ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

আমরা বিচারপতি নিয়োগ দেই, তারাই মূল সংবিধানকে বলেন, ইতিহাসের দুর্ঘটনা ॥ তোফায়েল আহমেদ;###;এর পেছনে ষড়যন্ত্র আছে কি-না, সেটা খুঁজতে হবে ॥ শেখ সেলিম ;###;প্রধান বিচারপতি বলেছেন আমরা অজ্ঞ, কিন্তু আপনার মতো বিজ্ঞ এটা জানেন না যে সংসদ সার্বভৌম ॥ মইন উদ্দীন খান

‘এ রায় সংবিধান পরিপন্থী গ্রহণযোগ্য নয়’

প্রকাশিত: ০৫:৩০, ৬ মে ২০১৬

‘এ রায় সংবিধান পরিপন্থী গ্রহণযোগ্য নয়’

সংসদ রিপোর্টার ॥ বহুল আলোচিত সংবিধান (ষোড়শ সংশোধন) আইন বাতিল করে হাইকোর্টের রায় নিয়ে জাতীয় সংসদে ক্ষোভ-প্রতিবাদে ফেটে পড়েন সরকার ও বিরোধী দলীয় সংসদ সদস্যরা। তারা হাইকোর্টের প্রদত্ত রায় সার্বভৌম সংসদ, গণতন্ত্র ও সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র কি-না তা খুঁজে বের করার দাবি করে বলেছেন, গণতান্ত্রিক শক্তিকে অকার্যকর করার জন্য কোন অশুভ শক্তির সঙ্গে কেউ হাত মেলালে তার জবাব জনগণই দেবে। জবাবে আইনমন্ত্রী এ্যাডভোকেট আনিসুল হক হাইকোর্টের প্রদত্ত এ রায়কে ‘সংবিধান পরিপন্থী ও গ্রহণযোগ্য নয়’ উল্লেখ করে বলেন, আদালতের এই রায় মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। হাইকোর্টের এ রায় সংবিধান পরিপন্থী, তাদের এ রায় দেয়ার কোন এখতিয়ার নেই। ষোড়শ সংবিধান সংশোধন বিল মোটেই অবৈধ নয়, তাদের কথাও গ্রহণযোগ্য নয়। আগামী রবি বা সোমবারের মধ্যে হাইকোর্টের এ রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগে আপীল করা হবে। আমরা দৃঢ়ভাবে আশাবাদী, আপীল বিভাগে হাইকোর্টের এই রায় টিকবে না। বৃহস্পতিবার ড. স্পীকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে সংসদ অধিবেশনে পয়েন্ট অব অর্ডারে এ বিষয়টি নিয়ে দীর্ঘ উত্তপ্ত বিতর্ক চলে। পয়েন্ট অব অর্ডারে বিতর্কের পর আইন প্রণয়ন কার্যাবলীর সময় সুপ্রীমকোর্টের বিচারপতিদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধির বিষয়ে আইনমন্ত্রী একটি বিল উত্থাপন করতে গেলে তিনি সংসদ সদস্যদের তোপের মুখে পড়েন। বিরোধী দলের সংসদ সদস্যরা নিজ আসনে দাঁড়িয়ে এই বিলের বিরোধিতা করে হইচই করে আইনমন্ত্রীকে বক্তব্য প্রদানে বাধা দেন। স্পীকার বারংবার আইনমন্ত্রীকে তার বক্তব্য শেষ করার সুযোগ দেয়ার অনুরোধ জানালেও বিরোধী দলের সংসদ সদস্যরা তাদের অবস্থানে দৃঢ় থাকেন। এক পর্যায়ে বিরোধী দলের নেতা রওশন এরশাদের নেতৃত্বে বিরোধী দলের সংসদ সদস্যরা সংসদ অধিবেশন থেকে চার মিনিটের জন্য প্রতীকী ওয়াক আউট করেন। চার মিনিট পর সংসদে ফিরে এসে বিলটির বিরোধিতা করে বিরোধী দলের সংসদ সদস্যরা বলেন, বিচারপতিরা সবই পারেন, নিজেদের বেতন-ভাতা বাড়াতে পারে না? জবাবে আইনমন্ত্রী বলেন, বিচারপতিরা অবিবেচক হতে পারে, কিন্তু এ সংসদ অবিবেচক নয়। আমরা হীনম্মন্যতার স্বীকার হব না, আমরা উদারতা দেখাতে চাই। পরে তীব্র বিরোধিতার মুখেই আইনমন্ত্রী আনিসুল হক উত্থাপিত সুপ্রীমকোর্ট জাজেস (রেম্যুনারেশন এ্যান্ড প্রিভিলেজেস) বিল-২০১৬ কণ্ঠভোটে পাস হয়। প্রতিবাদ-ক্ষোভে উত্তপ্ত সংসদ অধিবেশন ॥ স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে সংসদ অধিবেশন শুরু হওয়ার পর এই অনির্ধারিত বিতর্কের সূত্রপাত করেন জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য ফখরুল ইমাম। কয়েক দফায় এই অনির্ধারিত আলোচনায় অংশ নিয়ে হাইকোর্টের রায়ের তীব্র বিরোধিতা করেন সরকারী দলের প্রবীণ নেতা তোফায়েল আহমেদ, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, জাসদের মইন উদ্দীন খান বাদল, জাতীয় পার্টির জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু, কাজী ফিরোজ রশীদ ও মুজিবুল হক চুন্নু। পরে বিলের ওপর আলোচনাতেও বিরোধী দলের সংসদ সদস্যরা হাইকোর্টের রায়ের তীব্র বিরোধিতা করেন। সরকার ও বিরোধী দলের অভিযোগের জবাব দিতে গিয়ে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়কমন্ত্রী এ্যাডভোকেট আনিসুল হক ৩০০ বিধিতে সংসদে বলেন, আদালতের এই রায় মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। হাইকোর্টের এ রায় সংবিধান পরিপন্থী। হাইকোর্ট থেকে এমন রায় দেয়ার কোন এখতিয়ার নেই। ষোড়শ সংবিধান সংশোধনী বিল মোটেই অবৈধ নয় এবং তাদের কথাও গ্রহণযোগ্য নয়। আগামী রবি বা সোমবার এই রায়ের বিরুদ্ধে আপীল করা হবে। আমরা দৃঢ়ভাবে আশাবাদী, আপীল বিভাগে হাইকোর্টের এই রায় টিকবে না। আইনমন্ত্রী বলেন, ২০১৪ সালের ২২ সেপ্টেম্বর সর্বসম্মতভাবে ষোড়শ সংবিধান সংশোধনী আইন পাস করেছি। সেখানে আমাদের মধ্যে কারোর কোন দ্বিমত ছিল না। আজ (বৃহস্পতিবার) হাইকোর্ট ডিভিশনে রায় হয়েছে, সেখানে বলা হয়েছে এটা অবৈধ। যদিও পুরো রায় এখনও হাতে পাইনি। একথা বলার সঙ্গে সঙ্গে সরকার ও বিরোধী দলের সদস্যরা হইচই করে ওঠেন। স্পীকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে আইনমন্ত্রী বলেন, এটাই শেষ সিদ্ধান্ত নয়, এর পরেও আপীল করা যায়। আমরা এখানে যে বিলটা পাস করেছিলাম, সেটা বিচার বিভাগের স্বাধীনতা যাতে অক্ষুণœ থাকে, বিজ্ঞ বিচারপতিদের সম্মান যাতে অক্ষুণœ থাকে- সেজন্যই এই সংশোধনী করা হয়েছে। কিন্তু উনারা আজ বলে দিলেন এটা অবৈধ! আমি বলছি এটা মোটেই অবৈধ না। তাদের কথা গ্রহণযোগ্যও না। মন্ত্রী বলেন, আমরা দৃঢ়ভাবে বলতে চাই, এটা কোনভাবেই অবৈধ নয়। আমরা আইনের শাসনে বিশ্বাস করি। বিচার বিভাগ স্বাধীন। তাই আপীল করলে এই রায় গ্রহণযোগ্য হবে না। এই রায়ের বিরুদ্ধে আমরা আগামী রবি সোমবারের মধ্যে আপীল করব। আমরা শুধু আইন প্রণয়ন করি না, আমরা যে আইন করি তা শ্রদ্ধা করি। আমরা গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে কোন ষড়যন্ত্র সহ্য করব না। প্রবীণ রাজনীতিক ও বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ পয়েন্ট অব অর্ডারে বলেন, আমাদের জাতীয় সংসদ সার্বভৌম। অথচ হাইকোর্টের রায়ে আমরা হতবাক ও বিস্মিত হয়েছি। