ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

অর্ধেক মজুরিতে কাজ করছেন নারী শ্রমিকরা

প্রকাশিত: ০৩:৩৩, ৮ মে ২০১৬

অর্ধেক মজুরিতে কাজ করছেন নারী শ্রমিকরা

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ একবিংশ শতাব্দীর আজকের দিনেও নারী পুরুষের মজুরি বৈষম্য যেন খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। এখনও পুরুষের তুলনায় গড়ে অর্ধেক মজুরিতে কাজ করছেন নারী শ্রমিকরা। এছাড়া বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন তারা। ব্রিটিশ আমলে মৌলভীবাজারের পাহাড়ী টিলাগুলোতে চা বাগান গড়ে তুলতে, অবিভক্ত ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গা থেকে দরিদ্র শ্রমিকদের নিয়ে আসে ইংরেজরা। এরপর থেকে বংশ পরম্পরায় আজও শ্রমঘন এই কৃষিপণ্য উৎপাদন করে চলেছেন তারা। মৌলভীবাজারে নিম্ন আয়ের এই শ্রমিকদের মধ্যে অর্ধেকের বেশি নারী শ্রমিক। কিন্তু ঘর থেকে কাজের জায়গা, সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রেও পিছিয়ে আছেন সেই নারী। তবে নারী শ্রমিকদের সহায়তা দেয়ার চেষ্টা চলছে বলে জানালেন মৌলভীবাজারের চা-শিল্প শ্রম কল্যাণ বিভাগের উপ-শ্রম পরিচালক মোঃ মনিরুজ্জামান। একইভাবে দিনাজপুরের চালকলগুলোতে কাজ করছেন হাজার হাজার নারী শ্রমিক। পুরুষের পাশাপাশি কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এসব কারখানায় নারী শ্রমিকরা কাজ করছেন দিন-রাত। কিন্তু শ্রমিকদের অভিযোগ, এত পরিশ্রমেও মিলছে না পুরুষের সমান মজুরি। বগুড়ায় ছোট বড় মিলিয়ে ১ হাজার ৮শ’ চাতাল কল রয়েছে। যেখানে প্রায় ৬০ হাজার শ্রমিক কাজ করছেন। মজুরির হার নিয়ে অসন্তোষ নারী ও পুরুষ উভয় শ্রমিকের মাঝে থাকলেও, পুরুষের তুলনায় অর্ধেক মজুরি পাচ্ছেন নারীরা। রোজগারের এ চিত্র পঞ্চগড়ের নারী পাথর শ্রমিকদেরও। মোরগের ডাকে ঘুম থেকে উঠে সংসারে সবার খাবার আয়োজন। ছেলেমেয়েদের খাইয়ে স্কুলে পাঠানো। বাড়ির সব কাজ শেষ করে নিজে অল্প খেয়েই সকাল ৭টায় হাজির হতে হয় কর্মস্থলে। গ্রীষ্মের দুপুরের সূর্য দেবতার সবখানি তেজ লাগে তাদের সারাগায়ে। রোদে পুড়ে পুড়ে শরীরের চামড়া কালো হয়ে গেছে। চোখের নিচে কালো ছায়া পড়েছে। তবু দু’চোখ ভরা স্বপ্ন ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া করাবার। স্বপ্ন একটু ভালভাবে বাঁচবার। দিনের দিনের পর দিন এভাবেই কাটে তাদের। সমান কাজ করেও মজুরি মিলে পুরুষের অর্ধেক। উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার সনদে নারী পুরুষ সমঅধিকারের কথা বলে হলেও বাস্তবে তার ভিন্ন চিত্র দেখা মিলে দেশের সর্ব উত্তরের প্রান্তিক জেলা পঞ্চগড় জনপদে। সারাদিন একজন প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষের সমান শ্রম দিয়েও তাদের মজুরি মিলে অর্ধেক। কর্মস্থলে নেই নারীদের কাজ করার তেমন পরিবেশও। তবু জীবন জীবিকার তাগিদে এই কম মজুরিতেই হাজার হাজার নারী কাজ করে যাচ্ছেন এই জনপদে। ধরেছেন সংসার পরিচালনার হালও। এক হিসাব মতে জানা গেছে, পঞ্চগড়ের পাঁচ উপজেলার প্রায় ৫০ হাজার নারী বিভিন্ন শ্রম পেশায় নিয়োজিত। এদের কেউ অবকাঠামো নির্মাণ কাজ, কেউ চা বাগানে, কেউ কৃষি কাজে, কেউ মাটি কাটা কাজে আবার কেউ পাথর শিল্পে শ্রমিক হিসেবে কাজ করছে। তবে শুধু পাথর শিল্পেই প্রায় ৩০ হাজার নারী শ্রমিক কাজ করে বলে জানা গেছে। নারীদের এই বিরাট অংশ শ্রম পেশায় একদিনে আসেনি। ধীরে ধীরে নিজেদের প্রয়োজনে সকল বাধা পেরিয়ে তারা আজ নিজেদের পায়ে দাঁড়িয়েছে। এক সময় এই জনপদে শ্রম পেশায় নারীদের উপস্থিতি ছিল না বললেই চলে। কিন্তু স্বাধীনতার পরে ব্যাপক অভাব অনটন দেখা দেয়ায় নিজেদের প্রয়োজনে তারা কাজে নেমে পড়ে। পঞ্চগড়ের আটোয়ারী, পঞ্চগড় সদর ও তেঁতুলিয়ায় পাথর শিল্পের বিকাশ হলে