ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

ড. এম. শহীদুল্লাহ

কেন এই কান্না

প্রকাশিত: ০৬:৪১, ৬ মে ২০১৬

কেন এই কান্না

গত ২৩ এপ্রিল, শনিবার জঘন্যতম হত্যাকা-ের শিকার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক প্রফেসর এ.এফ.এম. রেজাউল করিম সিদ্দিকীকে কি নিষ্ঠুরভাবে পৃথিবী থেকে চিরতরে বিদায় জানানো হয়েছে তা জাতি ইতোমধ্যেই পত্র-পত্রিকা ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার মাধ্যমে অবহিত হয়েছে। এদেশের আবালবৃদ্ধবনিতা সকল নাগরিকের মতো এই লেখকেরও জিজ্ঞাসাÑ কেন এই পরিণতি? কি এমন অপরাধ ছিল এই নিবেদিতপ্রাণ সফল শিক্ষকের। শিক্ষকতার পেশাকে যিনি প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতেন, বিভাগের উন্নতিসাধন, বিভাগের মঙ্গলকে ঘিরেই যার চিন্তা-চেতনা আবর্তিত হতো, বিভাগের ছাত্রছাত্রীরা যার কাছে ছিল সন্তানতুল্য এবং বিভাগের শিক্ষার্থীরাও যাকে তাদের পিতৃতুল্য ধ্যান করতেন, তাদের পিতার মতোই ভালোবাসতেন সেই শিক্ষকের কি এ পৃথিবীর কাছে এটিই পাওনা ছিল? তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রী, তাঁর প্রিয় সন্তানদ্বয়- কন্যা রিজওয়ানা হাসিন শতভী ও পুত্র রিয়াসাত হাসান সৌরভ কিভাবে মেনে নেবে এই নৃশংসতা, কিভাবে আমরা তাঁর সহকর্মীরা, তাঁর প্রাক্তন ও বর্তমান ছাত্র/ছাত্রীরা এই পরিণতিকে মেনে নেব। কেন এই শোক! কেন এই কান্না? কিভাবে এ জাতি প্রবোধ দেবে তাঁর স্ত্রী, সন্তান, পরিজনদের? আজ ১০ দিন হলো প্রফেসর সিদ্দিকীর নিষ্ঠুর, নির্মম বিদায়। পরিবার শোকে স্তব্ধ হয়ে গেছে। পরিজনসহ তাঁর সকল পরিচিতজন এবং ইংরেজী বিভাগ তথা বাংলাদেশের সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল শিক্ষক ও শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা, কর্মচারীবৃন্দ শোক বিহ্বল, হতভম্ব, দিশেহারা। স্ত্রী, সন্তান ও আত্মীয়পরিজনদের চোখে অশ্রুর বন্যা। গোটা জাতি শোকাহত। প্রফেসর সিদ্দিকী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকা অবস্থায় আমার একবছর উপরে পড়তেন, আমি যখন ১ম বর্ষ সম্মান শ্রেণীতে ভর্তি হই, তখন তিনি ২য় বর্ষের ছাত্র। কাজেই ছাত্রজীবন থেকেই তাঁকে দেখেছি। উপরের ক্লাসের ছাত্রদের সঙ্গে খুব বেশি মেলামেশার সুযোগ পাইনি। তবে তিনি যে মেধাবী ছাত্র ছিলেন তা জানতাম। তাঁকে প্রায়ই দেখতাম কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের পাঠকক্ষে গভীর মনোযোগের সঙ্গে, নিবিষ্টচিত্তে পড়াশোনা করতে। পড়ার সময় দিন-দুনিয়ার কোন কিছু খেয়াল থাকত না বলে মনে হতো। তিনি শহরে শালবাগানের নিজ বাড়িতে থাকতেন। একটি পুরাতন মোটরসাইকেল চালিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসতেন। আমরা হলে থাকতাম। তাই তাঁর সঙ্গে ছাত্রজীবনে খুব একটা ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুযোগ পাইনি। তবে বিভাগের খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক কর্মকা- ইত্যাদি সময়ে তাঁকে দেখতাম। তখন থেকেই তাঁকে দেখেছি একজন সহজ-সরল সাধারণ মানুষ হিসেবে। পড়াশোনাই ছিল তাঁর প্রধানতম কাজ। তিনি ¯œাতক সম্মান পরীক্ষায় ১ম ও ¯œাতকোত্তর পরীক্ষায় ২য় স্থান অধিকার করেন। প্রফেসর সিদ্দিকীসহ আমরা ৪ জন ১৯৮৩ সালের ফেব্রুয়ারি-মার্চে কয়েকদিনের ব্যবধানে ইংরেজী বিভাগের প্রভাষক হিসেবে যোগদান করি। চারজনের মধ্যে আমিই বয়োকনিষ্ঠ ছিলাম বলে অন্য তিনজনকেই আমি ভাই বলে সম্বোধন করতাম। প্রফেসর সিদ্দিকীকেও আমি ‘সিদ্দিকী ভাই’ বলে সম্বোধন করতাম। ৩৩ বছরের অধিক সময় আমরা একই সঙ্গে চাকরি করেছি। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর আমরা বিভাগের একাডেমিক, সাংস্কৃতিক এবং খেলাধুলা প্রভৃতি কার্যক্রমের সঙ্গে কাজ করেছি। এসব কাজের মধ্য দিয়ে প্রফেসর সিদ্দিকীকে জানার সুযোগ পেয়েছি, অনেক ভালো করে বুঝতে পেরেছি। তিন-চার বছর আমরা দু’জন একই কক্ষে বসতাম। আমি দেখেছি শিক্ষার্থীরা তাঁকে কতটা গভীরভাবে ভালোবাসত এবং শ্রদ্ধা করত এবং তিনিও তাদের কিভাবে সন্তানের মতো ভালোবাসতেন। তিনি দীর্ঘদিন বিভাগের খেলাধুলা এবং সাংস্কৃতিক কর্মকা-ের দায়িত্বে ছিলেন। তিনি শ্রেণীকক্ষের বাইরেও বিভাগীয় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে গভীরভাবে মিশতেন। শিক্ষার্থীদের তিনি কতটা আপনজন ছিলেন তা না দেখলে বোঝা যায় না। তিনি জড়নবৎঃ ইৎড়হিরহম এর ওপর পি-এইচ.ডি ডিগ্রী লাভ করেন। গবেষণা কাজের জন্য প্রায়ই কলকাতার ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে পড়াশোনা করতে যেতেন। এছাড়াও যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্রের ইৎড়হিরহম ঝড়পরবঃু এবং ইৎড়হিরহম খরনৎধৎু থেকে প্রচুর গবেষণা পুস্তক ও জার্নাল সংগ্রহ করতেন। ইৎড়হিরহম এর ওপর তার কিছু গবেষণা প্রবন্ধও রয়েছে। প্রফেসর সিদ্দিকী সাদামাটা-সাধারণ জীবনযাপন করতেন। তবে তাঁর ছিল সৃজনশীল মন ও মানস। শিল্প সাহিত্য, সঙ্গীত, স্পোর্টস ইত্যাদির প্রতি তাঁর ছিল অকৃত্রিম ভালোবাসা ও অনুরাগ। তিনি নিজে মাঝেমধ্যে গান করতেন, আর তা করতেন মূলত সঙ্গীতের প্রতি ভালোবাসা থেকেই। তিনি সেতার বাজাতেন, ফটোগ্রাফির প্রতি তাঁর বিশেষ ঝোঁক। অনেক দাম দিয়ে একটি ঠরফবড় ক্যামেরা কিনেছিলেন। বিভাগের বিভিন্ন প্রোগ্রামে গভীর মনোযোগ সহকারে, একাগ্রচিত্তে বিভিন্ন অহমষব থেকে ঠরফবড় চিত্র ধারণ করতেন। পরে ছাত্র-শিক্ষক সবাইকে সেগুলো প্রদর্শনের ব্যবস্থা করতেন। সাংস্কৃতিক কর্মকা-ের দায়িত্বে ছিলেন বলে তাঁর নিজের কক্ষটিতে বিভিন্ন প্রোগ্রামের পূর্বে রিহার্সাল হতো। খেলাধুলার সরঞ্জামও তাঁর অফিসেই অনেকদিন রক্ষিত ছিল। কখনও কখনও তিনি