ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

মুনতাসীর মামুন

উদ্ভট উটের পিঠে কি চলেছে স্বদেশ?

প্রকাশিত: ০৭:১০, ৭ মে ২০১৬

উদ্ভট উটের পিঠে কি  চলেছে স্বদেশ?

(গতকালের পর) প্রধান বিচারপতির সাম্প্রতিক যে নির্দেশটি নিয়ে প্রশ্ন উঠছে তা হলো, বিচারকদের অবসরে যাওয়ার পর রায় লেখা নিয়ে। সেটির নিষ্পত্তি হয়েছে তবুও বিষয়টি যেহেতু বহুল আলোচিত তাই সে প্রসঙ্গে খানিকটা আলোকপাত করছি। তিনি বলছেন, অবসরে যাওয়ার পর রায় লেখা যাবে না। মানলাম সেটা। কিন্তু সিদ্ধান্তটি কি একার, না সবার? ঠিক আছে ধরে নিলাম একার, কিন্তু তিনি আগে যা বলেছেন তার সঙ্গে এটি কতটা সঙ্গতিপূর্ণ? সংবিধানের সঙ্গে কতটা সঙ্গতিপূর্ণ? সংবিধানের বাইরে আদালতের যাওয়ার এখতিয়ার কতটুকু? সংসদে একক সিদ্ধান্তে কিছু হয় না। নির্বাহীতেও নয়। জুডিশিয়ারিতে কেন হবে? প্রধান বিচারপতি বলেছিলেন, মামলার জট কমাবেন। কিন্তু প্রাক্তন বিচারপতি বিরাট সংখ্যক মামলার রায় যে পুনঃশুনানির নির্দেশ দিলেন, তাতে জট বাড়বে, না কমবে? যে মামলার রায় দেয়া হয়েছে উন্মুক্ত আদালতে, যে মামলার রায় লেখা হয়েছে এবং পর্যায়ক্রমে তা অন্যান্য বিচারপতির কাছে গেছে তার পুনঃশুনানি হবে কিভাবে? রায় প্রকাশের পর রিভিউ হতে পারে। সবচেয়ে বড় বিষয়, পুনঃশুনানির সময় আদালতে যে আইনজীবী দাঁড়াবেন তার ফিস কে দেবে? যে মক্কেল একবার ফিস দিয়েছেন তিনি ফের একই বিষয়ে কেন ফিস দেবেন? আপীল বিভাগের কি কোন ফান্ড আছে যেখান থেকে এই ফিস দেয়া যাবে? না গেলে মক্কেলদের ওপর চাপিয়ে দেয়া কি ন্যায় বিচার? আইনজীবীরা এ বিষয়ে প্রতিবাদ করবেন না জানি, কারণ এখন অর্থই মুখ্য। বিনা কারণে অর্থ পেলে তা ছাড়বে কোন্্ জন? আদালত শুধু বিচারক ও আইনজীবীদের জন্য নয়। এই প্রচলিত ধারণার বিনাশ হওয়া উচিত। আদালত বিচারক, আইনজীবী ও মক্কেলদের। মক্কেল না থাকলে আদালত চলবে না। কিন্তু আদালতে মক্কেলদের সুবিধা সবচেয়ে কম। এমনও সময় গেছে, শুনানির সময় বসতে দেয়া হয়নি আমাকে। তরুণ এক আইনজীবী জানিয়েছেন, এখানে বসার অধিকার তাদের। এরকম আইনজীবীর সংখ্যা এখন কম নয় আদালতে। যাক, এ বিষয়টির শুভ নিষ্পত্তি হওয়া দরকার। এ বিষয়ে প্রাক্তন দুজন প্রধান বিচারপতি বক্তব্য রেখেছেন। আইনী বিষয়টি বোঝার জন্য তাদের বক্তব্য পর্যালোচনা করা উচিত। বিচারপতি খায়রুল হক ১০ মার্চ [২০১৬] দৈনিক জনকণ্ঠে ‘অবসরের পর বিস্তারিত রায় লেখা- একটি প্রতিষ্ঠিত আইনী রীতি’ শীর্ষক একটি নিবন্ধ লিখেছেন। তিনি সাতটি যুক্তি উপস্থাপন করেছেন পটভূমি হিসেবে, যেখানে