ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মোহাম্মদ সাখাওয়াত হোসেন

একজন আদর্শ শিক্ষক

প্রকাশিত: ০৬:৪১, ৬ মে ২০১৬

একজন আদর্শ শিক্ষক

প্রফেসর রেজাউল করিম সিদ্দিকী স্যার ছিলেন আমার শিক্ষক এবং সহকর্মী। তাঁকে হারিয়ে যে বেদনা ও শূন্যতার মধ্যে পড়েছি, সেই অবস্থায় ভালভাবে কিছু গুছিয়ে লেখা প্রায় অসম্ভব। তবু চেষ্টা করছি স্যারের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে কিছু লিখতে। এটা বলা হয়ে থাকে যে, কখনো কখনো মৃত ব্যক্তি জীবিত ব্যক্তির চেয়ে বেশি শক্তিশালী এবং কারও অনুপস্থিতি তার উপস্থিতির চেয়ে বেশি অনুভূত হয়। হঠাৎ স্যারের নির্মম হত্যাকা- আমাকে ও আমাদের ইংরেজী বিভাগকে বুঝিয়ে দিয়েছে যে, স্যার আমাদের কত প্রিয় ও বিভাগের কত বড় মূল্যবান সম্পদ ছিলেন। নিঃসন্দেহে সিদ্দিকী স্যার শ্রেণীকক্ষ শিক্ষক হিসেবে অত্যন্ত সফল ও সকলকালের ছাত্র-ছাত্রীর নিকট খুবই জনপ্রিয় ছিলেন। ক্লাসের প্রতি তাঁর আগ্রহ ছিল অপরিসীম এবং এক্ষেত্রে বিভাগে, এমনকি, বিশ্ববিদ্যালয়েও অদ্বিতীয় বলে আমার বিশ্বাস। কোন তুচ্ছ বাধা বা কারণে উনি কখনো ক্লাস বাদ দিতেন না। মিটিং, সেমিনার, হরতাল, বিভাগে কোন ছোট/বড় খাবার অনুষ্ঠান কোন কিছুই তাকে ক্লাসে যাওয়া থেকে বিরত রাখতে পারত না। স্যারের কোন বন্ধুকেও কখনো দেখিনি ক্লাস চলাকালীন তার কাছে আসতে। আমি জানি না, স্যারের আদৌ কোন ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল কিনা। আসলে স্যার খুব একাকীত্ব ভাল বাসতেন। তিনি প্রায়ই ক্লাসে ম্যাথু আর্নল্ডেরকবিতার এই চরণটি বলতেন, ‘আমরা লাখ লাখ মরণশীল মানুষ একাকী বাস করি (ডব সড়ঃধষ সরষষরড়হং ষরাব ধষড়হব.)।’ আসলে স্যার তার নিজের একটা জগৎ গড়ে তুলেছিলেন। সেখানে ছিল নিয়মিত ক্লাস, পুরাতন ও নতুন সিনেমা ডাউনলোড করা ও দেখা, কখনো একা ও কখনো ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে ক্লাসিক গান শোনা ও গান গাওয়া, সেতার বাজানো শেখা, ছোট গল্প ও কবিতা লেখা। স্যার ‘কোমলগান্ধার’ নামে একটি ছোট সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনা করতেন ও নিজেই প্রকাশ করতেন। তার এই পত্রিকায় সাধারণ মানুষ ও ছাত্র-ছাত্রীদের লেখা স্থান পেত। তবে এসব কিছুই ছিল তাঁর শখ এবং তিনি বিশ্বাস করতেন, সাংস্কৃতিক চর্চা মানুষের ভাল গুণাবলীকে বিকশিত করে। স্যার ক্লাসে খুবই মনোযোগী থাকতেন এবং কবিতা, নাটক ও নন ফিকশনের প্রতিটা লাইন তিনি পড়তেন ও ব্যাখ্যা করতেন। ছাত্র-ছাত্রীদের প্রশ্নও করতেন তিনি। প্রশ্নের উত্তর সঠিক হলে তাঁর স্বকীয় ভঙ্গিতে বলতেন, ‘জরমযঃ ুড়ঁ ধৎব, ঞযধঃ’ং রঃ.’ তিনি সবসময় যুক্তির সাহায্যে একটা বিষয়কে নানাবিধভাবে দেখতে বলতেন। জড়নবৎঃ ইৎড়হিরহম, গধঃঃযবি অৎহড়ষফ, অষভৎবফ ঞবহহুংড়হ এর কবিতা পড়াতে ভাল বাসতেন। তিনি বিভাগের প্রথম স্ব-তত্ত্বাবধানে (সম্ভবত বিশ্ববিদ্যালয়েরও প্রথম) জড়নবৎঃ ইৎড়হিরহম এর উপর পিএইচডি ডিগ্রী অর্জন করেন। সাহিত্যের প্রতি তার প্রবল আগ্রহ ও অনুরাগ ছিল। ক্লাসের দুর্বল ছাত্র-ছাত্রীদের তিনি প্রায় প্রতিদিনই উপদেশ দিতেন। ‘মূল বই পড়ো, শুধু নোট পড়ো না, শুদ্ধ ইংরেজী লেখ।’ স্যার নিজে খুব সৎ মানুষ ছিলেন ও ছাত্র-ছাত্রীদের জীবনে সৎ ও পরিশ্রমী হতে বলতেন। তিনিই একমাত্র শিক্ষক যিনি আমাদের চূড়ান্ত পরীক্ষার খাতার ভুলত্রুটি একটি কাগজে লিখে নিয়ে আমাদের ক্লাসে আসতে বলেছিলেন। তিনি ভাল উত্তরপত্র ও তুলনামূলক দুর্বল উত্তরপত্র নিয়ে আলোচনা করতেন। তিনিই একমাত্র শিক্ষক যিনি ক্লাসের ব্ল্যাকবোর্ডে একটি বড় প্রশ্নের উত্তর লিখেছিলেন আমাদের বোঝানোর জন্য যে কিভাবে ভাল ও বড় প্রশ্ন লিখতে হয়। মাঝে মধ্যে কত নম্বর কাকে দিতেন, সেটাও ক্লাসে সবার সামনে বলে দিতেন। তার মতো ছাত্র-ছাত্রীবান্ধব শিক্ষক খুবই বিরল। বিভাগের প্রতিটি কালচারাল অনুষ্ঠানে, বিতর্ক প্রতিযোগিতা ও খেলাধুলায় স্যারকে সবসময় পাওয়া যেত। প্রতিটি অনুষ্ঠানে তিনি একজন কমোন বক্তা। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান সংগঠনের দায়িত্ব বিভাগ থেকে তাঁকেই দেয়া ছিল এবং তিনি তা রিহার্সেলের মাধ্যমে ভালভাবেই পালন করতেন। খেলাধুলার দায়িত্বও স্যারের উপরই ছিল। তবে মাঝে, আমি কয়েক বছর খেলাধুলার দায়িত্বে ছিলাম। আন্তঃবিভাগ ফুটবল ও ক্রিকেট দল স্যার নিজেই সাজাতেন। প্র্যাকটিশ সেশনে উপস্থিত থাকতেন। স্যার ও আমি যৌথভাবে খেলা দেখতাম ও স্যার নিজের ঠরফবড় ঈধসবৎধ এর মাধ্যমে সকল চৎড়মৎধস ঠরফবড় করতেন। ক্যামেরায় জীবনের স্মরণীয় মুহূর্তগুলোকে ধরে রাখার প্রবল বাসনা ছিল তাঁর। আমি আমার স্ত্রীকে (স্যারের ছাত্রী) নিয়ে একদিন স্যারের বাসায় বেড়াতে গিয়েছিলাম। তিনি খুব খুশি হয়ে আমাদের অভ্যর্থনা জানালেন এবং সঙ্গে সঙ্গে ঠরফবড় ঈধসবৎধ টা এনে আমাদের ঠরফবড় করলেন ও বললেন,“কবে আর আসবা তোমরা কে জানে, এই মুহূর্তটা স্মরণীয় হয়ে থাক।’ খেলার মাঠের উত্তেজনা ও আবেগ দেখে খুবই বিস্মিত হতাম। স্যারের বয়স ৬১ হলেও মনে হতো তিনি একজন ছাত্র। বিভাগের খেলোয়াড়দের নিয়ে প্রায়ই হতাশার কথা বলতেন। ছেলেদের ঢ়যুংরপধষ ভরঃহবংং ও যথাযথ অনুশীলন না করাকে তিনি হারের কারণ হিসেবে উল্লেখ করতেন। তবে যতদিন আমি স্যারের সঙ্গে খেলার মাঠে ছিলাম ইংরেজী বিভাগ কমপক্ষে প্রথম ম্যাচটা জিতেছে। মাঝে মধ্যে দুটো ম্যাচও জিতেছে। প্রথমবার দুটো ম্যাচ জেতাতে ছেলে-মেয়েরা বিভাগে একটা পিকনিকও করেছিল। তবে স্যারের তত্ত্বাবধানে স্যারের শেষ ম্যাচে বিভাগ ক্রিকেটে তৃতীয় ম্যাচটা জিতেছে। স্যারকে এর পূর্বে কখনো এত খুশি দেখা যায়নি। আমি তখন পরীক্ষার হলে ডিউটি করছিলাম, স্যারেরও ডিউটি ছিল, কিন্তু তিনি ফঁঃু না করে খেলার মাঠে চলে গেলেন। খেলার মাঠ থেকে তিনি ঢ়যড়হব এ আমাকে বললেন, “সাখাওয়াত, ওঃ রং ধ ফধু ঃড় ৎবসবসনবৎ. ওঃ রং যরংঃড়ৎু ভড়ৎ সব ধহফ ঃযব ফবঢ়ধৎঃসবহঃ ঃড় রিহ ঃযব ঃযরৎফ সধঃপয.” স্যার ছাত্রজীবনে ফুটবল ও ভলিবল খেলতেন। আগেই বলেছি স্যার বিভাগে বসে পুরনো সিনেমা ডাউনলোড করতেন। তিনি ইংরেজী ও বাংলা উপন্যাস নিয়ে রচিত সিনেমাগুলো ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝে মাঝে দেখাতেন। আমি নিজেও অনেক সিনেমা নিয়েছি স্যারের কাছ থেকে। স্যার আমাকে শেষ কড়হমর’ং ঐধৎাবংঃ ডাউনলোড করে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু হায়! ভাগ্যের কি পরিহাস, তিনি অকালে খুন হয়ে গেলেন। কেন হলেন? কারা তাকে খুন করল? কারা এই রকম একজন নিরীহ, সাধাসিধা মানুষটাকে খুন করল? স্যার যখন বিভাগের চেয়ারম্যান তখন আমি বিএ সম্মান পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করায় ইংরেজী এ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটারি হই। এই সুবাদে স্যারের সঙ্গে বেশকিছু অনুষ্ঠান একইসঙ্গে আয়োজন করি। মনে পড়ে, ঈশ্বরদীর পাকশীতে পিকনিকের কথা। স্যার গাড়িতে একটা পুরাতন রেডিও নিয়ে এসে গান শুনছিলেন। বিভাগের সকল অনুষ্ঠান আগে শহীদুল্লাহ কলা ভবনের ১৫০ নং রুমে বা অন্য কোন রুমে হতো। স্যার প্রথম কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির পেছনের আমবাগানে নবীনবরণ অনুষ্ঠানটা আয়োজন করেছিলেন। ব্যক্তিগতভাবে আমি আমার লেখাপড়া ও পধৎববৎ এর জন্য স্যারের কাছে ঋণি। মাস্টার্সের থিসিসের ঞড়ঢ়রপ আমি স্যারের এক লেকচার থেকে পেয়েছিলাম। স্যার আমাকে আমেরিকার ইৎড়হিরহম খরনৎধৎু এর ঠিকানা দিয়েছিলেন এবং সেই ঠিকানায় ই-মেইল লিখে আমি একটা ধৎঃরপষব পেয়েছিলাম, যা আমার খুব কাজে লেগেছিল। স্যার আমাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার জন্য খুব উপদেশ দিতেন এবং কীভাবে ভাল রেজাল্ট করতে হবে সে বিষয়ে দিকনির্দেশনাও দিয়েছেন। স্যারের সঙ্গে আমি বিভাগে দুটি উৎধসধ ঈড়ঁৎংব ভাগ করে পড়াতাম। সম্মান ১ম বর্ষ ও এমএ শেষ বর্ষে। স্যার দুই কোর্সের ট্র্যাজেডি পড়াতেন- গধপনবঃয, জরফবৎং ঃড় ঃযব ঝবধ, খড়হম উধু’ং ঔড়ঁৎহবু রহঃড় ঘরমযঃও অ ঝঃৎববঃ ঈধৎ ঘধসবফ উবংরৎব. স্যারকে একদিন বললাম স্যার আমাকে একটা ট্র্যাজেডি পড়াতে দেন। স্যার বললেন না, তোমরা ুড়ঁহম ছেলে, এখনই ট্র্যাজেডি পড়িয়ে বিষণœ থাকার দরকার নেই। স্যার ঞৎধমরপ ারংরড়হ ড়ভ ষরভব নিয়ে প্রায় কথা বলতেন। বলতেন আমরা লক্ষকোটি মানুষের মধ্যে আছি, তবুও আমরা একাকী। আমাদের একাকী পৃথিবী থেকে চলে যেতে হবে। স্যার আপনিও তাই করলেন। এত নিঃসঙ্গভাবে আপনাকে চলে যেতে হলো। এত বড় ট্র্যাজেডির মধ্যে আমরা এখন ডুবে