ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

চাপ নয়, পাশে থেকে পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটাতে চায় যুক্তরাষ্ট্র

প্রকাশিত: ০৫:৩৪, ৮ মে ২০১৬

চাপ নয়, পাশে থেকে পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটাতে চায় যুক্তরাষ্ট্র

তৌহিদুর রহমান ॥ দেশের সাম্প্রতিক হত্যাকা-ের প্রেক্ষিতে ঢাকা-ওয়াশিংটনের মধ্যে যে টানাপোড়েন শুরু হয়েছিল, এখন আর সেটা নেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাইয়ের ঢাকা সফরের সময় সরকারের নেয়া গৃহীত পদক্ষেপে সন্তোষ প্রকাশ করেছে দেশটি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখন বাংলাদেশকে কোন ধরনের চাপ না দিয়ে, পাশে থেকেই পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটাতে চায়। সন্ত্রাস ও জঙ্গী প্রতিরোধে যে কোন ধরনের সহযোগিতা করতেও প্রস্তুত রয়েছে বলে জানিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। কূটনৈতিক সূত্র এসব তথ্য নিশ্চিত করেছে। মার্কিন আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থা ইউএসএইডের কর্মকর্তা জুলহাস মান্নান ও তার বন্ধু মাহবুব তনয় হত্যার প্রেক্ষিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বাংলাদেশকে চাপে রাখা হয়েছিল। বিশেষ করে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি প্রধানমন্ত্রীকে টেলিফোন করে এ হত্যার দ্রুত বিচারের আহ্বান জানান। তিনি দোষীদের দ্রুত গ্রেফতারেরও অনুরোধ জানান। বাংলাদেশের পরিস্থিতি পরিদর্শন করার জন্য নিশা দেশাইকে ঢাকায় পাঠানোর কথাও জানিয়েছিলেন জন কেরি। সে সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি বিভিন্ন দেশও সরকারকে এ হত্যাকা-ের বিষয়ে দ্রুত বিচারের আহ্বান জানায়। দেশে একের পর এক ‘টার্গেট খুনের’ ঘটনায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশ উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও জাতিসংঘ, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ফ্রান্স, জার্মানি এসব খুনের ঘটনায় দোষীদের দ্রুত বিচারের আহ্বান জানায়। তবে জুলহাস মান্নান ও মাহবুব তনয় হত্যার পরে পরিস্থিতি ভিন্ন রূপ নেয়। কেননা জুলহাস মান্নান এক সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রদূত ড্যান মজেনার প্রটোকল কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। এছাড়া তিনি যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থা ইউএসএইডের কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তাই জুলহাস হত্যাকা-ের পরে আন্তর্জাতিকভাবে চাপে পড়ে সরকার। জুলহাস হত্যার ঘটনায় ঢাকা-ওয়াশিংটনের মধ্যে টানাপোড়েনও শুরু হয়। তবে নিশা দেশাইয়ের ঢাকা সফরের পরে সেই চাপ অনেকটাই কেটে গেছে। বাংলাদেশ পরিস্থিতির সামাল দিতেও পেরেছে। নিশা দেশাই গত ৩-৫ মে ঢাকা সফর করেন। সে সময় তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাড়াও প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক বিষয়ক উপদেষ্টা এইচটি ইমাম, পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম, পররাষ্ট্র সচিব এম শহীদুল হকের সঙ্গে বৈঠক করেন। এছাড়া বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গেও বৈঠক করেছেন নিশা দেশাই। বৈঠকে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক হত্যাকা-ের বিষয়ে আলোচনা হয়। বাংলাদেশের জঙ্গী ও সন্ত্রাসবাদ প্রতিরোধে সরকারের গৃহীত পদক্ষেপের বিষয়ে অবহিত হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে নিশা দেশাই জুলহাস মান্নান হত্যাকারীদের গ্রেফতারে জোরালো দাবি জানান। সূত্র জানায়, মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি যখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে টেলিফোন করে জানিয়েছিলেন নিশা দেশাইকে ঢাকায় পাঠানো হচ্ছে, তখন বাংলাদেশের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তারা ধরে