিতান সঙ্কলনের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের যাবতীয় প্রকাশিত ও গ্রন্থাকারে অপ্রকাশিত রচনা ৩২ খ-ে রবীন্দ্ররচনাবলী নামে প্রকাশিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের কাব্যসাহিত্যের বৈশিষ্ট্য ভাবগভীরতা, গীতিধর্মিতা চিত্ররূপময়তা, অধ্যাত্মচেতনা, ঐতিহ্যপ্রীতি, প্রকৃতিপ্রেম, মানবপ্রেম, স্বদেশপ্রেম, বিশ্বপ্রেম, রোমান্টিক সৌন্দর্যচেতনা, ভাব, ভাষা, ছন্দ ও আঙ্গিকের বৈচিত্র্য, বাস্তবচেতনা ও প্রগতিচেতনা। রবীন্দ্রনাথের গদ্যভাষাও কাব্যিক। ভারতের ধ্রুপদী ও লৌকিক সংস্কৃতি এবং পাশ্চাত্য বিজ্ঞানচেতনা ও শিল্পদর্শন তাঁর রচনায় গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিল। কথাসাহিত্য ও প্রবন্ধের মাধ্যমে তিনি সমাজ, রাজনীতি ও রাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে নিজ মতামত প্রকাশ করেছিলেন। সাহিত্যের পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথের গান বাংলা সঙ্গীত ভা-ারকে দারুণভাবে সমৃদ্ধ করেছে। আজকের বদলে যাওয়া সময়েও বিপুল ঐশ্বর্য নিয়ে টিকে আছে রবীন্দ্রসঙ্গীত। এর আবেদন কোন দিন ফুরোবার নয়। বরং যত দিন যাচ্ছে ততই রবীন্দ্রসঙ্গীতের বাণী ও সুরের ইন্দ্রজালে নিজেকে জড়িয়ে নিচ্ছে বাঙালী। তাঁদের আবেগ-অনুভূতি কবিগুরুর গানের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। রবীন্দ্রনাথের লেখা ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’ গানটি বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের জাতীয় সঙ্গীতেরও রচয়িতা তিনি। বহু প্রতিভার অধিকারী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রায় সত্তর বছর বয়সে নিয়মিত ছবি আঁকা শুরু করেন। ১৯২৮ থেকে ১৯৩৯ সালের মধ্যে অঙ্কিত তাঁর স্কেচ ও ছবির সংখ্যা আড়াই হাজারের বেশি। দক্ষিণ ফ্রান্সের শিল্পীদের উৎসাহে ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে তাঁর প্রথম চিত্র প্রদর্শনী হয় প্যারিসের পিগাল আর্ট গ্যালারিতে। এরপর সমগ্র ইউরোপেই কবির একাধিক চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। তাঁর আঁকা ছবিতে আধুনিক বিমূর্তধর্মিতাই বেশি প্রস্ফুটিত হয়েছে। মানবতাবাদী এ কবি মানুষের ওপর দৃঢ়ভাবে আস্থাশীল ছিলেন। তাঁর মতে, মানুষই পারে অসুরের উন্মত্ততাকে ধ্বংস করে পৃথিবীতে সুরের রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে। তাই ‘সভ্যতার সঙ্কট’ প্রবন্ধে তিনি লিখেছিলেনÑ ‘মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ।’ ১৯১৫ সালে ব্রিটিশ সরকার তাঁকে নাইট উপাধিতে ভূষিত করে। কিন্তু ১৯১৯ সালে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকা-ের প্রতিবাদে সেই উপাধি বর্জন করেন রবীন্দ্রনাথ। সমাজের কল্যাণেও নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সমাজকল্যাণের উপায় হিসেবে তিনি গ্রামোন্নয়ন ও গ্রামের দরিদ্র জনসাধারণকে শিক্ষিত করে তোলার পক্ষে মত প্রকাশ করেন। এর পাশাপাশি সামাজিক ভেদাভেদ, অস্পৃশ্যতা, ধর্মীয় গোঁড়ামি ও ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে তিনি তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের দর্শনচেতনায় ঈশ্বরের মূল হিসেবে মানব সংসারকেই নির্দিষ্ট করা হয়েছে। তিনি দেববিগ্রহের পরিবর্তে কর্মী অর্থাৎ মানুষ ঈশ্বরের পূজার কথা বলেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ জীবনের শেষ চার বছর ঘন ঘন অসুস্থতার মধ্য দিয়ে গেছেন। এ সময়ের মধ্যে দুই বার অত্যন্ত অসুস্থ অবস্থায় শয্যাশায়ী থাকতে হয়েছিল কবিকে। ১৯৩৭ সালে একবার অচৈতন্য হয়ে গিয়েছিলেন। আশঙ্কাজনক অবস্থা হয়েছিল। তখন সেরে উঠলেও ১৯৪০ সালে অসুস্থ হওয়ার পর আর তিনি সেরে ওঠেননি। প্রথম জীবনে ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলীতে কবি লিখেছিলেনÑ মরণ রে,/ তুঁহু মম শ্যামসমান... মৃত্যু অমৃত করে দান। একইভাবে মৃত্যুকে জীবনের নিস্তাররূপে বর্ণনা করে তিনি উচ্চারণ করেনÑ প্রেম বলে যে যুগে যুগে, তোমার লাগি আছি জেগে, মরণ বলে আমি তোমার জীবনতরী বাই। জীবনের শেষ দিকে এসে কবি জীবনের প্রতি নিজের তৃষ্ণার কথা জানিয়ে লেখেন বিখ্যাত সেই পঙ্ক্তিÑ মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে/ মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই। বলাই বাহুল্য, মানবের মাঝে রবীন্দ্রনাথের বেঁচে থাকার এ স্বপ্ন শতভাগ পূর্ণতা পেয়েছে। কবির ভাষায়Ñ তখন কে বলে গো সেই প্রভাতে নেই আমি।