দেখিয়েছেন বিচারক সিনহা যা বলছেন তা কেন যুক্তিযুক্ত নয়। তিনি লিখেছেনÑ ‘উল্লেখ্য যে, সকল বিচারকই উন্মুক্ত আদালতে আপীল বিভাগের রুলসের বিধান অনুসারে রায় ঘোষণা (চৎড়হড়ঁহপব) করেন। কিন্তু পরবর্তীতে অবসরপ্রাপ্ত বিচারকগণ যদি কারণ সংবলিত বিস্তারিত রায় লেখেন তা ভ্রমাত্মক হবে না, কারণ এটা বারিত করে আপীল বিভাগ রুলসে কোন বিধান নেই এবং সংবিধানেও এ ধরনের বারিতকরণ সংক্রান্ত কোন বিধান নেই। ধারণা করি, এ কারণেই বাংলাদেশের সুপ্রীমকোর্টের জন্ম হতে বাংলাদেশের ২০ জন প্রধান বিচারপতিসহ উভয় বিভাগের শতাধিক বিজ্ঞ বিচারপতিগণ উন্মুক্ত আদালতে প্রদত্ত রায় ঘোষণা (Pronouncement) এর ধারাবাহিকতায় অবসর গ্রহণের পরে বিস্তারিত রায় প্রদানে কোন সাংবিধানিক বা আইনগত বাধা তাঁদের ‘ক্ষুদ্র’ ও ‘সীমিত’ জ্ঞানে উপলব্ধি করেননি। বিষয়টি আশ্চর্যজনক বটে। তবে বহু রায় ১৯৭২ সাল হতে আজ পর্যন্ত অনেকেই তাঁদের অবসর গ্রহণের পরেই innocently লিখেছেন এবং সে রায়গুলো আমাদের বিভিন্ন Law Report এ মণিমুক্তার মতো jurisprudential আলোক এখনও বিতরণ করছে। সাধারণ মানুষ বা অসাধারণ মানুষ, বিজ্ঞ মানুষ বা তত বিজ্ঞ নন এমন মানুষ, কেউই এ সম্পর্কে কোন প্রশ্ন উত্থাপনের প্রয়োজনীয়তা এ যাবতকাল উপলব্ধি করেননি। প্রশ্নটি এখন উত্থাপিত হয়েছে। কারণ অনেকে তাদের বিজ্ঞান মনস্কতায় মনে করছেন যে, সংবিধানের ১৫৩টি অনুচ্ছেদের কোথাও না থাকলেও বিস্তারিত রায়টি অবসর গ্রহণের পর লেখা হয়েছে বিধায় বিচারক হিসেবে তাঁদের শপথ হতে তাঁরা অব্যাহতি পেয়েছেন বা বিযুক্ত হয়েছেন; সুতরাং তাঁদের উক্তরূপ অবসর গ্রহণ পরবর্তী বিস্তারিত রায় লেখা বেআইনী। তাঁদের সকলের মতামতের প্রতি বিনীতভাবে সম্মান প্রদর্শন করে বলছি- যেহেতু সংবিধানের কোন অনুচ্ছেদেই এ সম্পর্কে কোন বারিতকরণ বিধান নেই, সেহেতু অবসর গ্রহণের পরে প্রদত্ত রায় সম্পূর্ণ বৈধ।” তিনি আরও জানিয়েছেন, বিচারপতি সিনহা যে নির্দেশ দিয়েছেন তাতে “উপকারের চেয়ে অপকারই হবে বেশি।” তিনি আরও লিখেছেন- “সব শেষে বলবো যে, সংবিধান ও আইনের জটিল প্রশ্ন শুধু সাধারণ জ্ঞান (common sense) দ্বারা সমাধান করা যায় না, উচিতও নয়। তার জন্য প্রয়োজন নির্মোহ পেশাদারী মনোভাব (professionalism), specialised শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ এবং সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে সুদীর্ঘ অভিজ্ঞতা। অন্যথায়, সমগ্র বিষয়টি ‘বাল্য বিবাহে’ পরিণত হয়ে যেতে পারে। তাছাড়া, সংবিধান ও আইনের জটিল প্রশ্নের সঙ্গে কুটিল রাজনীতি