ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

সংসদের ক্ষমতা নিয়ে রায় আপীল বিভাগে টিকবে না

প্রকাশিত: ০৫:২৪, ৭ মে ২০১৬

সংসদের ক্ষমতা নিয়ে রায় আপীল বিভাগে টিকবে না

বিকাশ দত্ত ॥ বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ন্যস্ত করে আনা সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করায় রাজনৈতিক অঙ্গনে তোলপাড় শুরু হয়েছে। বিচার বিভাগ ও জাতীয় সংসদ প্রায় মুখোমুখি অবস্থানে। একদিকে হাইকোর্টের রায়, অন্যদিকে জাতীয় সংসদের সাংসদগণ। জাতীয় সংসদে সাংসদগণ ইতোমধ্যে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন এ রায় সংবিধান পরিপন্থী। সংসদের প্রণীত আইন আদালত বাতিল করে একটি খারাপ দৃষ্টান্ত স্থাপন করল। এদিকে রাষ্ট্রপক্ষ আগামীকাল রবিবার হাইকোর্টের আদেশের কার্যকারিতা স্থগিত চেয়ে চেম্বার আদালতে আবেদন করবে। রায়ের পর সাবেক প্রধান বিচারপতি ও আইনকমিশনের চেয়ারম্যান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের দেয়া বক্তব্যের পর বিচারপতি, আইনজীবী, সাংসদ ও রাজনীতিবিদগণ বলেছেন, সংসদ স্বাধীন ও সার্বভৌম। নিয়ম মেনেই বিচারপতি অপসারণের বিষয়টি সংসদের হাতে রাখা হয়েছে। আইনের অথরিটি পার্লামেন্ট। বৃহস্পতিবার বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক জনকণ্ঠকে বলেছিলেন, এ রায় দ্বারা বাংলাদেশের সার্বভৌম জনগণ এবং তাদের প্রতিনিধি জাতীয় সংসদকে অপমান করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ন্যস্ত করে আনা সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করেছে হাইকোর্ট। এরপর দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তি প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সাংসদ কাজী ফিরোজ রশিদ জনকণ্ঠকে বলেছেন, সাংসদ স্বাধীন ও সার্বভৌম। নিয়ম মেনেই বিচারপতি অপসারণের বিষয়টি সংসদের হাতে রাখা হয়েছে। যে কেউ ইচ্ছা করলে তা বাতিল করে দেবে তা হতে পারে না। এভাবে চললে সংসদের কোন মান মর্যাদা থাকে না। এদিকে আপীল বিভাগের সাবেক বিচারপতি প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান মমতাজ উদ্দিন আহম্মেদ জনকণ্ঠকে বলেছেন, বিচারপতিরাও আইনের উর্ধে নয়। কেউ ইমোশন হয়ে বলতে পারে আমরা সংসদের মুখাপেক্ষী হব না। ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা বিষয়ে তিনি বলেন, পূর্ণাঙ্গ রায় না পড়ে কিছু বলা যাবে না। আর এটি আপীলে যাবে। আপীলে অনেক মামলাই টিকে না। সংসদ আইন করবে। আইনের অথরিটি পার্লামেন্ট। বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের সহ-সভাপতি সিনিয়র আইনজীবী আব্দুল বাছেত মজুমদার জনকণ্ঠকে বলেছেন, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ৭২ সালের সংবিধান রাখা উচিত ছিল। সামরিক সরকার রদবদল করেছিল। পুনরায় শেখ হাসিনা তা পুনস্থাপন করেছেন। রায় সম্পর্কে কোন মন্তব্য করব না। ১৯৭২ সালের মূল সংবিধানে যে ব্যবস্থা ছিল তা ফিরিয়ে আনতে এ সরকার সংবিধান সংশোধন করেছে। এটা বহাল রাখা প্রয়োজন ছিল। উল্লেখ্য, ১৯৭২ সালে প্রণীত মূল সংবিধানে উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা জাতীয় সংসদের কাছে ছিল। ১৯৭৫ সালের ২৪ জানুয়ারি সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে এ ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে অর্পণ করা হয়। পরে জিয়াউর রহমানের শাসনামলে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা দেয়া হয় সুপ্রীম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের কাছে। মার্শাল প্রক্লামেশনে করা পঞ্চম সংশোধনীতে এক্ষেত্রে ৯৬ অনুচ্ছেদে পরিবর্তন আনা