ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলার অপকৌশল!

প্রকাশিত: ০৫:৩১, ৬ মে ২০১৬

সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলার অপকৌশল!

বিভাষ বাড়ৈ ॥ একের পর এক প্রশ্ন ফাঁস হচ্ছে। পরীক্ষা শুরুর এক ঘণ্টা আগে হুবহু প্রশ্ন চলে যাচ্ছে ফেসবুক, ভাইবার, হোয়াটস এ্যাপসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। সর্বশেষ দুই পরীক্ষায়ও ফাঁস হয় প্রশ্ন। আবার সেই ফাঁস হওয়া প্রশ্নে নেয়া হয়েছে মঙ্গলবারের পদার্থ বিজ্ঞান পরীক্ষা। পরীক্ষা শুরুর আগ মুহূর্তে শিক্ষা সচিব, অতিরিক্ত সচিব, যুগ্ম সচিব, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকসহ সকলের কাছেই এসে যায় প্রমাণ। পরীক্ষা শুরু হলেও দেখা যায়, ফাঁস হওয়া প্রশ্নের সঙ্গে তার হুবহু মিল। এভাবে একের পর এক প্রশ্ন ফাঁস করছে একটি গোষ্ঠী অথচ শিক্ষা মন্ত্রণালয়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, শিক্ষা বোর্ড এমনকি বিটিআরসিও কোন কূলকিনারা পাচ্ছে না। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রশ্ন ছেড়ে দেয়ার ঘটনাকে কোন কেন্দ্রের ইচ্ছাকৃত অপকর্ম হিসেবে অভিহিত করেছেন শিক্ষাবিদরা। শিক্ষা মন্ত্রণালয়, শিক্ষা বোর্ডসহ সংশ্লিষ্ট সকলের কাছেই এখন পরিষ্কার চলমান এইচএসসি পরীক্ষায় একের পর এক প্রশ্ন ফাঁস হচ্ছে পরীক্ষা শুরুর এক ঘণ্টা আগে। তবে অপরাধী ধরার বিষয়ে কর্তৃপক্ষ পুরোপুরি ব্যর্থ। শিক্ষা বোর্ড বলছে, আমরা বিষয়টি শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছি। মন্ত্রণালয় বলছে, অপরাধীদের ধরার জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও বিটিআরসির সহযোগিতা নেয়া হচ্ছে। তবে ফল পাওয়া যাচ্ছে না। এ অবস্থায় বুধবারও ঘটেছে একই ঘটনা। এদিন উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় পদার্থবিজ্ঞান প্রথম পত্রের প্রশ্ন ফাঁস হয়। বুধবার দুপুর দু’টায় এই পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকলেও দুুপুর একটায় ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রশ্নের একটি সেট ছড়িয়ে পড়ে। এই প্রতিবেদকের হাতেও একটি ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্রের কপি আসে। এই সেটের নাম বলাকা, পাদার্থবিজ্ঞান সৃজনশীল- প্রথমপত্র। প্রশ্ন পাওয়ার পরই বিষয়টি জানানো হয় শিক্ষা সচিব মোঃ সোহরাব হোসেন, যুগ্ম সচিব রুহী রহমান, ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক ড. শ্রীকান্ত কুমার চন্দকে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব চৌধুরী মুফাদ আহমেদের সঙ্গে এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলেও তা সম্ভব হয়নি। প্রশ্ন ফাঁসের বিষয়টি নিয়ে এসএমএস পাঠানো হলেও তিনি কোন সাড়া দেননি। তবে সচিব সোহরাব হোসেন ও যুগ্ম সচিব রুহী রহমান পরীক্ষার ঠিক আগ মুহূর্তে হাতে পাওয়া একটি প্রশ্নের কপি চাইলে মন্ত্রণালয়ে সেটি ভাইবারের মাধ্যমে পাঠানো হয়। তবে শেষ মুহূর্তে সচিব কিছুটা অসহায়ত্ব প্রকাশ করে বলেন, দেখেন এখন আর কী করার আছে? একটু পরই তো পরীক্ষা। দেখা যাক, পরীক্ষার মূল প্রশ্নের সঙ্গে ফাঁস হওয়া প্রশ্নের মিল পাওয়া