গেছি। কিন্তু এখন আমরা আর নিঃসঙ্গ নই, আপনিও নন। আমরা হাজারো মানুষ, আপনার ছাত্র-ছাত্রী-সহকর্মী আপনাকে ভালবাসি এবং আপনাকে হত্যার প্রতিবাদ ও ন্যায় বিচার দাবি করছি। সিদ্দিকী স্যার অনেক বই পড়তেন। বইপড়া ছিল তার নেশা। ইংরেজী সাহিত্যের পাশাপাশি বাংলা সাহিত্যও পড়েছেন বেশ। তিনি পরীক্ষার হলে এসেও চেয়ারটাকে দরজার এক কোনায় টেনে নিয়ে বই পড়তেন। একদিন স্যারকে বললাম, স্যার আপনি যখন বই পড়েন, তখন ছেলে-মেয়েরা কথা বলে ও উত্তরপত্র দেখে নেয়। স্যার বলল,“আমি জানি, কিন্তু আমি এও জানি যে, তাদের যদি বইও দিয়ে দেয়া হয়, তবুও তাদের পরীক্ষা একই রকম হবে। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের আমি অসম্মান করতে চাই না। স্যার এতটাই উদার ও ছাত্র-ছাত্রীবান্ধব ছিলেন। স্যার খুবই সরল জীবনযাপন করতেন। অতি সাধারণ পোশাক পরতেন। বিলাসিতার কোন ছাপ স্যারের জীবনে ছিল না। তিনি সাহিত্য, গান, গণতন্ত্রকে ভালবাসতেন। তিনি সমাজের অসমতা নিয়ে সচেতন ছিলেন; বস্তুবাদ ও ভোগবাদের জীবনযাপন থেকে নিজেকে দূরে রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। তার কোন ছাত্র-ছাত্রী কোন দিন বুঝতে পারেনি যে, তিনি কোন রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাসী। বরং তিনি রাজনীতির অশুভ দিকগুলোর সমালোচনা করেছেন ও মানুষের ব্যক্তি স্বাধীনতাকে মূল্য দিতেন। তিনি সমাজের সকলকে নিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করতে হবে- এ রকম কসমোপলিটান চেতনা নিয়ে জীবন ধারণ করতেন। তার নিজের প্রাচুর্য না থাকলেও তিনি গরিব মানুষকে দান করতেন, মসজিদ মাদ্রাসায় টাকা দিতেন। নান্দনিক কাজে অর্থ ব্যয় করতেন; নিজ টাকায় দামী ভিডিও ক্যামেরা ও সেতার এবং অন্যান্য সামগ্রী কিনেছিলেন। নিজ অর্থ ব্যয়ে পত্রিকা বের করতেন। এ রকম উদার ও মানবপ্রেমী মানুষ কারও শত্রু হতে পারে, কারও আক্রোশের কারণ হতে পারেÑ এ আজ গোটা জাতিকে ভাবিয়ে তুলেছে। স্যারের মৃত্যুর খবর প্রথমে ভয়ঙ্কর স্বপ্নের মতো মনে হয়েছে। শোনামাত্র বিভাগের অন্যান্য শিক্ষক ও প্রক্টোর স্যারের সঙ্গে আনুমানিক ৮:১৫ এর দিকে স্যারের বাসায় রওয়ানা হই। স্পটে পৌঁছে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। নিথর দেহটা রক্ত ও ধুলোয় মুখ গুঁজে পড়ে আছে। শোনলাম গলা প্রায় পুরোটা কেটে গেছে। অবিশ্বাস্য! এই রকমভাবে মানুষ মানুষকে মারতে পারে। এ কেমন হত্যা। ৬১ বছর বয়সী একজন অধ্যাপককে হঠাৎ সন্ত্রাসীরা হত্যা করে পালাল। এ কেমন বর্বরতা। আমার স্যার হয়ত বুঝে ওঠার আগেই মারা গেছেন। স্যার বিশ্ববিদ্যালয় যাওয়ার জন্য ৭টা ৩৫ এর গাড়ি ধরতে বের হয়েছিলেন। কিন্তু সেদিন শ্রমিক ধর্মঘটের কারণে বাস চলেনি। সেটি স্যার আগে জানলে হয়ত বা সেদিন আর বের হতেন না। ভাবী ও