হয়েছিল। ষোড়শ সংশোধনীতে সেটা বাতিল করে বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা ফিরিয়ে দেয়া হয় সংসদকে। এ প্রসঙ্গে আইনমন্ত্রী এ্যাডভোকেট আনিসুল হক সংসদে বলেছেন, বিচারক অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে আনতে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী ‘অবৈধ’ ঘোষণা করে দেয়া হাইকোর্টের রায়কে ‘সংবিধান পরিপন্থী’। তিনি বলেন, সংসদের সিদ্ধান্ত অবৈধ বলে দেয়া এই রায় আপীল বিভাগে টিকবে না। রাষ্ট্রপক্ষ এখন আপীলের প্রস্তুতি নিচ্ছে। ‘আমরা আইনী পথেই যাব। আমরা গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে কোন ষড়যন্ত্র সহ্য করব না’। ‘উচ্চ আদালতের বিচারক অপসারণের ক্ষমতা সংসদের কাছে ফিরিয়ে নিতে ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী আনা হয়। বিলটি পাসের পর একই বছরের ২২ সেপ্টেম্বর তা গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়। ওই সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ৫ নবেম্বর হাইকোর্টে এই রিট আবেদন হয়। প্রাথমিক শুনানির পর হাইকোর্ট ২০১৪ সালের ৯ নবেম্বর রুল দেয়। রুলে ওই সংশোধনী কেন অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হবে না তা জানতে চাওয়া হয়। মন্ত্রিপরিষদ সচিব, রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ের সচিব, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব, আইন সচিব, সংসদ সচিবালয়ের সচিবকে দুই সপ্তাহের মধ্যে রুলের জবাব দিতে বলা হয়। হাইকোর্টের রায়ের পর সাবেক প্রধান বিচারপতি ও আইনকমিশনের চেয়ারম্যান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক বলেছেন, এ রায় দ্বারা বাংলাদেশের সার্বভৌম জনগণ এবং তাদের প্রতিনিধি জাতীয় সংসদকে অপমান করা হয়েছে। আমি যদিও এই রায়ের সঙ্গে একবারেই একমত নই, তবুও সংবিধানের ১১২ অনুচ্ছেদ অনুসারে পার্লামেন্ট ব্যতীত এই রায় আমাদের সকলের ওপর বাধ্যকর। যতক্ষণ পর্যন্ত না ইহা আপীল বিভাগ কর্তৃক স্থগিত বা বাতিল না হয়। তিনি আরও বলেন, আমি আরও বিনীতভাবে নিবেদন করতে চাই যে, আমাদের স্বাধীন হাইকোর্ট বিভাগ মূল সংবিধানের বিধান পরিত্যাগ করে প্রডাক্ট অব মার্শাল ল’ কে কি করে গ্রহণ করতে পারল তা আমার চিন্তার বাইরে। এই রুলের ওপর গত বছর ২১ মে শুনানি শুরু হয়। ওইদিন আদালত মতামত দিতে এ্যামিকাস কিউরি হিসেবে জ্যেষ্ঠ পাঁচ আইনজীবীর নাম ঘোষণা করেন। এর মধ্যে ড. কামাল হোসেন, ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম, ব্যারিস্টার রোকন উদ্দিন মাহমুদ ও আজমালুল হোসেন কিউসি এই শুনানিতে এ্যামিচি কিউরি হিসেবে নিজেদের মতামত তুলে ধরেন। আদালত তার রায়ে উল্লেখ করেছে, সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ও সংবিধান পরিপন্থী। সুপ্রীমকোর্টের ৯ আইনজীবীর করা একটি রিট আবেদনে দেয়া রুলের চূড়ান্ত শুনানি শেষে বৃহস্পতিবার বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী, বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক ও বিচারপতি মোঃ আশরাফুল কামালের বিশেষ বেঞ্চ বৃহস্পতিবার সংখ্যাগরিষ্ঠের মতের ভিত্তিতে এই রায় দেন। রায় ঘোষণার পর এক প্রতিক্রিয়ায় সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহম্মেদ জনকণ্ঠকে বলেছেন, আমার মতে সবারই ধৈর্য ধরা উচিত। যেহেতু এ রায়টি আপীলে যাবে। সেই পর্যন্ত সবার ধৈর্য ধরতে হবে। আপীলেই ঠিক হবে এই সংশোধনী টিকবে কি টিকবে না। তবে আইন করা প্রয়োজন। কারোর বিরুদ্ধেই অভিযোগ দিলেই অপসারণ করা যায় না। তদন্ত কি প্রক্রিয়ায় হবে তার ওপর নির্ভর করে। আদালতের রায়ের পর দেখা যায় বিচার বিভাগ ও সংসদ অনেকটাই মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে তা বলা যায় না। কারণ সংসদে সাংসদগণ তাদের অভিব্যক্তি ব্যক্ত করেছেন। বৃহস্পতিবার সংসদে বিরোধীদলের নেতা রওশন এরশাদের নেতৃত্বে সংসদ সদস্যরা ওয়াকআউট করে এর প্রতিবাদ জানান। সরকারী দলের সাংসদগণ বলেছেন, ১৯৭২ সংবিধানে বিচারপতিদের অভিশংসন করার ক্ষমতা এই সংসদেরই ছিল। আমরা যেটা আইন তৈরি করি ওনারা (বিচারপতি) সেটা কার্যকর করেন। সংসদ হচ্ছে জনগণের সার্বভৌম অধিকারের প্রতীক। সাংসদগণ বলেন, আমরা ওই রায়ে হতবাক ও বিস্মিত হয়েছি। আজ বাংলাদেশকে ঘিরে নানা দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্র চলছে। ‘রাষ্ট্রপতির বিচার যদি এই সংসদ করতে পারে, তাহলে বিচারপতিরা কোথা থেকে ওখানে বসেছেন। এই সংসদই তো আইন পাস করে তাদের বসিয়েছেন। আইন বহির্ভূত কোন বিচার করার জন্য বসানো হয়নি। এই সংসদে উনাদের বেতন ভাতা বৃদ্ধির আইন এসেছে। আমরা যদি এটা পাস করে না দিই, তাহলে উনারা কি তা পাস করাবেন? অপরদিকে এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, ‘তিনজন বিচারপতির মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারপতির ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করেছেন এবং বাতিল করেছেন। তারা যুক্তি দেখিয়েছেন যে, বিচারকদের যদি পার্লামেন্টের দ্বারা অপসারণের বিধান রাখা হয়, তাহলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ক্ষুণœ হবে। তারা বলতে চেয়েছেন এ বিষয়ে আলাদা ট্রাইব্যুনাল থাকে। এই ট্রাইব্যুনালই বিচারকদের অপসারণের বিষয়টি সম্পন্ন করে।’ রায় নিয়ে তাদের পরবর্তী পদক্ষেপ সম্পর্কে মাহবুবে আলম বলেন, ‘এই আদেশে আমরা সংক্ষুব্ধ এবং এই আদেশের বিরুদ্ধে আপীলের জন্য আমরা রায়ের সার্টিফায়েড কপি নিয়েছি। আগামী রবিবার এই আদেশের কার্যকারিতা স্থগিত চেয়ে আমরা চেম্বার আদালতে আবেদন করব।’ ষোড়শ সংশোধনীর ৯৬(২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘প্রমাণিত অসদাচরণ বা অসামর্থ্যরে কারণে সংসদের মোট সদস্য সংখ্যার অন্যূন দুই-তৃতীয়াংশ গরিষ্ঠতার দ্বারা সমর্থিত সংসদের প্রস্তাবক্রমে প্রদত্ত রাষ্ট্রপতির আদেশ ছাড়া কোন বিচারককে অপসারিত করা যাবে না।’ ৯৬(৩) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, দফা (২) এর অধীন প্রস্তাব সম্পর্কিত পদ্ধতি এবং কোন বিচারকের অসদাচরণ বা অসামর্থ্য সম্পর্কে তদন্ত ও প্রমাণের পদ্ধতি সংসদ আইনের দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। সেই তদন্ত ও প্রমাণের পদ্ধতি এবং অপসারণের প্রক্রিয়া ঠিক করে তৈরি একটি আইনের খসড়ায় গত ২৫ এপ্রিল নীতিগত অনুমোদন দেয় মন্ত্রিসভা। ২০১৪ সালে জাতীয় সংসদে সর্বসম্মতিক্রমে এই বিলটি অনুমোদন লাভ করে। এটি ২০১৪ সালের ১৩ নং আইন হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়। সংবিধানের ১৬তম সংশোধনীর বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো সুপ্রীমকোর্টের বিচারকদের প্রমাণিত অসদাচরণ বা অসামর্থ্যরে জন্য জাতীয় সংসদের মোট সদস্য সংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশের প্রস্তাবক্রমে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক কোন বিচারকে অপসারণ করা যাবে। অসদাচরণ, অসামর্থ্য তদন্ত পদ্ধতি সংসদ আইন দ্বারা নিরুপণ করতে পারবে। এতদসংশ্লিষ্ট আইন সম্প্রতি মন্ত্রিসভা অনুমোদন করেছে। প্রকাশ থাকে যে, ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকাসহ কমনওয়েলথভুক্ত ৩৮ শতাংশ রাষ্ট্রে সংসদের মাধ্যমে বিচারকদের অপসারণের বিধান রয়েছে। ১৯৭২ সালে অনুরূপ বিধান গণপরিষদ কর্তৃক গৃহিত হয়েছিল। যা বাংলাদেশের সংবিধানের অন্যতম মৌলিক কাঠামো।
×