নিজেও বিভাগের পক্ষে ছাত্রদের সঙ্গে খেলাধুলায় অংশ নিতেন, বিশেষ করে ভলিবল খেলায়। এ বছর প্রথম দুই রাউন্ড ক্রিকেট খেলায় বিভাগের টিম জয়লাভ করলে বিভাগের ছেলেমেয়েরা একটি বিজয় মিছিল বের করে; সে মিছিলের অগ্রভাগে ছিলেন প্রফেসর সিদ্দিকী; তাঁর আনন্দ ও উচ্ছ্বাস ছিল দেখবার মতো। বিভাগের প্রতি তাঁর ভালোবাসা ছিল অপরিসীম। প্রফেসর সিদ্দিকীর মেয়ে শতভী আমার ছোট মেয়ের সহপাঠী ও বান্ধবী। সে ইংরেজী বিভাগেরই ছাত্রী। এবার এম.এ. পরীক্ষা দিল। মেয়ের বান্ধবী, তদুপরি ছাত্রী, তাই শতভী আমার মেয়ের মতোই। শতভীর ব্যথা ভারাক্রান্ত মুখ দেখলে আমার তো বটেই যে কোন মানুষেরই কষ্ট হয়। ছেলে সৌরভ নিস্তব্ধ হয়ে গেছে। গুছিয়ে কথা বলতে পারছে না। কথা শুরু করলে খেই হারিয়ে ফেলছে, সবকিছু ভুলে যাচ্ছে। মিসেস সিদ্দিকী সন্তান দুটিকে নিয়ে দুঃখের সাগরে নিপতিত। আমাকে দেখে সেদিন তিনি বিলাপ করছিলেন “সিদ্দিকী মেয়ের বিয়ে দিয়ে গেল না। ছেলে এখনও পাস করে বের হলো না। সিদ্দিকী আমাকে কোন অথৈ সাগরে ভাসিয়ে গেল?” সত্যি তো এই সাগরের কূল কিনারা নাই। এ রকমভাবে স্বামীকে হারানো স্ত্রী, পিতাকে হারানো সন্তানের অবস্থা কি হতে পারে তা অনুমান করা যায়। তিনি অত্যন্ত সহজ-সরল প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। চিন্তা-চেতনায় অসাম্প্রদায়িক এবং একেবারেই নির্দলীয় ছিলেন। বহুবছর আগের একটি ঘটনা মনে পড়ছে। আমরা তখন সহকারী অধ্যাপক। আমাদের সিন্ডিকেট নির্বাচনের পূর্বে প্রফেসর ক্যাটাগরির একজন সিন্ডিকেট পদপ্রার্থী উনার কাছে ভোট চাইতেই তিনি অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে উত্তর দিলেন, “স্যার আপনি দাঁড়িয়েছেন, তা তো জানিনা- আপনার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী গত সন্ধ্যায় আমাকে বলল, আমি তো উনাকে কথা দিয়ে ফেলেছি। আমি দুঃখিত স্যার। আগে যদি জানতাম আপনি দাঁড়িয়েছেন তাহলে উনাকে কথা দিতাম না।” তাঁর এ রকম সারল্যের অনেক উদাহরণ আছে। এ রকম একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের এ রকম পরিণতি হবে যে কোন মানুষের কাছেই সেটি বিস্ময় এবং খুবই অভাবনীয়। এ রকম ঘটনার কোন পুনরাবৃত্তি আর জাতি প্রত্যাশা করে না। সকল নাগরিকের নিরাপত্তা বিধানে রাষ্ট্র এবং সরকার এগিয়ে আসবে সেটাই জাতির প্রত্যাশা। দেশের সকল নাগরিক এ রকম বর্বরতার বিরুদ্ধে সোচ্চার হবেন সেটিই আমাদের প্রত্যাশা। পরিশেষে আমি প্রফেসর ড. এ.এফ.এম. রেজাউল করিম সিদ্দিকীর আত্মার মাগফিরাত কামনা করি। তাঁর শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি রইল আমার এবং আমাদের বিভাগের সকল শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর গভীর সমবেদনা। লেখক : ইংরেজী বিভাগ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
×