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে যুদ্ধ করে আমরা এ দেশকে স্বাধীন করেছি, লাখো মানুষ আত্মাহুতি দিয়েছে। অথচ হাইকোর্টের রায়ে বলা হয়েছে, মূল সংবিধানে বিচারপতির অভিশংসনের ক্ষমতা সংসদের কাছে ছিল, কিন্তু সেটি ছিল ইতিহাসের একটি দুর্ঘটনা! আমরা বিচারপতি নিয়োগ দেই, তারাই আমাদের, মূল সংবিধানকে বলেন ইতিহাসের দুর্ঘটনা! আমরা ক্ষমতায় রয়েছি বলেই অনেকে বিচারপতি হতে পেরেছেন। তিনি বলেন, সংসদের কোন আইন যদি হাইকোর্ট বাতিল করে তবে এটা হবে একটি খারাপ দৃষ্টান্ত। এটা হতে দেয়া যায় না। আমরা আশা করি আপীল বিভাগ থেকে ন্যায়বিচার পাব। পাস হওয়া আইন বাতিল করা হলে সংসদের সার্বভৌম কোথায় থাকে? এটি বেশিদিন চলতে দেয়া যায় না, এর শেষ হওয়া উচিত। আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম বলেন, মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে এই সংবিধান রচিত হয়। ১৯৭২ সংবিধানে বিচারপতিদের অভিশংসন করার ক্ষমতা এই সংসদেরই ছিল। আমরা যেটা আইন তৈরি করি, ওনারা (বিচারপতি) সেটা কার্যকর করেন। আইনের বাইরে গিয়ে কারও কোন কিছু করা ঠিক না। তাহলে সীমানা লংঘন হয়। হাইকোর্টের রায় প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এর পেছনে কোন ষড়যন্ত্র আছে কি না সেটা খুঁজে দেখতে হবে। বাংলাদেশের প্রত্যেকটা নাগরিককে বিচারের সম্মুখীন হতে হয়। সে বিচারপতি হোক, রাষ্ট্রপতিই হোক। রাষ্ট্রপতিও যদি অপরাধ করে তাঁরও বিচার সংসদ করতে পারে। তিনি বলেন, সংসদ হচ্ছে জনগণের সার্বভৌম অধিকারের প্রতীক। এই সংসদ যদি রাষ্ট্রপতিকে অপসারণ করতে পারে, তাহলে বিচারপতিদের পারবে না কেন? এই সংসদে আইন পাস করেই তো তাদের ওখানে বসিয়েছি। আইনবহির্ভূত কোন বিচার করার জন্য ওখানে পাঠানো হয় নাই। তিনি বলেন, জনগণের প্রতিনিধি এবং জনগণের শক্তি সংসদকে অকার্যকর এবং ধ্বংস করার জন্য কোন অশুভ শক্তি আইনের দোহাই দিয়ে আইনবহির্ভূত কাজ করছে। যারা এই আইন এবং সংবিধান বহির্ভূত কাজ করছে তাদেরও বিচার করতে এই সংসদ থেকে আইন করার দরকার। মাঝে মাঝে শুনি কোন কোন বিচারপতি এই সংসদ সদস্যদের সম্পর্কে কটূক্তি করেন। বিচারপতিরা বিচারপতির জায়গায় থাকবেন। সংসদ সদস্যরা সংসদের জায়গায় থাকবে। কিন্তু এমপিদের কটূক্তি করা কোনভাবেই বাঞ্ছনীয় নয়। ভবিষ্যতে কেউ এ ধরনের কোন উক্তি করলে, আর সেটি যেই করুক, তাকেও আইনের আওতায় আনার দাবি করছি। ১৯৭২ সালের সংবিধান আমাদের রক্তে রঞ্জিত সংবিধান উল্লেখ করে তিনি বলেন, এই সংবিধানকে যারা চ্যালেঞ্জ করে, তারা যেন পাকিস্তানে চলে যায়। ওই আইয়ুব-ইয়াহিয়ার যুগে চলে যায়। ৭২ সালের সংবিধানের দাঁড়ি, কমা, সেমিকোলন বাদ দেয়ার অধিকার কারও নেই। বিচারপতিদের উদ্দেশে শেখ সেলিম বলেন, আপনারা বাড়াবাড়ি করবেন না। সংসদকে অকার্যকর করে, সংসদকে নস্যাৎ করে যদি কোন অশুভ শক্তির সঙ্গে হাত মেলান, তাহলে জনগণ সময়মত আপনাদের জবাব দেবে। জাতীয় পার্টির কাজী ফিরোজ রশিদ বলেন, এই সংসদ স্বাধীন ও সার্বভৌম। জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে এই সংসদ গঠিত। এই জাতীয় সংসদে ষোড়শ সংবিধান (সংশোধন) আইন পাস হয়। জাসদের মইন উদ্দীন খান বাদল বলেন, এই বাংলাদেশ হাজারো সমস্যা কাটিয়ে সারা পৃথিবীতে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। সেই বাংলাদেশকে ঘিরে দেশে-বিদেশ নানারকম ষড়যন্ত্র লক্ষ্য করছি। যারা বিজ্ঞ বিচার বিভাগকে প্রতিনিধিত্ব করছেন তারা ষড়যন্ত্রের শিকার হচ্ছেন কি না জানি না। ইচ্ছাকৃতভাবে এমন রায় দিয়ে একটি সংঘাত পরিস্থিতি সৃষ্টি করার চেষ্টা চলছে, যা সত্যিই অনভিপ্রেত। সংসদ সদস্য ও সংসদকে অবমাননা করলে আর কিছুই থাকে না। সংসদকে ছোট করে দেখলে তা বিপদের লক্ষ্য। সেই লক্ষ্যই দেখা যাচ্ছে। তিনি বলেন, এই সংসদ হচ্ছে সার্বভৌম। প্রথমেই বলেছিলাম ষড়যন্ত্রের কথা। আমি দুঃখের সঙ্গে উল্লেখ করছি- আপনি (প্রধান বিচারপতি) যেমন বলেছেন আমরা অজ্ঞ, কিন্তু আপনার মত বিজ্ঞ মানুষটি এটা জানেন না। তাহলে এই বিতর্ক উত্থাপন করছেন কেন? ইচ্ছাকৃতভাবে যেখানে আপনারা কথা বলতে পারতেন, পার্টিসিপেট করতে পারতেন, কিন্তু আপনারা সেখানে পার্টিসিপেট না করে সময় নিয়ে চট করে একটি রায় দিচ্ছেন। এই রায় দেয়ার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে একটি সংঘাত সৃষ্টি করতে চাচ্ছেন। যা একান্তই অনভিপ্রেত। শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, ভারতে, অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা, যুক্তরাজ্যে যদি বিচারপতিদের ইমপিচমেন্ট থাকতে পারে, তবে বাংলাদেশে থাকতে পারবে না কেন? রাষ্ট্রপতিকে যদি সংসদ ইমপিচ করতে পারে, একজন বিচারপতিকে অসাদাচরণের জন্য ইমপিচ করতে পারবে না- এটা কেমন কথা? উচ্চ আদালত রাষ্ট্রের ভেতরে নাকি বাইরে? তিনি বলেন, আইন সবার জন্য সমান। সুপ্রীমকোর্ট যা বলবে তাই করব, নাকি জনগণের ম্যান্ডেট অনুযায়ী কাজ করব- এ ব্যাপারে সরকারের কাছ থেকে সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা চাই। বিতর্কের সূত্রপাত করে জাতীয় পার্টির ফখরুল ইমাম বলেন, রাষ্ট্রের তিনটি অর্গান আইনসভা, বিচার বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগ। আইনসভা থেকে আমরা আইন তৈরি করি এবং কার কত শক্তি নির্দিষ্ট করে দেয়া আছে।
×