যায় কিনা। এদিকে ২টায় পরীক্ষা শুরু হলে দেখা গেল প্রশ্নের হুবহু মিল। ঢাকা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক ড. শ্রীকান্ত কুমার চন্দ বলেন, ইতোপূর্বে এমন ঘটনা ঘটেছে। আমরা বিষয়টি মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছি। তিনি আরও বলেন, গত কয়েক দিনের ঘটনার পর বুধবার সকাল থেকে কড়া নজরদারির মাধ্যমে প্রশ্নপত্র বিতরণের কাজ করা হয়। পরীক্ষার ঠিক আগ মুহূর্তে প্রশ্নপত্র কেন্দ্রে পাঠিয়েছি যাতে কেউ প্রশ্নপত্র বাইরে সরাতে না পারে। তার পরেও যদি এমন ঘটনা ঘটে থাকে তাহলে আমাদের কী বা করার থাকে। বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। এ বিষয়ে তিনি আরও বলেন, একটি মহল সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করার জন্য প্রশ্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়। আমরা অপরাধীদের ধরার জন্য অভিযান অব্যাহত রেখেছি। গত অন্তত চারটি পরীক্ষায় পর পর ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা শুরুর এক ঘণ্টা আগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মূল প্রশ্নের ছবি তুলে হুবহু প্রশ্ন ছেড়ে দেয়া হয়েছে। যেখানে ঘোষণা দিয়েই পরপর একই কাজ নির্বিঘেœ করে যাচ্ছে আহমেদ নিলয় নামের একজন। পরীক্ষা শুরুর এক ঘণ্টা আগেই ফেসবুকে তার টাইমলাইনে প্রশ্নপত্র পাওয়া যায়। শিক্ষা বোর্ডের কর্মকর্তারা বৃহস্পতিবার বলেছেন, ঘোষণা দিয়ে এভাবে একের পর এক প্রশ্ন হুবহু ফাঁস করার ঘটনা নজরে এসেছে শিক্ষা বোর্ডের। ইতোমধ্যেই পরীক্ষা শুরুর আগে ঢাকার কয়েকটি কলেজে অভিযান চালিয়েছেন কর্মকর্তারা। কিন্তু এখনও অপরাধীরা রয়ে গেছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। বোর্ডের পক্ষ থেকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়েছে দ্রুত বিষয়টি পরীক্ষাসংক্রান্ত আইনশৃঙ্খলা কমিটির মাধ্যমে বিটিআরসিকে অবহিত করে এ্যাকশন নিতে। বোর্ড কর্মকর্তারা সন্দেহ করছেন, পরীক্ষা শুরুর আগে প্রশ্নে বান্ডিল খোলার পরই একটি চক্র মোবাইলে সেই প্রশ্নের ছবি করে ফেসবুকে ছড়িয়ে দিচ্ছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই টাকার লেনদেনেরও প্রমাণ মিলছে না বরং ফেসবুকে ছেড়ে দিয়ে একটি চক্র সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলতে চায় বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞরা। সর্বশেষ পরীক্ষা শুরুর এক ঘণ্টা আগেই ফেসবুকে প্রশ্নপত্র ফাঁস করেন আহমেদ নিলয় নামে এক ব্যক্তি। প্রশ্নপত্রটি ইমেজ (ছবি) আকারে আপলোড করেছেন। অনুষ্ঠিত পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের সঙ্গে ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্রের হুবহু মিল পান বোর্ড কর্মকর্তারাও। এর আগেও জীববিজ্ঞানসহ পরপর তিন পরীক্ষায় ঠিক এক ঘণ্টা আগে প্রশ্ন ফাঁস করেন একই ব্যক্তি। আহমেদ নিলয় নামের ওই ব্যক্তি তার ফেসবুক পেজে ঢাকা শিক্ষাবোর্ডের জীববিজ্ঞান দ্বিতীয়পত্র পরীক্ষার প্রশ্ন ঠিক সকাল ৮টা ৫০ মিনিটে আপলোড করেন। তিনি তার ফেসবুকে বুয়েট ছাত্রলীগের দফতর সম্পাদক হিসেবে নিজের পরিচয় দিয়েছেন। তবে বুয়েট ছাত্রলীগ সভাপতি শুভ্র জ্যোতি টিকাদার তাদের সংগঠনে এই নামের কেউ নেই বলে জানান। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, এই ব্যক্তি কেবল নিজের পরিচয় বলাতেই মিথ্যার আশ্রয় নেননি, একই সঙ্গে ফেসবুকে যে ছবি ব্যবহার করেছেন তাও অন্যের। এখানেই শেষ নয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অপরাধী কতটা বেপরোয়া তার প্রমাণ পাওয়া যায় পর পর তিনটি পরীক্ষার আগে ফেসবুকে দেয়া স্ট্যাটাসে। আগের মতো বুধবারও পরীক্ষার শুরু আগেই অপরাধী আহমেদ নিলয় তার ফেসবুক টাইমলাইনে লিখেছেন, ‘সাংবাদিকদের জন্য কিচ্ছু দিতে মন চায় না। অনেক বড় বিপদে আছি, তারপরও সাহায্য না করে পারলাম না। সবাই দোয়া করো। ইনশাল্লাহ যাতে তোমাদের পাশে থাকতে পারি। এর আগে জীববিজ্ঞান পরীক্ষা দিন তিনি তার টাইমলাইনে লিখেছিলেন, প্রতিদিনের মতো আজকের সকাল বেলা প্রশ্ন সবাইকে ফ্রি দিলাম, শুধুমাত্র প্রমাণ দেয়ার জন্য। পরীক্ষার হল থেকে এসে মিলিয়ে নিও।’ বিশেষ দ্রষ্টব্য দিয়ে আরও লেখা হয়েছে, ‘এখন কিছু চিটার বাটপার আছে, যারা আমার ফ্রি দেয়া প্রশ্নের কপি মেরে, ৫০০/১০০০ টাকা বিক্রি করছে। এদের থেকে সাবধান হন এবং চিটার বাটপার গুলিকে ধরতে সাহায্য করেন।’ কিন্তু প্রশ্ন কোথা থেকে ফাঁস হচ্ছে তার একটা ধারণা পাচ্ছেন সরকারের কর্মকর্তারা। একই ধারণা শিক্ষা বিশেষজ্ঞদেরও। ঢাকা শিক্ষাবোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক ড. শ্রীকান্ত কুমার চন্দ বলছিলেন, সাধারণত পরীক্ষা কেন্দ্রে প্রশ্ন যায় এক ঘণ্টা আগে। সেখান থেকেই বান্ডিল খোলার পর এটি কোন কেন্দ্র থেকে ফাঁস করা হয়েছে বলে বোঝা যাচ্ছে। কারণ মোবাইলে ছবি করে হুবহু প্রশ্ন দেয়া হচ্ছে বলেই প্রমাণ মিলেছে। পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক জানান, আমরা ইতোমধ্যেই রাজধানীর উত্তর ও দক্ষিণ খানে কয়েকটি কেন্দ্রে পরীক্ষার দিন এক ঘণ্টা আগে অভিযান চালিয়েছি। তবে সেসব কেন্দ্রে বান্ডিল বন্ধই পেয়েছি। এখনও অপরাধীকে চিহ্নিত করা সম্ভব হয়নি। তবে অভিযান চলছে। মন্ত্রণালয়ও সক্রিয় আছে। অন্যদিকে পরীক্ষাসংক্রান্ত আইনশৃঙ্খলা কমিটির এক সদস্যের কাছে বিষয়টি জানতে চাইলে তিনি বলেন, ঘটনার প্রমাণ আমরাও পাচ্ছি। তবে কোন্ এলাকা থেকে কে বা কারা করছে তা এখনও পরিষ্কার করা সম্ভব হয়নি। এদিকে শিক্ষাবিদরা ফেসবুকে প্রশ্ন ছেড়ে দেয়ার ঘটনাকে কোন কেন্দ্রের ইচ্ছাকৃত অপকর্ম হিসেবে অভিহিত করেছেন। জাতীয় শিক্ষা নীতি প্রণয়ন কমিটির সদস্য সচিব অধ্যাপক শেখ ইকরামুল কবীর বলছিলেন, পরপর কয়েকটি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হলো? বিষয়টা আসলেই উদ্বেগজনক। তবে যেহেতু আগের দিন ফাঁস হচ্ছে না, হচ্ছে পরীক্ষার দিন। তাও এক ঘণ্টা আগে। এতে পরিষ্কার যে কেন্দ্রে প্রশ্ন গেলে এরপর তা ফাঁস করা হচ্ছে। এ শিক্ষাবিদ বলেন, ফেসবুকে দিয়ে দিলে টাকা পাওয়া যাবে না। তার পরেও সেখানে দেয়া হচ্ছে। এর কারণ হলো, সরকারকে হেয় করা, শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে হেয় করা। শিক্ষামন্ত্রীকে বিব্রত করা। না হয় প্রশ্ন বিক্রি করে টাকা আদায় করা হতো, প্রশ্ন এভাবে ফেসবুকে দেয়া হতো না। কেন্দ্র এ অপকর্মে আছে।
×