/ সকল খেলায় করবে খেলা এই আমিÑ আহা,/ নতুন নামে ডাকবে মোরে, বাঁধবে নতুন বাহু-ডোরে,/ আসব যাব চিরদিনের সেই আমি।... হ্যাঁ, রবীন্দ্রনাথ চিরদিনের। চির নূতন তিনি। নব নব রূপে তিনি আসেন। আসবেন। রাষ্ট্রপতির বাণী ॥ বিশ্বকবির ১৫৫তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে দেয়া বাণীতে রাষ্ট্রপতি মোঃ আব্দুুল হামিদ বলেছেন, রবীন্দ্রনাথের বিশালতা এবং তাঁর সৃষ্টির অপূর্ব মাধুর্যকে অন্তরাত্মা দিয়ে উপলব্ধি করতে হলে রবীন্দ্রচর্চার বিকল্প নেই। তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, জগত-সংসারকে জানতে নতুন প্রজন্ম রবীন্দ্রসাহিত্যে অবগাহন করবে, রবীন্দ্র চর্চায় ব্যাপৃত থাকবে। রবীন্দ্র চেতনার আলোকে ন্যায়ভিত্তিক-শান্তিময় সমাজ প্রতিষ্ঠায় সকলকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান রাষ্ট্রপতি। প্রধানমন্ত্রীর বাণী ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর বাণীতে বলেছেন, কবিগুরু সাহিত্যের সকল শাখায় তাঁর অনন্য সাধারণ প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। তাঁর সৃষ্টি বাংলা সাহিত্যকে বিশ্ব মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেছে। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন শান্তির কবি, মানবতার কবি ও প্রকৃতির চিরন্তন সৌন্দর্যের কবি। তিনি ছিলেন বৈচিত্র্যের সাধক। বিশ্বব্যাপী দ্বন্দ্ব, সংঘাত ও বৈষম্যের বিলোপ সাধন এবং ধর্ম-বর্ণ-ভাষায় বৈচিত্র্য সমুন্নত রাখতে রবীন্দ্রনাথের জীবন ও দর্শন উজ্জ্বল এক আলোকবর্তিকা। বিশ্ব কবির ব্যঞ্জনাময় উপস্থিতি শোষণ, বঞ্চনা, সাম্প্রদায়িকতা ও স্বৈরতন্ত্র প্রতিরোধে বাঙালীর অগ্রযাত্রাকে চিরকাল অব্যাহত রাখবে বলে আশা প্রকাশ করেন প্রধানমন্ত্রী। রবীন্দ্রজয়ন্তীর বর্ণাঢ্য আয়োজন ॥ প্রতি বছরের মতো এবারও প্রাণের আবেগ-ভালবাসা আর শ্রদ্ধায় বাঙালী উদ্যাপন করছে দিবসটি। শনিবার বাংলা একাডেমিতে আয়োজন করা হয় একক বক্তৃতার। এ দিন থেকে ছায়ানট আয়োজন করেছে দুই দিনব্যাপী রবীন্দ্র উৎসবের। সন্ধ্যায় ছায়ানট মিলনায়তনে উৎসবের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়। চলবে আজ রবিবার পর্যন্ত। বাংলাদেশ রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী সংস্থার উদ্যোগে চলছে পাঁচ দিনের রবীন্দ্রসঙ্গীত উৎসব। ২৭তম জাতীয় রবীন্দ্রসঙ্গীত উৎসব উপলক্ষে মুখর সুফিয়া কামাল জাতীয় গণগ্রন্থাগারের শওকত ওসমান স্মৃতি মিলনায়তন। উৎসবের সমাপনী দিনে আজ রবিবার সম্মাননা জানানো হবে বিশিষ্ট রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী পাপিয়া সারোয়ারকে। চ্যানেল আইয়ের উদ্যোগে এবারও থাকছে দিনব্যাপী রবীন্দ্রমেলা। সকালে বিভিন্ন অঙ্গনের বিশিষ্টজনেরা মেলার উদ্বোধন করবেন। চ্যানেল আই চত্বরে তৈরি অনুষ্ঠান মঞ্চ থেকে পরিবেশিত হবে রবীন্দ্রসঙ্গীত, রবীন্দ্র নৃত্যনাট্য, শিশুনৃত্য ও আবৃত্তি। মেলায় আরও থাকবে ক্ষুদ্র ও কুঠিরশিল্পের স্টল। বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রবীন্দ্রজয়ন্তী উপলক্ষে থাকছে দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালা। ঢাকার বাইরে শাহজাদপুর, শিলাইদহের কুঠিবাড়ি নওগাঁর পরিতসর ও খুলনার দক্ষিণ ডিবিসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে রবীন্দ্রজয়ন্তীর বিভিন্ন কর্মসূচী পালন করা হবে।
×