স্যারের ছেলে-মেয়ের দিকে তাকাতে পারছিলাম না। কি বলে, কি ভাষায় সান্ত¡না দেব। ভাবী বলছিলেন- হার্ট এ্যাটাক হলেও মানুষ পাঁচ মিনিট সময় পায়। কিন্তু তোমার স্যার কিছুই বলে যেতে পারলেন না। মৃত ব্যক্তির কাছের মানুষজন যেমন মৃত ব্যক্তির শেষ কথা শুনতে চায়, মৃত ব্যক্তিরও সেই রকমই আকুল আগ্রহ থাকে কিছু শেষ কথা মৃত্যুর পূর্বে বলে যাবার জন্য। এক্ষেত্রে জোসেফ কনরাডের লর্ড জিম উপন্যাসের কয়েকটা লাইন আমার মনে পড়ছেÑ ... শেষ কথা বলা হলো না- সম্ভবত কখনোই বলা হবে না। আমাদের জীবনটা কি খুবই ছোট না, সেই শেষ কথা বলার জন্য, যদিও তা আমাদের প্রত্যেকেরই পরম ইচ্ছা? আমি শেষ কথা বলার আশা ছেড়ে দিয়েছি ... শেষ কথা বলার সময় কখনো পাওয়া যায় নাÑ আমাদের ভালবাসার, চাওয়া-পাওয়ার, বিশ্বাসের, অনুশোচনার, পরাজয়ের ও প্রতিবাদের শেষ কথা বলার সময় কখনো পাওয়া যায় না। তাই আমাদের এই ক্রমবর্ধমান সংকীর্ণমনা সমাজে সকলকে অনুরোধ জানাই, তাদের জীবনের শেষ কথাটা জন্মের পরপরই নতুবা মরার অনেক আগেই লিখে রাখার জন্য। কারণ যে কোন সময় আপনি হত্যার শিকার হতে পারেন বা গুম হয়ে যেতে পারেন। গুপ্তহত্যা চলছে। বিভিন্ন নামের ব্যানারে এমন সব কার্যকলাপ ঘটছে বলেই আমরা খবরের কাগজ ও টিভি নিউজে দেখতে পাই। এমনিতেই জীবনে অশান্তির শেষ নেই। রোগ-বালাই, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অর্থনৈতিক অসমতা, ক্ষুধা-দারিদ্র্য, চাকরি ও সকল ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা, পরিবার থেকে শুরু করে সমাজের প্রায় সকল জায়গায় বিভেদ ও অসমতা আমাদের জীবনকে মৃতপ্রায় করে রেখেছে। এবং মরব আমরা সবাই একদিন। তাহলে কেন এত মারার ও মরার ইচ্ছা? কি লাভ, কার লাভ, এই মেরে ফেলা ও মারা যাওয়ার মধ্যে দিয়ে? এমনিতেই প্রতিদিন স্বাভাবিক মৃত্যুর পাশাপাশি ছিনতাইকারীর হাতে, সড়ক দুর্ঘটনায় কত প্রাণ যাচ্ছে। প্রাণ যাওয়া তো বন্ধ নেই। তবু কেন এত প্রাণ হত্যার আকাক্সক্ষা? তবে কি কবি ইয়েটস এর ভাষায় বলতে হবে যে, “সমাজে আজ ভাল মানুষেরা নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছে এবং মন্দ মানুষেরা খুবই সক্রিয় হয়ে গেছে। কেন্দ্র (রাষ্ট্র/সরকার) কিছু ধরে রাখতে পারছে না। সবকিছু এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। কেবল নৈরাজ্য এই পৃথিবীর বুকে নেমে এসেছে।” না এতটা নিরাশাবাদী আমরা নই। হতেও চাই না। রাষ্ট্র তার দায়িত্ব এড়াতে পারে না। এই মৃত্যু, এই খুন মহামারী রূপ নেয়ার আগে সরকারকে, রাষ্ট্রকে দায়িত্ব নিতে হবে। দায়িত্ব শুধু হত্যার পর হত্যাকারীদের বিচার করা নয়, দায়িত্ব নিতে হবে যেন আর কোন হত্যা না হয়। সেজন্য মূল সমস্যাকে চিহ্নিত করে সম্মিলিত প্রচেষ্টায় তা উৎপাটন করতে হবে। নিশ্চিত করতে হবে মানুষের মৌলিক