ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সখিনা সুলতানা

মৎস্যচাষে শেফালীর সাফল্য

প্রকাশিত: ০৬:৩৮, ৬ মে ২০১৬

মৎস্যচাষে শেফালীর  সাফল্য

সেদিন সকালেও বুঝিনি আজ দিনটা আমার জন্য কত সুন্দর। বুঝলাম তখন, যখন খবর এলো জাতীয় মৎস্যসপ্তাহ উপলক্ষে সাতক্ষীরা জেলার শ্রেষ্ঠ ক্ষুদ্রমৎস্যচাষী হিসেবে পুরস্কারের জন্য আমি মনোনীত হয়েছি। আনন্দে-উদ্বেলিত মন ছুটে যেতে চাইল সেই সংগ্রামী দিনগুলোতে। বিয়ের পর সংসার আর সন্তাদের নিয়েই ব্যস্ত ছিলাম। স্বামী মোঃ শাহ জাহান মাছচাষ করতেন। মাছের ব্যবসা থেকে যে আয় রোজগার হতো, তা দিয়ে ১ ছেলে ও ২ মেয়ে নিয়ে ৫ জনের সংসার চলত কোনরকমে। আস্তে আস্তে সুদিনের আশায় আমিও স্বামীর মাছচাষের কাজে যুক্ত হই। কিন্তু পুরনো পদ্ধতিতে মাছচাষ করে বছর শেষে তেমন একটা লাভ হয় না, আবার এই পদ্ধতিতে মাছচাষে সমস্যাও অনেক বেশি। সমস্যা সমাধানের চেষ্টাও করেছি, লাভ হয়নি। ভাবছিলাম কিভাবে মাছচাষে উন্নতি করা যায়। এমন সময় সিরিয়াল সিস্টেমস্ ইনিসিয়েটিভ ফর সাউথ এশিয়া ইন বাংলাদেশ (সিসা-বিডি) প্রকল্পের আওতায় ওয়ার্ল্ড ফিশ এবং টিএমএসএস যৌথভাবে সাতক্ষীরা সদর উপজেলায় উন্নত পদ্ধতিতে মাছচাষের ওপর প্রকল্প শুরু করে। প্রকল্পটির সুষ্ঠু বাস্তবায়নের জন্য টিএমএসএস ও ওয়ার্ল্ডফিশ কর্মীগণ সাতক্ষীরা সদর উপজেলার খানপুর গ্রামে ‘ফোকাস গ্রুপ ডিসকাশন’ (এফজিডি)-এর মাধ্যমে মাছচাষীদের একটি প্রাথমিক তালিকা তৈরি করে। তালিকা থেকে যাচাই-বাছাই শেষে প্রশিক্ষণের জন্য ২৫ জন মাছচাষীর তালিকা চূড়ান্ত করে। আমি সে তালিকায় স্থান পাই। ২৫ জন মাছচাষী নিয়ে শুরু হয় দিনব্যাপী প্রশিক্ষণ। সেখানে ঘের ও নার্সারি ব্যবস্থাপনা, চুন প্রয়োগ, মাছ পরিচর্যা এবং হিসাব সংক্রান্ত জ্ঞান ও দক্ষতা বিষয়ে বিশদ প্রশিক্ষণদান করে। প্রশিক্ষণের জ্ঞান নিয়ে এবার নিজের ৫০ শতক জমিতে গলদা ও সাদা মাছচাষের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। প্রশিক্ষণ থেকে প্রাপ্ত শিক্ষানুযায়ী প্রথমে ঘেরের কালোকাদা সরিয়ে মাটিতে চাষ দিয়ে চুন প্রয়োগ করি এবং এর পাশাপাশি পোনা পরিচর্যার জন্য আলাদাভাবে নার্সারি তৈরি করি। প্রশিক্ষণে দেয়া তথ্য অনুযায়ী একে বলে ’টব-ব্যবস্থাপনা’। প্রথমে এই কাজটি শেষ করে ঘেরে প্রয়োজনীয় পানি মজুদের ব্যবস্থা করি; এরপর নার্সারির পোনা ঘেরে অবমুক্ত করে, প্রশিক্ষণের নিদের্শনামাফিক মাছচাষের প্রতিটি ধাপ অনুসরণ করে মাছগুলো বড় করতে থাকি এবং দ্রুত ফল পেতে শুরু করি। এ বছর আমি ৮৫ কেজি গলদা, ২৫০ কেজি কার্পজাতীয় মাছ উৎপাদনে সক্ষম হই। মাছচাষে বছরে আমার ব্যয় হয় ৩৩,৯০০/- (তেত্রিশ হাজার নয় শত) টাকা এবং মাছ বিক্রি করি ১,০২,১৪২/- (এক লক্ষ দুই হাজার একশত বিয়াল্লিশ) টাকা; আর এতে লাভ হয় ৬৮,২৪২/-(আটষট্টি হাজার দুইশত বিয়াল্লিশ) টাকা। মৎস্য ঘেরের পাশে আমার সবজি ক্ষেত। সবজি ক্ষেতের সব ব্যয় বাদ দিয়ে বছরে লাভ থাকে ৭০,০০০/-(সত্তর হাজার) টাকা। সত্যি বলতে কী, এতটাকা একসাথে এর আগে আমি আর কখনো দেখিনি। এজন্য আমি কৃতজ্ঞ টিএমএসএস, ওয়ার্ল্ডফিশ ও সর্বোপরি আমার সৃষ্টিকর্তার কাছে। এই সুদিন তিনি আমাদের দিয়েছেন। আজ আমার সাফল্যের কথা মাঠদিবস করে এলাকায় ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। এই কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ জাতীয় মৎস্যসপ্তাহ উপলক্ষে সাতক্ষীরা জেলা মৎস্য অফিস এলাকার সব ক্ষুদ্র মাছচাষীদের তথ্যসংগ্রহ ও পর্যালোচনা করে ২০১৪ সালের সাতক্ষীরা জেলার শ্রেষ্ঠ ক্ষুদ্র চাষী পুরস্কারে আমাকে ভূষিত করেছে। আমি মোছাঃ শেফালী বেগম এলাকার ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা ও বেকারদের অনুসরণীয় ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছি। আজ ছেলে-মেয়েরা স্কুলে লেখাপড়া করছে। এখন আমার সুখের দিন, বলতে পারেন আমি আজ মৎস্যরানী।
×