নাসরীন মুস্তাফা
বদন মানে কি, তা আমি জানতাম না। বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীতে আছে এরকম কথাÑ মা তোর বদনখানি মলিন হলে, আমি নয়নজলে ভাসি!
আমার সব কথা তো মায়ের সঙ্গেই। মা আমাকে বুকের সঙ্গে টেনে নিলেন। সারা মুখে হাত বুলিয়ে বললেন, এই যে বদন! চাঁদের মতো বদন আমার সোনামানিকের।
বুঝলাম, বদন মানে মুখ।
মলিন মানে কি?
মন খারাপ থাকলে মুখটা ঝলমলে লাগে না। মলিন লাগে। কালচে হয়ে যায়। দেখলেই বোঝা যায়, মন খারাপ।
বুঝলাম। মন খারাপ থাকলে বদনখানি মলিন হয়। আর তখনই বুঝি নয়নজলে ভাসতে হয়, মা?
নয়ন মানে চোখ রে সোনা। মন খারাপ ভাবটা খুব বেশি হলে চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ে। অনেক বেশি পানি এসে মুখটা ভাসিয়ে নিয়ে যায়।
মা এত কথা বলার পর আমি হাত দিয়ে মায়ের বদন ছুঁয়ে দিই। বুঝতে পারছি, আমার মায়ের বদনখানি মলিন এখন। আমার হাত ভিজে গেছে কি? না, ভেজেনি। মায়ের মুখটা মলিন হলেও নয়নজলে ভাসেনি। কখনই ভাসে না। আমার ভাবতেই অবাক লাগে। কেন আমার মায়ের চোখের পানি গালে গড়িয়ে পড়ে না? আমি তো কখনও পড়তে দেখিনি।
এই যাহ্! এ আমি কি বলে ফেললাম? আমি কি কখনও দেখেছি কিছু? আমার বাম চোখে আলোর খানিক আভাস টের পাই। কিন্তু ডান চোখে তো একদম আঁধার।
কোলে থাকার সময়ই মা টের পেয়েছিলেন সমস্যাটি। ডাক্তার বলেছিলেন, সমস্যা হয়েছিল মায়ের পেটে থাকতেই। একটু একটু করে আমার শরীর তৈরি হচ্ছিল, তখনই। চোখ তৈরি হ’লো, কিন্তু ঠিকমতো হ’লো না।
বুঝিয়ে বলি। চোখের পর্দায় কোন ছবি পড়ার পর চোখ থেকে সে খবর মস্তিষ্কে নিয়ে যায় বিশেষ এক ধরনের ¯œায়ু। মস্তিষ্ক তখন দেখার অনুভূতি দেয়। আমার চোখ থেকে মস্তিষ্কে ‘দেখার’ খবরটা নিয়ে যাওয়ার মতো কাজের কোন স্নায়ু তৈরি হয়নি। তাই আমি দেখার অনুভূতি টের পাই না।
আমি অন্ধ।
মা আমার চোখ হয়ে থাকলেন আমার সঙ্গে। এই দুনিয়াতে আমি দিব্যি ঘুরে বেড়াই। দিব্যি স্কুলে যাই। হাত দিয়ে ছুঁয়ে ছুঁয়ে বই পড়ি। আনন্দ করি।
এভাবেই দিন যাচ্ছিল আমাদের। আমার চোখের সমস্যা সারিয়ে তোলার জন্য মা কেবলি ছুটে বেড়ান। কত কত ডাক্তারের কাছে যে যাওয়া হ’লো! কাজ কিছু হ’লো না। আমি যত বলি, দরকার নেই। আমি তো বেশ আছি। মা আমার শুনলে তো!
এরকম সময়ে মা খোঁজ পেলেন উপায় একটা আছে। কোন্ এক প্রতিষ্ঠান নাকি আছে, যারা প্রযুক্তির সাহায্যে অন্ধ চোখেও আলো ফোটাতে পারে। মা কেবলি এসব নিয়ে কথা বলতেন। আমি কিছুই বলতাম না। তবে না বলে আর কতদিন! মা যে কী পাগলামি শুরু করলেন! অফিস থেকে ধার নিলেন। বাড়িটাও বিক্রি করলেন। আমি কথা শুনে বুঝতে পারলাম, আরও অনেক টাকা লাগবে। অনেক অনেক টাকা।
মা’র সঙ্গে আমার বকাবকি শুরু হ’লো। আমি যত বোঝাতে চাই, মা কেবলি হাসেন। আমাকে জড়িয়ে ধরে হাসতে থাকেন হা হা করে। আমার বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হ’লো, মা আমার পাগল হয়ে যাচ্ছেন।
আসলেই মা পাগল হয়ে গেলেন। পাগল না হলে কেউ কি নিজের কিডনি-চোখ এমনকি পুরো শরীরটা বিক্রি করতে চান? আমার মা চাইলেন। তার পাগলামি দেখে পাগল হয়ে গেলেন আরও অনেক মানুষ। বিরাট কাগজে কি সব লিখে তারা নাকি রাস্তায় দাঁড়ালেন। সোস্যাল সাইটগুলোতে কি সব লিখে পোস্ট করলেন। টিভির খবর তো আমি কানে শুনতে পাই। যা শুনছিলাম, তা শুনে আমার মনে হ’লো, আমাকেও পাগল হতে হবে হয়ত।
আমার পাগল হয়ে যাওয়ার আগেই মা আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। টাকা যোগাড় হয়ে গেছে। নতুন প্রযুক্তির সাহায্যে আমি নাকি দেখতে পাব।
ই-সাইট নাম সেই প্রযুক্তিটির। ইলেকট্রনিক চশমার সাহায্যে মস্তিষ্কে দেখার অনুভূতি তৈরি করা হবে। ইলেকট্রনিক সেই চশমা পরেছিলাম। মা বললেন, চশমাটা নাকি অদ্ভুত দেখতে আর তাতে আমাকে নাকি মজাদার দেখাচ্ছে। আমি ভয় পাচ্ছিলাম বলে মা আমার পাশেই বসে ছিলেন। এক সময় আমি বুঝতে পেরেছিলাম, কিছু একটা ঘটছে।
আমার চারপাশে জেগে উঠছে দৃশ্যরা। আমার বুকের ভেতর হাতুড়ির বাড়ি পড়ছে। আমার শরীর কাঁপছে। আমার হাত সব সময়ের মতো মায়ের হাত ধরতে চাইল। আমার হাত ধরে ফেলল আরেকটা হাত, আমি খুব অবাক হয়ে সেই হাত আর হাতের মানুষটাকে দেখতে গিয়ে দেখে ফেললাম তাকে।
আমার মা-কে।
তাকে চিনতে আমার একটুও ভুল হয়নি। আমি চেঁচিয়ে বললাম, ওহ! মা! তুমি!
মা কিছু বলছিলেন না। আমার হাত চেপে ধরে থাকা তার হাত কাঁপছিল। আমি মায়ের মুখ দেখি। মায়ের চোখ দেখি। বারো বছর বয়সে এসে আমি দেখতে পেলাম, আমার মায়ের মুখ। কী সুন্দর! এত সুন্দর কারো মুখ হয়, জানা তো ছিল না। আমি মুগ্ধ হয়ে বললাম, তুমি এ্যাতো সুন্দর, মা!
নয়নভাসা জল আমার মায়ের বদন ভিজিয়ে দিচ্ছে, দেখতে পেলাম। হাত ভিজে গেল মায়ের গালে হাত রাখতে। আমি খুব অবাক হয়ে বললাম, তোমার কি মন খারাপ? তোমার বদনখানি মলিন না কি মা? তা না হলে নয়নজলে ভাসছ কেন তুমি?
এই প্রশ্নের জবাব মা দিতে পারলেন না। কেবলই কাঁদতে লাগলেন।
ক্রিস্টোফার ওয়ার্ড জুনিয়র নামের এক আমেরিকান কিশোরের জীবনের গল্প অবলম্বনে।
অলঙ্করণ : নাসিফ আহমেদ
আরো পড়ুন
শীর্ষ সংবাদ: