ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সার্বভৌম সংসদ

প্রকাশিত: ০৩:৪৮, ৮ মে ২০১৬

সার্বভৌম সংসদ

বাংলাদেশের মতো বিশ্বের সব গণতান্ত্রিক দেশেই রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ। অপরদিকে স্বৈরশাসকরা নিজেদের ভাবেন তারাই রাষ্ট্রক্ষমতার মালিক। বলাবাহুল্য, বন্দুকের নলই হয়ে ওঠে স্বৈরশাসকদের ক্ষমতার নেপথ্যের আসল শক্তি। কিন্তু অস্ত্রের জুলুম শুধু গণতন্ত্রকামী মানুষ কেন, যে কোন মানুষের কাছেই অসহনীয়। তাই তারা প্রতিবাদী ও লড়াকু হয়; অস্ত্রের সামনে নির্ভয়ে বুক পেতে দিতে পারে। ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে পাওয়া গণতন্ত্রের সৌরভকে ম্লান করে দেয়ার অপপ্রয়াস চালিয়ে থাকে অস্ত্রশক্তি- এমন দৃষ্টান্ত বিশ্বে বিরল নয়। একাত্তরে তেমনটাই ঘটেছিল এ দেশে। মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার কেড়ে নেয়ার কসরতে সেই অপশক্তি খোদ মানুষের প্রাণটাই কেড়ে নিতে উদ্যত হয়েছিল। কিন্তু মানুষ, অর্থাৎ রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতার আসল মালিক জনগণই তা রুখে দিয়েছিল। ফলত হাজার বছরের ইতিহাসে অর্জিত হয়েছিল এক আশ্চর্য সুন্দর ফসলÑ বাঙালীর স্বাধীন সার্বভৌম স্বদেশ। কিন্তু নির্দিষ্ট মানচিত্র আর নিজস্ব পতাকা মানেই তো আর স্বাধীনতা নয়; স্বাধীনতাকে অর্থবহ করে তুলতে চাই মানবিক পবিত্র দলিল, যার ভিত্তিতে পরিচালিত হবে দেশ। আমাদের সেই মানবিক দলিল হলো পবিত্র সংবিধান, যা রচিত হয় স্বাধীনতালাভের অব্যবহিত পরেই। সেই সংবিধানের আলোকেই রাষ্ট্রের পথচলা। সংবিধানের ভিত্তিতে ও সামঞ্জস্যতায় দেশের সব আইন প্রণয়ন। এই আইন প্রণেতারা কারা? রাষ্ট্রের মালিক জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা। সোজা কথায় সংসদ সদস্যরা। জাতীয় সংসদ সেই পীঠস্থান, যেখানে সুশাসনের লক্ষ্যে এবং গণতন্ত্র সুরক্ষায় প্রণীত হয় যুগোপযোগী আইন। সেই আইনের আলোকেই পরিচালিত হয় নির্বাহী শাসনব্যবস্থা। সমাজে কোথাও কোন ব্যত্যয় ঘটলে, আইন পরিপন্থী কিছু হলে প্রতিকার পাওয়ার স্থান হলো বিচারালয়। এভাবেই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সংসদ থাকে সার্বভৌম স্তম্ভ হিসেবে। আমাদের দুর্ভাগ্য যে, আমাদের প্রাণপ্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশে বার বার গণতন্ত্র মুখ থুবড়ে পড়েছে; জাতীয় সংসদকে স্থবির করে দেয়া হয়েছে। আবার দেশের মানুষই আন্দোলন-সংগ্রাম করে গণতন্ত্রকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছে। জাতীয় সংসদ পুনর্গঠিত হয়েছে। সংসদ রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করে। সরকার ও বিরোধী দল নির্বাচিত হয় সংসদে। আইন প্রণয়ন করা সংসদের কাজ। সংসদীয় কমিটিগুলো তার কাজের মাধ্যমে নির্বাহী বিভাগকে আইন অনুযায়ী নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। সার্বিক বিচারে রাষ্ট্রের অন্য দুটি অংশ বিচার বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগ তাই কোন না কোনভাবে জনগণের রায়ে নির্বাচিত সংসদ ও তার কর্মকা-ের ওপর নির্ভরশীল এবং নিয়ন্ত্রণাধীন থাকে। এককথায় বলা যায়, সংসদীয় গণতন্ত্রে জাতীয় সংসদ হচ্ছে জনগণের আশা-আকাক্সক্ষা-প্রত্যাশার বহিঃপ্রকাশ। প্রসঙ্গত, আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, একজন সংসদ সদস্য মানে যেমন জাতীয় সংসদ নয়, তেমনি একজন বিচারক মানেই সমগ্র বিচারব্যবস্থা কিংবা বিচারালয় নয়। ব্যক্তির আগমন-প্রস্থান রয়েছে; কিন্তু প্রতিষ্ঠান চিরস্থায়ী। বিচারালয়কে যদি কেউ জাতীয় সংসদের মুখোমুখি দাঁড় করাতে চায়, তবে তা অবশ্যই পশ্চাৎপদ ভাবনা। এটা গণতন্ত্রকে পেছনের দিকে টানার দুরভিসন্ধি বৈ কিছু নয়। জাতীয় সংসদের সার্বভৌমত্বকে যারা অস্বীকার করতে চায়, প্রকারান্তরে তারা কি এক সাগর রক্তের বিনিময়ে পাওয়া স্বাধীনতাকেই প্রশ্নবিদ্ধ বা অস্বীকার করছে না? তাছাড়া বাহাত্তরের সংবিধানের কোন অনুচ্ছেদকে ‘ইতিহাসের দুর্ঘটনা’ বলবার মতো পরিস্থিতি জাতি কি আগে প্রত্যক্ষ করেছে! দেশবাসীর প্রত্যাশা, দেশের সন্তান হয়ে কেউ যেন জাতীয় সংসদের সার্বভৌমত্বকে অস্বীকারের ধৃষ্টতা না দেখায়। এ তো আমাদের জানা কথাই, আইনের দৃষ্টিতে সবাই সমান, তা আইন প্রণেতাই হোক কিংবা হোক আইনজীবী বা বিচারক অথবা একজন সাধারণ নাগরিক।
×