ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ড. শাহজাহান মণ্ডল

হাইকোর্ট বিভাগ ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করতে পারেন কি?

প্রকাশিত: ০৩:৪৯, ৮ মে ২০১৬

হাইকোর্ট বিভাগ ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করতে পারেন কি?

হাইকোর্ট বিভাগ ৫ মে যে রায় দিলেন তা পার্লামেন্ট ও সুপ্রীমকোর্টকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। এটা জনগণ প্রত্যাশা করে না। হাইকোর্ট বিভাগ বলেছেন, সুপ্রীমকোর্টের বিচারক অপসারণের ক্ষমতা তিন সদস্যের ‘সুপ্রীম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের’ হাত থেকে পার্লামেন্টের হাতে (তথা ৩৫০ জন এমপি ও রাষ্ট্রপতির হাতে) দিয়েছিল যে ষোড়শ সংশোধনী আইন তা অবৈধ ও অসাংবিধানিক। আসলে কি তাই? বলে রাখা দরকার, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে প্রণীত বাহাত্তরের সংবিধানে এই বিচারক অপসারণের ক্ষমতা পার্লামেন্টের হাতেই ছিল। বঙ্গবন্ধু হত্যার কারিগর ও সম্মতিদাতা প্রেসিডেন্ট জিয়া পাকিস্তানের পদ্ধতি অনুসারে এই ক্ষমতা ‘সুপ্রীম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের’ হাতে দেন এবং ১৯৭৯ সালে অবৈধ সংসদ কর্তৃক ৫ম সংশোধনী দ্বারা তা জায়েজ করেন। তখন থেকে এই ক্ষমতা প্রয়োগের মালিক ছিলেন ‘সুপ্রীম জুডিশিয়াল কাউন্সিল’ যা গঠিত হয় তিনজনের সমন্বয়েÑ প্রধান বিচারপতি ও পরবর্তী দুজন সিনিয়র বিচারক। ২০১৪ সালের ১৪তম সংশোধনী দ্বারা ক্ষমতাটি পুনরায় পার্লামেন্টের হাতে ন্যস্ত হয় যা বর্তমান সরকারের অন্যতম প্রতিশ্রুতি বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরে যাবার একটি চেষ্টা। বিচার বিভাগ কি ভুলে গেছেন জনগণকে দেয়া সরকারের এই প্রতিশ্রুতি? এ-ও কি ভুলে গেছেন যে, বিচার বিভাগ হলো সরকারেরই প্রধান তিনটি অঙ্গের একটি? নইলে কেন ৫ মের এই রায়? ২০১৩ সালের ৫ মের হেফাজতী তা-বের সঙ্গে এর কোন সম্পর্ক আছে কি-না তাও এক বিরাট প্রশ্ন। পার্লামেন্ট বিচারক অপসারণের ক্ষমতা প্রয়োগ করলে কি বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ক্ষুণœ হয়? হাইকোর্ট বিভাগ তো মনে হচ্ছে তা-ই মনে করেছেন। বলতে চাচ্ছেন, এমপিরা সংসদে নিজের ইচ্ছেমতো ভোট দিতে পারেন না, ইচ্ছে হলেও সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের নিয়মের কারণে দলের ইচ্ছার বাইরে বেরিয়ে ভোট দিতে পারেন না। সংসদ নেতার তথা প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছেমতো ভোট দিতে হয়। তাই সম্ভাবনা থাকে অন্যায়ভাবে বিচারক অপসারণের। এতেই ক্ষুণœ হবে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা? যদি হাইকোর্ট বিভাগ তা-ই মনে করে থাকেন তাহলে বলা আবশ্যক, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা বলতে কি শুধু অপসারণের ব্যাপারটি বোঝায়? আর কিছু বোঝায় না? ওই বিচারককে প্রকৃতপক্ষে প্রধানমন্ত্রীর মনোনয়নে যখন রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিয়োগ পেতে হয়, কই তখন তো বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ক্ষুণœ হওয়ার প্রশ্ন ওঠে না? তদুপরি প্রধানমন্ত্রীসহ ওই পার্লামেন্টের সদস্যরা যখন বিচারকদের বেতন নির্ধারণ করেন তখন তো বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ক্ষুণœ হওয়ার প্রশ্ন ওঠে না। আসল কথা কী, বিচার করার ক্ষেত্রে বিচারকগণ পার্লামেন্ট কর্তৃক চাপে না পড়লেই তো হলো। বিচারকগণ অন্যায় প্রলোভনে প্রলুব্ধ না হয়ে বিচার করতে পারলেই তো হলো। বিচার বিভাগের সবচেয়ে বড় স্বাধীনতা, আমরা মনে করি, তাঁদের নিজের কাছেই। তাঁরা নিজেরা তা চর্চা করলে কারোই ক্ষমতা নেই তা থেকে বিরত রাখার। তদুপরি