নারীরাও কাজ করার সুযোগ পায়। এভাবেই একজনের দেখাদেখি আরেকজন কাজে যোগ দেয়। শুরুতে পাথর ব্যবসায়ীরা নারীদের কাজে নিতে চায়নি। এ সময় কাজ করতে লোকজনের নানা গঞ্জনাও শুনতে হতো। তবু সব বাধা পেরিয়ে পাথর শিল্পে কাজ শুরু করে পঞ্চগড়ের নারীদের এই বিরাট অংশ। ক্রমে ক্রমে পঞ্চগড়ের পাথর শিল্পের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে হাজার হাজার নারী শ্রমিকের জীবন। স্বাধীনতার ৪৫ বছর পেরিয়ে গেছে। বদলে গেছে লাল সবুজের বাংলাদেশ। তথ্যপ্রযুক্তি আর নানা শিল্পে বাংলাদেশ এখন অন্যদের কাছে উদাহরণ। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য আজও শ্রমের ন্যায্য মজুরি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে নারীরা। সকাল ৭টা থেকে সন্ধ্যে ৭টা পর্যন্ত ১২ ঘণ্টার রৌদ্রের খরতাপে কাজ করে একজন নারী শ্রমিক মজুরি পান ১৫০ টাকা থেকে ২০০ টাকা। অন্যদিকে একই সমান কাজ করে পুরুষ শ্রমিকরা মজুরি পান ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা। কম মজুরিতে নারী শ্রমিকদের দ্বারা বেশি কাজ আদায় করা যায় বলে পাথর ব্যবসায়ীরাও নারী শ্রমিকদের নিয়ে আগ্রহ দেখায়। মজুরি বেশি দাবি করলে তাদের আর কাজে নেয়া হয় না বলেও অভিযোগ করেন অনেকে। তাই ঘরে বসে থাকার চেয়ে কম মজুরিতেই কাজ করেন তারা। খাবার সময় শুধু একটু বিশ্রাম মিলে তাদের। সেই সময়ে সবাই বাড়ি থেকে রান্না করে আনা খাবার খায়। অন্যদিকে, নারীদের কাজ করার মতো এখনও তেমন পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়নি অধিকাংশ পাথরের কর্মস্থলে। নেই কোন ল্যাট্রিন ও বিশ্রামাগার। তাই দুপুরের খাবারের পর গাছের ছায়ায় পাথরের ওপরই শুয়ে বসে একটু বিশ্রাম করে তারা। কোন কারণে নারী শ্রমিকরা অসুস্থ বা আহত হলে তারা পায় না কোন বিশেষ ভাতা ও মালিকদের সহায়তা। কিন্তু তারপরও চলে জীবিকার সংগ্রাম। পঞ্চগড় জেলা সদরের ১০ মাইল পতিপাড়া এলাকার নারী পাথর শ্রমিক রাশিদা খাতুন (৬৫) জানান, তার আয় দিয়েই ৬ জনের সংসারের খরচের যোগান হয়। স্বামী বৃদ্ধ, তাই তেমন রোজগার করতে পারেন না। মায়ের পাথর ভাঙার কাজের মজুরি দিয়েই বড় দুই ছেলে মানিক ও রাসেলকে হাফেজি মাদ্রাসায় ও মেয়ে জেসমিন আরা দশম শ্রেণীতে এবং সবার ছোট ছেলে তারেক কিন্ডার গার্টেন স্কুলে কেজি শ্রেণীতে লেখাপড়া করছে। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার খরচ দিয়ে যে সামান্য টাকা থাকে তাই দিয়েই কোনমতে চলে সংসার। এদিকে ঋণের টাকাও শোধ করতে হয় রাশিদাকেই। প্রতি সপ্তাহে আশা এনজিওকে তার ৭০০ টাকা করে পরিশোধ করতে হয়। তার মতো আরেক নারী পাথর শ্রমিক আমেনা খাতুন (৬২)। বাড়ি পঞ্চগড় জেলা সদরের ভিতরগড়। স্বামী মারা গেছেন বিশ বছর আগে। ১ ছেলে ১ মেয়েকে বড় করে বিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু আমেনাকে খাওয়ানোর ভার কেউ নেয়নি। তাই বেঁচে থাকতে বৃদ্ধ বয়সেও তাকে পাথর ভাঙার কাজ করতে হয়। শুধু রাশিদা, আমেনা নয় এমন চিত্র হাজার হাজার পাথর শ্রমিকদেরই। নিজে রোদে পুড়ে পুড়ে হাসিমুখে তাদের সংসার বাঁচানোর সংগ্রাম সত্যিই সকল উদাহরণ হার মানিয়ে দেয়। পাথর ব্যবসায়ী মোশারফ হোসেন জানান, এ এলাকার নারীরা তেমন অন্য কোন কাজ পায় না তাই পাথর ভাঙার কাজ করতে আসে। আমরা সাধ্যমতো তাদের মজুরি দেয়ার চেষ্টা করি। জেলা নারী বিষয়ক কর্মকর্তা রুখশানা মমতাজ জানান, আমরা কোন দিবস আসলেই কেবল নারীদের সমঅধিকারের কথা বলি। কিন্তু বাস্তবে নারীরা সমঅধিকার পাচ্ছে না। নারী পাথরশ্রমিকরা পাচ্ছে না তাদের ন্যায্য অধিকার। আমরা আমাদের পক্ষ থেকে নারীর সমঅধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছি। আমাদের একার পক্ষে এই আন্দোলন সফল করা সম্ভব নয়। নারীদের অধিকার আদায়ে আমাদের সকলকেই এগিয়ে আসতে হবে।
×