ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

নাজনীন বেগম

রবীন্দ্রনাথের অদম্য দামিনী

প্রকাশিত: ০৬:৩৮, ৬ মে ২০১৬

রবীন্দ্রনাথের  অদম্য দামিনী

‘গোরা’ উপন্যাসের প্রায় চার বছর পর রবীন্দ্রনাথের আর এক সাড়া জাগানো বই ‘চতুরঙ্গ’ প্রকাশ পায়। ‘চতুরঙ্গ’ ধারাবাহিকভাবে সবুজপত্রে প্রকাশ পেতে থাকে। পত্রিকাটিরও তখন মাত্র সূচনাকাল। এই বছরটিতে (১৯১৪) প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজে ওঠে। আগের বছর কবির নোবেল প্রাপ্তি। নবজাগরণ, উপমহাদেশীয় বিচিত্র ঘটনা, নোবেল জয়, বিশ্বপরিসরে যুদ্ধের উন্মত্ততা সব মিলিয়ে অবিভক্ত বাংলা তথা ভারত রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টির পথকে করে আরও অবারিতমুক্ত। ফলে মাত্র চার বছর আগের লেখা ‘গোরা’র গোরা, কৃষদয়াল, পরশবাবু, বিনয় কিংবা সুচরিতার জায়গায় ডাগমোহন, শচীশ, বিলাস কিংবা দামিনীর মতো চরিত্র সৃষ্টি করা অভাবনীয় একযুগ পরিকল্পনা। দামিনীর পূর্বাভাস পাই আমরা ললিতার মধ্যে। কিন্তু কৃষদয়ালের সঙ্গে ভাগমোহন কিংবা বিনয়, গোরার সঙ্গে শচীমা বা শ্রীবিলাসের ফারাক বিস্তর। কারণ রবীন্দ্রনাথ নিজেই। বিশ শতকের প্রথম দশকের রবীন্দ্রনাথ আর দ্বিতীয় দশকের রবীন্দ্রনাথ এক নন। চিন্তায়, মননে, সৃজনশীলতায়, বস্তুনিষ্ঠ আলোচনায় অনেক আর্থ-সামাজিক ঘটনার দ্রষ্টা ও অংশীদার রবীন্দ্রনাথ নিজেই তখন যুগের অগ্রগামী চিন্তার সফল নায়ক। যেমন ভাগমোহন, শচীশ ও শ্রীবিলাসের নতুন জীবন দর্শন আরও তীব্রভাবে দামিনীর চারিত্রিক নির্ভীকতা, অবিচলতা, সমাজকে অতিক্রম করার আত্মপ্রত্যয় সব মিলিয়ে ব্যতিক্রমী মাত্রা যোগ হয়। আর তাই ‘চতুরঙ্গ’ তাঁর আগের কিংবা পরের অনেক উপন্যাস থেকে আলাদা এবং বলিষ্ঠ মতাদর্শের দাবি করে। সঙ্গত কারণেই নারী চিন্তায়ও আসে সুদূরপ্রসারী ভাবনা। যার স্পষ্ট বহির্প্রকাশ ঘটে ‘দামিনী’র মতো চরিত্র সৃষ্টির সাহসী চিন্তায়। সমাজ প্রচলিত নিয়ম-শৃঙ্খলতার বিরুদ্ধে বিধবা-নিঃসঙ্গ এক নারীর বিদ্রোহ, স্বাতন্ত্রিক চেতনাবোধ, নির্ভীক মানসিকতা রবীন্দ্রনাথের বিদ্রোহী মননের বিপ্লবী মনস্তত্ত্ব যা তাঁর সমগ্র সাহিত্যে বিরল। অদমনীয় দামিনীকে রবীন্দ্রনাথ যে আন্তরিক সৌন্দর্যে মূর্ত করে তোলেন সেখানেও আমরা দেখতে পাই স্বাধীনচেতা, অধিকার সচেতন, সঙ্কল্পবদ্ধ নারীর প্রতি লেখকের স্পর্শকাতর অনুভব। দামিনীর দৃঢ় ব্যক্তিত্ব, নিজের সিদ্ধান্তে বলিষ্ঠ প্রত্যয়, প্রতিবাদী চেতনা রবীন্দ্রনাথের শৈল্পিক দ্যোতনায় আরও দীপ্ত হয়ে ওঠে। তিনি বলেন, ‘দামিনী যেন শ্রাবণের মেঘের ভেতরকার দামিনী। বাহিরে সে পুঞ্জ পুঞ্জ যৌবনে পূর্ণ; অন্তরে চঞ্চল আগুন ঝিকমিক করিয়া উঠিতেছে।’ স্বামীর বর্তমানে আশ্রম গুরুকে উপেক্ষা করা, ধর্মাশ্রিত সমাজের কোন বিধি-নিষেধকে আমল না দেয়া দামিনীর স্বভাবজাত। দামিনী শুধু বিদ্রোহীই নয় একেবারে বিপ্লবী। ঠা-া মাথায় ধীরস্থিরভাবে পুরুষ শাসিত সমাজের শাসন-পোষণকে দাপটের সঙ্গে অবজ্ঞা করে। মেয়ে হলেও মানুষের মর্যাদা নিয়ে বাঁচার অধিকার তারও আছে, নিজের ইচ্ছা-অনিচ্ছা, আশা-আকাক্সক্ষা প্রকাশের স্বাধীনতাও তার থাকা বাঞ্ছনীয়। এ বোধ থেকে দামিনী হয়ে ওঠে প্রথাবিরুদ্ধ এক জেদি, তেজি নারী। স্বামী শিবনাথ আমৃত্যু স্ত্রী দামিনীকে না নিজের প্রতি, না গুরু লীলানন্দ স্বামীর প্রতি পূজায়, নিবেদনে আকর্ষণ করতে ব্যর্থ হয়। শিবনাথ মৃত্যুর সময় স্ত্রীসহ সমস্ত সম্পত্তি স্বামীজীর হাতে অর্পণ করে। কিন্তু দামিনীকে কোনভাবেই বশীভূত করা যায় না। বিদ্রোহী দামিনী বৈধব্যের কোন জ্বালা সহ্য করতে পারে না। তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোন সর্বনাশকেও সে কাছে ঘেঁষতে দেয়নি। কখনও বিপথগামীও হয়নি। স্বামীজীর কোন নির্দেশ, উপদেশ, বিধি-নিষেধ অকারণে, অপ্রয়োজনে মেনেও নেয়নি। আধুনিক বই পড়ার প্রবল ইচ্ছা দামিনীর চরিত্রের অন্যতম আকর্ষণ। চিন্তায়, মননে, কর্মে দামিনীর সময়োপযোগী ভাবনা তাকে চিরকালের এক উদ্দীপ্ত নারীর মর্যাদায় আসীন করে। সযতেœ, সন্তর্পণে সে নিজের লক্ষ্মীশ্রীকে দৃঢ়ভাবে রক্ষা করে। গুরুজির অন্যায় আবদারকে সে দর্পভরে প্রত্যাখ্যানও করে। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে নারী স্বাধীনতা কতখানি জোরালো ছিল তা শুধু দামিনী চরিত্র দিয়ে অনুভব করা কঠিন। লেখকের সুবিশাল সাহিত্যকর্মেও বিধবা নারীর এতখানি ঔদ্ধত্য খুঁজে পাওয়া দায়। আধুনিক বই পড়া নিয়ে দামিনীর সঙ্গে গুরুজীর তর্ক উল্লেখ করার মতো। গুরুজী কহিলেন, মা সেই বইগুলিতো তোমার পড়িবার যোগ্য নয়। দামিনী কহিল, আপনি বুঝিবেন কি করিয়া? গুরুজী ভ্রƒকুঞ্চিত করিয়া বলিলেন, তুমিই বা বুঝিবে কি করিয়া? আমি পূর্বেই পড়িয়াছি, আপনি বোধহয় পড়েন নাই। স্পষ্টবাদী, নির্ভীক, একরোখা, দাম্ভিক দামিনী রবীন্দ্রনাথের ভিন্নমাত্রার, ভাবনার এক জ্বলন্ত স্ফুরণ, নিঃসন্তান, সহায়সম্বলহীন এক বিধবা নারী নতুন দিগন্তের ভাবসম্পদে সমৃদ্ধ হয়ে পুরুষ শাসিত সমাজের শক্তিমান রক্ষাকর্তাকে যেভাবে দাপটের সঙ্গে অবজ্ঞা করে। অমান্য করে তা সত্যিই অকল্পনীয়। সমাজের কঠিন সংস্কারের বিরুদ্ধে ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবোধ উদ্বুদ্ধ অদম্য দামিনী বিদ্রোহের যে বহ্নিশিখা প্রজ্বলিত করে তার আলোই তাকে বাঁচার পথ দেখায় এবং আপন ইচ্ছায় নিজের মতো করে বাঁচেও। সবশেষে শচীশ কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হয়ে নিজের ইচ্ছা এবং শ্রীবিলাসের সম্মতিতে দামিনী নতুন সংসার গড়ে। এখানেও দামিনী নবযুগের এক সাহসী পথিক। বিলাসের সঙ্গে এই পথচলায়ও দামিনী আপন মহিমায় অম্লান থাকে।
×