গুলিয়ে ফেললে কারও জন্যই মঙ্গল বয়ে আনে না, বরঞ্চ কাল পরিক্রমায় (in the long run) ভবিষ্যতে দেশ, জাতি ও বিশেষ করে বিচার বিভাগের জন্য সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে যার শিকার আজ না হোক কাল সকল পক্ষই হতে পারেন। এর একটি সুদূরপ্রসারী প্রভাব অবশ্যই থাকবে। বিষয়টি সত্যিই জটিল।” প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি মোজাম্মেল হক যা বলেছেন তা বিস্ময়কর! তিনি বলেন- “শুনানির পর রায় ঘোষণা হয় ওপেন কোর্টে (প্রকাশ্য আদালতে)। ভারডিক্ট ঘোষণা হয়, ইট হ্যাজ বিন অ্যালাউড অথবা ডিসপোজড অফ বা ডিসমিসড। প্রধান বিচারপতি নিজেও রায় লিখতে পারেন, অথবা কোনো একজন বিচারপতিকে লেখার জন্য দায়িত্ব দেন। তেমনি বেঞ্চের নেতৃত্বদানকারী বিচারপতি নিজেও রায় লিখতে পারেন অথবা কোনো একজন বিচারপতিকে লেখার দায়িত্ব দিতে পারেন। “তবে যিনি লিখেন, তার লেখা শেষ হওয়ার পর পূর্ণাঙ্গ রায়ের ড্রাফট কপি সবচেয়ে জুনিয়র যিনি ওই বেঞ্চে তার কাছে পাঠিয়ে দেন। উনি এটি দেখে তার পরবর্তী উপরে যিনি তার কাছে দেন। ধরেন, পাঁচজন হলে ৫, ৪, ৩, ২ এভাবে সার্কুলেশন হয়ে শেষ হবে। যখন ড্রাফট কপি সবাই দেখে তাতে ইনিশিয়াল দেবেন, অর্থাৎ অ্যাপ্রুভ করলেন। সবার দেখার পর লেখক বিচারপতি যিনি থাকেন, সর্বশেষ যার কাছে যায়, তিনি তা তার কাছে পাঠিয়ে দেবেন। আর অথার জাজ যদি প্রধান বিচারপতি হন, তাহলে এটি তার কাছে এসেই গেল, উনি তা ব্লু কাগজে প্রিন্টের পর নিজে সই করবেন প্রধান বিচারপতি বা প্রিজাইডিং জাজ। স্বাক্ষর করার বেলায় জ্যেষ্ঠতার ক্রম অনুসরণ করা হয়।’ বিচারপতি মোজাম্মেল বলেন, ‘এরকম আমার পাঁচটি রায় সার্কুলেশনে ছিল। জুনিয়র থেকে সিনিয়র পর্যন্ত মানে যেহেতু আমি অথার জাজ (লেখক বিচারপতি) প্রধান বিচারপতি, সিনহা সাহেব পর্যন্ত গেল, তিনি দেখেও পাঠালেন। পাঠানোর পর সেটি ব্লু প্রিন্ট ফাইনাল প্রিন্ট করে আবার তখনকার প্রধান বিচারপতি হিসেবে আমি সই দিয়ে উনার ওখানে পাঠিয়ে দিলাম। তারপর আমি আর জানি না কী হল? “এখন দেখতে পাচ্ছি ওই যে পাঁচটি রায়, যেগুলো পাঁচজন বিচারপতি অথার জাজসহ সবাই অ্যাপ্রুভ করলাম, তাতে আমি সইও করলাম, সেটিও এখন দেখা গেল শুনানিতে এসেছে। এটি দুঃখজনক। কেন হল ঠিক বুঝতে পারলাম না?” [বিডি নিউজ ২৪.com] বিচারক মোজাম্মেল হক যিনি প্রায় নীরবই থাকেন, দৃঢ়ভাবে জানিয়েছেনÑ ‘সুপ্রিমকোর্টের একজন আইনজীবী হিসেবে আমার প্রথম জীবনে, পরবর্তীতে বিচারপতি ও প্রধান বিচারপতি হিসেবে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন অবস্থান থেকে যতদূর জানতে পেরেছি, শিখতে পেরেছি, এতে (অবসরের পর রায় লেখা) আইনগত কোন অসুবিধা নাই। আমাদের সংবিধানেও কোন রকম নিষেধ নেই, আইনেও নেই। কাজেই এটিই প্রচলিত আইনি রীতি।” “আমি বলতে পারি, এটি একটি প্রতিষ্ঠিত আইনি রীতি যে বিচারপতিগণ অবসরে যাওয়ার পর সব সময়ই লিখে আসছেন। একাত্তর পর থেকেই এই রীতি চলে আসছে, আমাদের সিনিয়রদেরকেও দেখেছি।” [ঐ] উল্লেখ্য, যেসব রায় পুনঃশুনানির জন্য আনা হয়েছে তাতে বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী ছিলেন ১৬১টি মামলায় আর বিচারপতি হোসেন ৭টি মামলায়। এতদিন যা নিয়ে প্রশ্ন ওঠেনি পর্যন্ত উঠল বিচারপতি চৌধুরীর কারণে? লজিক তা-ই বলে। লজিক ডিফাই করতে পারেন, তাতে কিছু আসে যায় না কিন্তু লজিক লজিকই থেকে যায়। আদালত মনে হয়, ‘চৌধুরী সিনড্রোমে’ ভুগছে। একই ধরনের মামলা, একই ধরনের অভিযোগ, রায় হয়ত দিয়েছেন দুজন। কিন্তু একজনের রায় খারিজ হয়ে যায়। এ দৃষ্টি শুভ বুদ্ধিসম্পন্ন কারও জন্য শুভ নয়। প্রাক্তন যে তিনজন বিচারক ‘সমস্যার’ সঙ্গে জড়িত বা জড়িত নন কিন্তু বক্তব্য রেখেছেন, তারা বয়স, অভিজ্ঞতায়, বিদ্যা এবং বুদ্ধিতে বর্তমানে যারা নিয়োজিত আছেন তাদের চেয়ে কোন অবস্থায়ই খাটো নন। বিদেশী ডিগ্রী যার কদর আমরা বেশি দিই তাও আছে তাদের ঝুলিতে। বর্তমান প্রধান বিচারপতি আপিল বিভাগের সবাই দুজন প্রাক্তন প্রধান বিচারকের অধীনে কাজ করেছেন। তখনও তারা কেউ এ প্রশ্ন ওঠাননি। বলা যেত, ঠিক আছে আগামী এতো তারিখ থেকে অবসরপ্রাপ্তরা রায় লিখতে পারবেন না। তখন এর যৌক্তিকতা থাকত। আমাদের বুঝতে হবে সাংবিধানিকভাবে এবং আইনিভাবে প্রাক্তন দুই প্রধান বিচারপতি সঠিক না বর্তমান প্রধান বিচারপতি সঠিক। এটি নিষ্পত্তি না করে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিলে তা হবে একতরফা এবং সমাজে তা গভীর অসন্তোষের সৃষ্টি করবে। প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হবে, বিচারপ্রার্থী ও আদালতকে যে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়া হবে যা বাংলাদেশের কেউ সমর্থন করবে না। বিষয়টি আরও জটিল হবে এ কারণে যে, তখন রাজনৈতিক প্রশ্ন উঠবে। মুক্তিযোদ্ধা ও স্বাধীনতাবিরোধীদের কথা উঠবে। মুক্তিযোদ্ধাবিরোধী কেউ সাংবিধানিক পদে থাকতে পারবে কিনা সে প্রশ্নও উঠবে। সরকার তা ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না। মুক্তিযুদ্ধের ওপরে বাংলাদেশে কারও স্থান নেই তিনি যে পদেই থাকুন না কেন। ইতোমধ্যে পুরো বিষয়টি রাজনৈতিক রূপ নিচ্ছে। দৈনিক আনন্দবাজারে খবর