ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

রিভিউ খারিজ

নিজামীর সামনে এখন শুধুই ফাঁসির দড়ি

প্রকাশিত: ০৫:২৯, ৬ মে ২০১৬

নিজামীর সামনে এখন  শুধুই ফাঁসির দড়ি

বিকাশ দত্ত ॥ একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় হত্যা, ধর্ষণ এবং বুদ্ধিজীবী গণহত্যার দায়ে আপীল বিভাগ কর্তৃক মৃত্যুদ-প্রাপ্ত জামায়াতে ইসলামীর আমির শীর্ষ নেতা আলবদর বাহিনীর প্রধান বিএনপি জামায়াত জোট সরকারের সাবেক মন্ত্রী মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসির রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগ খারিজ করে দিয়েছেন। আইনী লড়াইয়ে সর্বশেষ ধাপ পার হওয়ার ফলে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াতে ইসলামীর আমিরের মৃত্যুদ- কার্যকরে আর কোন আইনী বাধা থাকল না। এখন শুধু একটি ধাপ বাকি। সেটা হলো নিজের কৃতকর্মের জন্য অনুশোচনার কথা জানিয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাইতে পারেন। এ বিষয়টির নিষ্পত্তি হলেই সরকার যে কোন সময় দ- কার্যকর করবে। প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার নেতৃত্বে চার সদস্যের আপীল বেঞ্চ বৃহস্পতিবার এক শব্দের এ রায় ঘোষণা করেন। বেলা সাড়ে ১১টায় এজলাসে এসে প্রধান বিচারপতি শুধু বলেন, ‘ডিসমিসড’। এই বেঞ্চের অপর তিন সদস্য হলেন- বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী। আপীল বিভাগ গত ৬ জানুয়ারি নিজামীর আপীলের রায় ঘোষণা করেন। ২০১৪ সালের ২৯ অক্টোবর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দেয়া প্রাণদ-ের সাজাই তাতে বহাল রাখেন আপীল বিভাগ। রিভিউ আবেদন খারিজের পর শাহবাগে গণজাগরণের কর্মীরা আনন্দ মিছিল বের করেছেন। অন্যদিকে রায় ঘোষণার পর আইনমন্ত্রী এ্যাডভোকেট আনিসুল হক বলেছেন এ রায়ে আমরা সন্তুষ্ট। আজকের রায়ের পর একটি ধাপ বাকি আছে। তাহলে শুধু রাষ্ট্রপতির নিকট প্রাণভিক্ষা চাইতে পারেন। এছাড়া আর কোন আইনী সুযোগ নেই। এ্যাটর্নি জেনারেল সন্তোষ প্রকাশ করে বলেছেন, নিয়মানুযায়ী একাত্তরের বদরপ্রধান নিজামী এখন কেবল নিজেদের কৃতকর্মের জন্য অনুশোচনার কথা জানিয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাইতে পারেন। এ বিষয়টির নিষ্পত্তি হলেই সরকার দ- কার্যকর করবে। অন্যদিকে নিজামীর প্রধান আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেছেন, জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামী রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাইবেন কিনা সে বিষয়ে তিনি নিজেই সিদ্ধান্ত নেবেন। রায় উপলক্ষে আদালতের মূল প্রবেশপথসহ অন্যান্য প্রবেশ পথে নিরাপত্তা ব্যাবস্থা জোরদার করা হয়। আদালতের আঙিনায় বাড়তি পুলিশ মোতায়েন করা হয়। এজলাস কক্ষে সাংবাদিক আইনজীবী ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের পিনপতন নীরবতার মধ্যে প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার রিভিউ আবেদন এক শব্দের মাধ্যমে খারিজ করে দেন। রায় ঘোষণার পর আদালতে মুক্তিযোদ্ধা ও আইনজীবীগণ উল্লাস করে সেøাগান দিতে থাকেন। ফাঁসি হলো, ফাাঁসি হলো নিজামীর ফাঁসি হলো। নিজামীর মামলাটি চূড়ান্ত রায় হলো আপীল বিভাগের ৬ষ্ঠ মামলা। এর আগে মীর কাশেমসহ ৭টি মামলা নিষ্পত্তি হলেও মীর কাশেমের আপীলের চূড়ান্ত রায় প্রকাশিত হয়নি। ছয়টি রায়ের মধ্যে চারটিতে জামায়াতের দুই সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কাদের মোল্লা ও মুহাম্মদ কামারুজ্জামান, জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ এবং বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরীর ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। আপীল বিভাগের আরেক রায়ে জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর সাজা কমিয়ে আমৃত্যু কারাদ- দেয়া হয়েছে। সেই রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশিত হওয়ার পর দুই পক্ষেই রিভিউ আবেদন করেছেন। শুনানি চলার মধ্যেই মুক্তিযুদ্ধকালীন জামায়াতের আমির গোলাম আযম ও বিএনপির সাবেক মন্ত্রী আবদুল আলীমের মৃত্যু হওয়ায় তাদের আপীলের নিষ্পত্তি হয়ে গেছে। এ নিয়ে বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়ে ফাঁসির তৃতীয় চূড়ান্ত রায় দিলেন সুপ্রীমকোর্ট। যার মধ্যে আলবদর কমান্ডার বুদ্ধিজীবী হত্যার মাস্টার মাইন্ড আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছে। অন্য