নিয়েছিলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ ইস্যুতে নতুন করে চাপে ফেলতে চাইছে। এছাড়া ইসলামিক স্টেটের (আইএস) অস্তিত্ব নিয়ে দুই দেশের মধ্যে আগে থেকেই মতবিরোধ রয়েছে। কেননা বাংলাদেশ শুরু থেকেই অস্বীকার করে এলেও যুক্তরাষ্ট্র সব সময় অভিযোগ করে এসেছে এদেশে আইএসের অস্তিত্ব রয়েছে। এসব নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের টানাপোড়েনও তৈরি হয়। নিশা দেশাইয়ের ঢাকা সফরের পর সরকারের একাধিক কর্মকর্তা নিশ্চিত করেছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখন এ মূহূর্তে বাংলাদেশকে কোন ধরনের চাপে নয়, বরং সন্ত্রাস ও জঙ্গী প্রতিরোধ নিয়ে আরও সহযোগিতা করতে তারা প্রস্তুত রয়েছে। নিশা দেশাই খুব স্পষ্ট করে জানিয়েছেন, সন্ত্রাস ও জঙ্গী প্রতিরোধ ইস্যুতে বাংলাদেশ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একান্ত ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করতে চায়। এ ইস্যুতে দুই দেশের মধ্যে যে কার্যক্রম রয়েছে, সেসব কার্যক্রম আরও জোরালো ও শক্তিশালী করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন তিনি। বাংলাদেশের সমসাময়িক ইস্যু হিসেবে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, মুক্তমতের চর্চায় বাধা, মার্কিন দূতাবাস কর্মকর্তা-রাবি শিক্ষক ও ব্লগার খুনসহ সার্বিক পরিস্থিতিতে ঢাকা সফরের সময় নিশা জোর দিয়েছেন। এজন্য সন্ত্রাসবাদ দমনে একসঙ্গে কাজ করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন তিনি। দেশে নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ ইস্যুসহ সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদ প্রতিরোধে ঢাকা-ওয়াশিংটনের সহযোগিতা বিষয়টিকে তিনি প্রাধান্য দিয়েছেন। এছাড়া জুলহাসসহ সাম্প্রতিক গুপ্তহত্যার ঘটনা তদন্তে সহায়তা দেয়ার বিষয়ে আগ্রহ ব্যক্ত করেছেন নিশা দেশাই। বাংলাদেশের নিরাপত্তা পরিস্থিতি, এখান থেকে উত্তরণের পথ নিয়েও আলোচনা হয়েছে। একের পর এক হত্যাকা-ে বাংলাদেশ সরকার কী ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করছেÑ সে সম্পর্কেও অবহিত হয়েছেন নিশা দেশাই। সরকারের কর্মকর্তারা সব মিলিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সন্তুষ্ট করতে পেরেছেন বলেই মনে করছেন। সূত্র জানায়, নিশা দেশাইয়ের ঢাকা সফরের সময় সন্ত্রাস ও জঙ্গী প্রতিরোধই ছিল গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। তবে এটা ছাড়াও অন্যান্য ইস্যুতেও আলোচনা করেছেন তিনি। বিশেষ করে পররাষ্ট্র সচিব এম শহীদুল হকের সঙ্গে বৈঠকে দুই দেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সে সময় আগামী জুন মাসে ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পঞ্চম অংশীদারি সংলাপ কিভাবে সফল করা যেতে পারে, তা নিয়েও আলোচনা হয়। এছাড়া নিশা দেশাই জানিয়েছেন, আগামী সেপ্টেম্বর মাসে জাতিসংঘ অধিবেশনের সময় জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশন চলাকালে সাইডলাইনে অভিবাসন সম্পর্কিত একটি উচ্চপর্যায়ের সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সঙ্গে কো-চেয়ার করার জন্য শেখ হাসিনাকে আমন্ত্রণ জানান নিশা দেশাই বিসওয়াল। ২০১৩ সালের শেষের দিকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অরাজকতার সময় প্রথমবারের মতো ঢাকা সফরে আসেন মার্কিন পররাষ্ট্রবিষয়ক সহকারী মন্ত্রী নিশা দেশাই। তিন দিনের ওই সফরে তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াসহ বিভিন্ন পেশার নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। সবার কাছ থেকে তখনকার পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চান। রাজনৈতিক সঙ্কট নিয়ে বিশেষ কিছু বলেননি তিনি। তবে তার এ সফরকে ঘিরে তখন চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছিল। এরপর তিনি ২০১৪ ও ২০১৫ সালে আরও দুইবার ঢাকায় এসেছেন। এবার ৩ মে চতুর্থবারের মতো তিন দিনের সফরে ঢাকা সফরে আসেন নিশা দেশাই।
×