উঠেছিল বর্তমান প্রধান বিচারপতি পরবর্তী রাষ্ট্রপ্রধান হবেন। আমার এক বন্ধু সেই ভারতীয় সংবাদদাতাকে ফোন করে জানতে চাইলেন, এ ধরনের সংবাদ ছাপাতে কত টাকা দেয়া হয়েছে। আমতা আমতা করে সেই সাংবাদিক তা অস্বীকারের চেষ্টা করেন। কিন্তু সেই সংবাদ এবং সম্প্রতি বিএনপির নেতা এ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেনের সংবাদ সম্মেলনের সঙ্গে অনেকে যোগসূত্র খুঁজে পাচ্ছেন। খন্দকার মাহবুব বলেছেন, প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে যে রায় দিয়েছেন তা পুনঃশুনানি করতে হবে। কেননা তা অবসরে যাওয়ার দেড় বছর পর লেখা হয়েছে। এ যুক্তিতে লজিক আছে কি নেই আইনজীবীরা তা নিয়ে বিবাদ করুন। কিন্তু এ নিয়ে যে তিক্ততা সৃষ্টি হবে তা বলাইবাহুল্য। প্রধান বিচারপতি হয়ত সরলভাবেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন কিন্তু তা যে এত জটিল হবে হয়ত ভাবেননি। যা বিষয়টির নিষ্পত্তি হয়ে ভালই হয়েছে। আগে এই সিদ্ধান্ত ছিল একজনের, এখন কোর্টের। ভুল স্বীকার করে সংশোধন করা গুণের পরিচয়। আমরা ফেরেশতা নই, মানুষ। কাজ করতে গেলে ভুল হতেই পারে। এ প্রসঙ্গে আরেকটি প্রচলিত ধারণা বিচারাধীন মামলা নিয়ে কোন মন্তব্য করা যাবে না। একেকটি মামলা চলে ৫/১০/২০ বছর তা হলে তো কোন বিষয় নিয়েই কথা বলা যাবে না। বিচারকরা কি এতই নমনীয় যে, বাইরের কোন আলোচনায় তারা প্রভাবিত হবেন? তাহলে তো আর ‘বিরাগ-অনুরাগের’ শপথ নেয়ার দরকার পড়ে না। আইন বইয়ে লেখা আছে তা যান্ত্রিকভাবে প্রয়োগ করা যায় কিনা সে প্রশ্নও এখন উঠবে। অর্থাৎ বিচারক এমন কোন রায় দিতে পারেন কিনা না যা বাস্তবতা বিবর্জিত এবং সমাজ রাষ্ট্রে যা প্রবল প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে? সম্প্রতি ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করা হয়েছে। এ নিয়ে সংসদে প্রবল আলোচনা হয়েছে। সামরিক ফরমান বলে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠিত হয়েছিল সেটি বাতিল ১৯৭২ সালের সংবিধানে যে আইন ছিল তাই পুনঃস্থাপিত করা হয়েছে ষোড়শ সংশোধনীতে। বিচারপতি খায়রুল হক তার রায়ে সামরিক শাসন অবৈধ ঘোষণা করেছেন। আদালত তা মেনে নিয়েছে। সেই ক্ষেত্রে সামরিক ফরমান আবার সে আদালতেরই পুনঃস্থাপনের রায় পরস্পরবিরোধী। আদালত বেসামরিক শাসনের রক্ষক, সেখানে এই রায় অবমাননাকর সিভিল সমাজের প্রতি। আর এই রায়কে আকস্মিক দুর্ঘটনা বলা সত্যের অপলাপ। ইতিহাস হলো, ১৯৭২ সালের সংবিধান রচনাকালে দল, ব্যক্তি অনেকেরই পরামর্শ নেয়া হয়েছে। সামষ্টিক