চাহিদা, বেঁচে থাকার অধিকার, স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার অধিকার। এই ভূখ-ে যদি একটা পাখিও না খেয়ে মারা যায়, তার দায়িত্ব রাষ্ট্রকে নিতে হবে। প্রত্যেকেই জানে ‘একতাই বল, বিভাজনে পতন’। আমাদের সকলকেই একই ছাদ, একই আকাশ“বাংলাদেশের নিচে দাঁড়াতে হবে। আমাদের সকলের নিজস্ব ধ্যান ধারণা, স্বকীয় বিশ্বাস, বিভিন্নতা নিয়েই আমাদের এক পতাকাতলে দাঁড়াতে হবে। কারণ আমাদের একতার রাজনীতি হলে, সমঝোতার রাজনীতি হলে সন্ত্রাসীরা দুর্বল হয়ে পড়বে। সন্ত্রাসীরা বিভাজন খোঁজে। কারণ বিভাজিত সমাজে যে কোন পক্ষের আশ্রয় নেয়ার আশায় তারা থাকে। সাম্রাজ্যবাদ এই পৃথিবীতে সম্ভব হয়েছিল এবং এখনও হচ্ছে এই বিভাজনের কারণে। আসুন আমরা একে অন্যকে হত্যা না করি। একসঙ্গে বাঁচি ও একে অন্যের জন্য বাঁচি। যদি তা আমরা না করতে পারি, অন্তত একে অন্যের মৃত্যুর কারণ হতে চাই না। আসুন মরতে যখন হবে, তখন বরং মরি একে অন্যের জন্য, একে অন্যকে বাঁচানোর জন্য। যে কোন ধরনের হত্যা, ধর্ষণ, অত্যাচার, নির্যাতন কোনভাবেই কোন আদর্শ, বিশ্বাস, ও ধারণা দিয়ে বৈধ করা যায় না। ধর্মের কারণে হত্যা, রাজনৈতিক হত্যা ও ব্যক্তিগত কারণে হত্যাÑ কোন হত্যাই কোনভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। হত্যা হচ্ছে ঘৃণ্য। হত্যা পৃথিবীর সমস্যাগুলোর কোন সমাধান নয়। বরং, এটা কারণ। প্রাণ একমাত্র আল্লাহ তায়ালাই তৈরি করেন, ফলে তা কেড়ে নেয়ার অধিকার কারও নেই। পবিত্র কোরানে আছে, “যদি কেউ একজন নিরীহ ব্যক্তিকে হত্যা করল, তবে সে যেন সমগ্র মানবজাতিকে হত্যা করল। এবং যদি কেউ একজনের জীবন বাঁচাল, তবে সে যেন সমগ্র মানবজাতির জীবন বাঁচাল (সূরা মায়িদা, আয়াত-৩২)।” এখানে একটি জীবনের কথা বলা হয়েছে। এই জীবনকে কোন জাতি, বর্ণ, ধর্ম দিয়ে আলাদা করা হয়নি। সাধারণ একটা জীবনের কথা বলা হয়েছে। সমস্ত হত্যা ও অরাজকতা থেকে মুক্ত হতে হলে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। পক্ষপাতদুষ্টতা দূর করতে প্রকৃত গণতন্ত্র আনতে হবে। আর প্রকৃত গণতন্ত্রের জন্য গণতন্ত্রীমনা মানুষ গড়তে হবে। এই মানুষ গড়ার দায়িত্বই শিক্ষকদের। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের এই দায়িত্বটা বেশি। দেশের প্রতিটি মা-বাবা, স্কুল, মাদ্রাসা, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক যদি সহিষ্ণুতার শিক্ষা দেয়, মডারেট ধর্মীয় মূল্যবোধ ও মানবতাবাদের শিক্ষা দেয়, অহিংসার শিক্ষা দেয়, পরস্পর পরস্পরকে ভালবাসার শিক্ষা দেয়, তবে আমরা আদর্শ জাতি হতে পারব, পারব এই পৃথিবীকে, এই মানবজাতিকে মানবহত্যাসহ সকল অন্যায়-অবিচারের গ্লানি থেকে মুক্তি দিতে। লেখক : শিক্ষক, ইংরেজী বিভাগ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
×