শাসন বিভাগ থেকে নিম্ন আদালতকে ২০০৭ সালে পৃথক করার মাধ্যমে একদিকে যেমন সংবিধানের ২২ অনুচ্ছেদের প্রতিশ্রুতি সরকার পূরণ করেছে, তেমনি অন্যদিকে তাদের জন্য মেহনতি জনগণের শ্রম ও ঘামে অর্জিত ট্যাক্স থেকে পৃথক ও সম্মানজনক বেতন স্কেলও দিয়েছেন। এবার আসা যাক আইনের কথায়। কোন মৌলিক অধিকার ক্ষুণœ হয়েছে যে, হাইকোর্ট বিভাগ রিট গ্রহণ করলেন এবং রায় দিলেন যে, পার্লামেন্টের হাতে বিচারক অপসারণের ক্ষমতা গেলে তা হবে অবৈধ ও অসাংবিধানিক? সংবিধানের ২৬ থেকে ৪৭ অনুচ্ছেদ পর্যন্ত ‘মৌলিক অধিকার’ নামক ৩য় ভাগের ব্যাপ্তি। এখানে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার কথা যেমন নেই, তেমনি এ-ও নেই যে, সেনা শাসক জিয়ার সামরিক ফরমান দ্বারা প্রবর্তিত সুপ্রীম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের পরিবর্তে বঙ্গবন্ধু প্রদর্শিত পথে স্বয়ং পার্লামেন্ট বিচারক অপসারণ করলে তা হবে মৌলিক অধিকার পরিপন্থী। এটা ঠিক যে, সংবিধানের ২৬(২) অনুচ্ছেদ মোতাবেক রাষ্ট্র মৌলিক অধিকার পরিপন্থী আইন তৈরি করতে পারে না, কিন্তু একই সঙ্গে এটা আরও বেশি ঠিক যে, এই ২৬ অনুচ্ছেদ শুধু সাধারণ আইন তৈরির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য; এটি অসাধারণ আইন তৈরির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়, তথা ১৪২ অনুচ্ছেদ মোতাবেক সংবিধান সংশোধনী আইন তৈরি হলে সেক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয় (দ্রষ্টব্য : ২৬(৩) অনুচ্ছেদ)। বলাবাহুল্য, আলোচ্য ষোড়শ সংশোধনী, যার মাধ্যমে বিচারক অপসারণ ক্ষমতা পার্লামেন্টকে দেয়া হয়েছে তা এই ১৪২ অনুচ্ছেদের অধীনেই করা হয়েছে। কাজেই ২৭ থেকে ৪৪ অনুচ্ছেদে বর্ণিত কোন মৌলিক অধিকার এই ষোড়শ সংশোধনী আইন দ্বারা ক্ষুণœ হয়নি। সুতরাং আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সংসদে যে কথা বলেছেন, তা-ই সমর্থনযোগ্য। তিনি বলেছেন, ৫ মে ২০১৬ তারিখে হাইকোর্ট বিভাগ ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ বলে যে রায় দিয়েছেন তার এখতিয়ার এ কোর্টের নেই; অর্থাৎ এ রায় নিজেই অসাংবিধানিক, নিজেই অবৈধ। প্রশ্ন উঠতে পারে, তাহলে কি যে কোন সংশোধনী বাতিল করে দেয়া রায় অবৈধ? আরও স্পষ্ট করে বলা লাগে, তাহলে কি পঞ্চম, সপ্তম ও ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল ঘোষণাকারী রায়গুলো অবৈধ? উত্তর হলো, মোটেই না। সে রায়গুলো বৈধ, কারণ ওই সংশোধনীগুলো নিজেই ছিল অবৈধ ও অসাংবিধানিক। পঞ্চম, সপ্তম ও ত্রয়োদশ সংশোধনী আইনগুলো ২৭-৪৪ অনুচ্ছেদে বর্ণিত কোন না কোন মৌলিক অধিকার ক্ষুণœ করেছিল; যেমন ১৯৭৯ সালে পাস হওয়া পঞ্চম সংশোধনী আইনটি ১৯৭৫ সালে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার করার পথ পাকাপোক্তভাবে বন্ধ করেছিল, যা ছিল ৩২ অনুচ্ছেদে প্রদত্ত জীবনের অধিকার নামক মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী। এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছেন, হাইকোর্টের এ রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগে আপীল করবেন। আশা করি আপীল বিভাগ জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তি সংবিধানের সঠিক প্রয়োগ করবেন, হাইকোর্ট বিভাগের রায়টি বাতিল করবেন, ষোড়শ সংশোধনী বহাল রাখবেন এবং বিচারক অপসারণ বা অভিশংসন ক্ষমতা পার্লামেন্টের হাতেই রাখবেন। সর্বোপরি, সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদ মোতাবেক প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ কি নাÑ এতে তা স্পষ্ট হবে। লেখক : চেয়ারম্যান, আইন বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া সংসড়হফড়ষ@মসধরষ.পড়স
×