চিন্তা-ভাবনার ফল তা। তাতে আকস্মিক দুর্ঘটনা বলা সুবিবেচনাপ্রসূত নয়। এটি অন্যায়। সাধারণ মানুষ সার্বভৌম। তাদের ক্ষমতার প্রতিষ্ঠান সংসদ। তাদের দ্বারা প্রণীত আইন বাতিল করা তাদেরই অপমানের নামান্তর। প্রধান বিচারপতি একবার বলেছিলেন, সংসদ সদস্যরা আইন প্রণেতা হিসেবে অজ্ঞ। এখন তার দুই সহকর্মীর রায়কে তিনি কি অভিধায় অভিহিত করবেন। এর অর্থ কি সংসদ জনস্বার্থহানিকর আইন করলে কি তা বাতিল করা যাবে না? যাবে, যদি তা হয় সংবিধানের মূল আদর্শের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। তাছাড়া এ আইন বিচারপতিদের সম্পর্কে। সেখানে বিচারপতিরা তার বিচার করলে তা ‘কমপ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট হয় কি না।’ আমি আগেই উল্লেখ করেছিলাম, একটি প্রবণতা দেখা যাচ্ছে জুডিশিয়ারি সবার উর্ধে এবং বিচারকরা ধরা ছোঁয়ার বাইরে। এই কনসেপ্ট গ্রহণীয় নয়। সবাই জনগণের সেবক। প্রজাতন্ত্রের সবার যেমন দায়বদ্ধতা রয়েছে, আদালতের বিচারক ও বিচারপতিদের তা থাকতে হবে। এবং সেই দায়বদ্ধতা নিজেদের কাছে নয়, জনগণের কাছে এবং জনগণের প্রতিষ্ঠান সংবিধান। এ রায় বহাল থাকলে আইন ও বিচার বিভাগ মুখোমুখি হবে এবং প্রতিষ্ঠান হিসেবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বিচার বিভাগ। যা আমাদের কাম্য নয়। যখন পাবলিকই প্রশ্ন করবে, যারা সামরিক ফরমান বহাল রাখতে চান তারা বিচার বিভাগের স্বাধীনতা অক্ষুণœ রাখতে যোগ্য কি না? এ প্রসঙ্গে একটি উদাহরণ দিই। ভারতের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি এস এইচ কাপাডিয়া বলেছিলেন, বিচারকদের সব বিষয়ে লেকচার দেয়া উচিত নয়। তাদের কাজ এ নয় যে, আইন বিভাগের জ্ঞান বিচার করা। ‘High Courts and the Supreme Court are courts of principles. The judges should not speak anything beyond the principles of a particular case. Let us not give lectures to society.” “The problem is sometimes we judges impose our own values, our own likes or dislikes on society,” “The judges should keep in mind that we cannot judge the wisdom of legislatures. We have to work for constitutional principles. I have no right to say what others should do but I have to perform the duty on constitutional principles.” “So, I am of the view that if the judges take decisions on principles, many of the controversies that are taking place now will not arise. [স্টেটসম্যান, ১৩.৩.২০১১] (চলবে)
×