একটি রায়ে ফাঁসির দ-প্রাপ্ত বুদ্ধিজীবী হত্যার দুই ঘাতক জামায়াত নেতা আশরাফুজ্জামান খান ও চৌধুরী মাঈনুদ্দিন পলাতক থাকায় তাদের দ- কার্যকর করা যায়নি। রায় ঘোষণার সময় রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, অতিরিক্ত এ্যাটর্নি জেনারেল মমতাজ উদ্দিন ফকির ও মুরাদ রেজা। অন্যদিকে নিজামীর পক্ষে উপস্থিত ছিলেন এ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন, এসএম শাহজাহান, নিজামীর ছেলে ব্যারিস্টার নাজিব মোমিনসহ জামায়াতে ইসলামীর অর্ধশতাধিক আইনজীবী। আরও উপস্থিত ছিলেন ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর ও তদন্ত সংস্থার প্রধানরা। এছাড়া দেশী-বিদেশী মিডিয়ার শতাধিক সংবাদ কর্মী নিজামীর রায়ের খবর সংগ্রহ করার জন্য আদালতের এজলাসে উপস্থিত ছিলেন। আমি সন্তুষ্ট ॥ মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামীর মৃত্যুদ-াদেশ সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগেও বহাল থাকায় সন্তোষ প্রকাশ করে আইনমন্ত্রী এ্যাডভোকেট আনিসুল হক বলেছেন, আমরা কিছুটা হলেও ভারমুক্ত। রায় কার্যকরে আইনি প্রক্রিয়ায় এখন একটাই ধাপ বাকি রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা চাওয়া ছাড়া আর কোন আইনী সুযোগ নেই। নিজামীর করা রিভিউ (রায় পুনর্বিবেচনা) আবেদন খারিজ করে বৃহস্পতিবার সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগ তার মৃত্যুদ-াদেশ বহাল রাখেন। পুরো জাতি আনন্দিত ॥ আলবদর বাহিনীর ‘প্রেরণাদাতা’, বুদ্ধিজীবী হত্যার ‘প্ররোচনাদানকারী’ জামায়াত আমির মতিউর রহমান নিজামীর রিভিউ আবেদন আপীল বিভাগে খারিজ হয়ে যাওয়ায় সন্তোষ প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা মাহবুবে আলম। বৃহস্পতিবার ওই রায়ের পর নিজের কার্যালয়ে প্রতিক্রিয়া জানাতে এসে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, এ রায়ে সারা জাতি স্বস্তি পাচ্ছে। পুরো জাতি স্বস্তি বোধ করছে। পুরো জাতির মতো আমরা আনন্দিত। সন্তুষ্ট প্রসিকিউশন পক্ষ ॥ একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদ-াদেশ পাওয়া জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামীর রিভিউ খারিজ হওয়াতে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন প্রসিকিউশন পক্ষ। প্রসিকিউশনের পক্ষে ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ বলেন, ’৭১ এ নিজামীর ভূমিকা ছিল একজন রিং লিডারের। দেশজুড়ে যে হত্যাযজ্ঞ চলেছে সেটা নিজামীর নির্দেশে ঘটেছে তা প্রমাণিত। ক্ষতি অনেকাংশে লাঘব হবে ॥ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার সমন্বয়ক সানাউল হক বলেছেন, মানবতাবিরোধী অপরাধে মতিউর রহমান নিজামীর মৃত্যুদ- বহাল থাকায় স্বাধীনতা যুদ্ধে যে ক্ষতি হয়েছিল তা অনেকাংশে লাঘব হলো। নিজামীর রিভিউ খারিজ করে মৃত্যুদ- বহালের আদেশের পর আদালত চত্বর থেকে বেরিয়ে এ মন্তব্য করেন সানাউল হক। হতাশা কেটেছে ॥ একাত্তরে বদর কমান্ডার মতিউর রহমান নিজামীর মৃত্যুদ-ের রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন খারিজে সন্তোষ জানিয়ে ইমরান এইচ সরকার বলেছেন, যুদ্ধাপরাধের বিচারে ‘দীর্ঘসূত্রতায়’ যে হতাশা দেখা দিয়েছিল তা এই রায়ে দূর হয়েছে। দেশের সর্বোচ্চ আদালতের এ রায়ে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী দল জামায়াতের ইসলামীর রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে অগ্রণী ভূমিকা রাখবে বলেও আশা করেছেন গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান। কালো আইনে বিচার হয়েছে ॥ মৌলিক অধিকারবিহীন, অসাংবিধানিক ও একটি কালো আইনে বিশেষ উদ্দেশ্যে মানবতাবিরোধী অপরাধের এবং নিজামীর বিচার হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন নিজামীর প্রধান আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন। বৃহস্পতিবার রায় ঘোষণার পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় সাংবাদিকদের তিনি এসব কথা বলেন। খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনটি করা হয়েছিল ১৯৫ জন পাকিস্তানী সেনার বিচারের জন্য। কিন্তু মূল হোতাদের বাদ দিয়ে তাদের সহযোগীদের বিচার করা হচ্ছে। ভবিষ্যত প্রজন্ম এর মূল্যায়ন করবে। এখনও বলছি ভবিষ্যত প্রজন্ম এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন যে এ আইনে বিচার সঠিক হয়েছিল কিনা।
×