ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সংসদের ক্ষমতা নয়

প্রকাশিত: ০৫:২৯, ৬ মে ২০১৬

সংসদের ক্ষমতা নয়

স্টাফ রিপোর্টার ॥ বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ন্যস্ত করে আনা সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করেছে হাইকোর্ট। আদালত তার রায়ে উল্লেখ করেছে, সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ও সংবিধান পরিপন্থী। সুপ্রীমকোর্টের ৯ আইনজীবীর করা একটি রিট আবেদনে দেয়া রুলের চূড়ান্ত শুনানি শেষে বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী, বিচারপতি কাজী রেজাউল হক ও বিচারপতি মোঃ আশরাফুল কামালের বিশেষ বেঞ্চ বৃহস্পতিবার সংখ্যাগরিষ্ঠের মতের ভিত্তিতে এই রায় দেন। রায় ঘোষণার পর রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান আইনজীবী মাহবুবে আলম বলেছেন এ রায়ের বিরুদ্ধে আপীল করা হবে। এদিকে সাবেক প্রধান বিচারপতি ও আইন কমিশনের চেয়ারম্যান এ বিএম খায়রুল হক জনকণ্ঠকে বলেছেন, আমি হাইকোর্টের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে বিনীতভাবে বলতে চাই যে , এ রায় দ্বারা বাংলাদেশের সার্বভৌম জনগণ এবং তাদের প্রতিনিধি জাতীয় সংসদকে অপমান করা হয়েছে। বিচার পতি এবিএম খায়রুল হক আরও বলেন, টিভি রিপোর্টিং দেখে যতটুকু উপলব্ধি করতে পেরেছি, তাতে আমি যদিও এই রায়ের সঙ্গে একবারেই একমত নই, তবুও সংবিধানের ১১২ অনুচ্ছেদ অনুসারে পার্লামেন্ট ব্যতীত এই রায় আমাদের সকলের ওপর বাধ্যকর। যতক্ষণ পর্যন্ত না ইহা আপীল বিভাগ কর্তৃক স্থগিত বা বাতিল না হয়। আমি বিনীতভাবে সুপ্রীমকোর্টের ওপর সম্পূর্ণ সম্মান প্রদর্শন করে বলতে চাই যে, এই রায় আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযুদ্ধের সফল ফসল সংবিধানকে অপমান করেছে। আমি আরও বিনীতভাবে নিবেদন করতে চাই যে, আমাদের স্বাধীন হাইকোর্ট বিভাগ মূল সংবিধানের বিধান পরিত্যাগ করে প্রডাক্ট অব মার্শাল ল’কে কি করে গ্রহণ করতে পারল তা আমার চিন্তার বাইরে। তবে একই সঙ্গে আমি হাইকোর্টের রায়ের দ্বিমত পোষণকারী বিচারপতিকে তার সঠিক সাহসী মতামতের জন্য সাধুবাদ জানাই। এদিকে আদালত তার রায়ে উল্লেখ করেছেন , সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ও সংবিধান পরিপন্থী। সংসদ কর্তৃক বিচারপতি অপসারণের বিধান একটি দুর্ঘটনা মাত্র। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা এটা সংবিধানের মৌলিক স্তম্ভ এবং সংবিধানের ৭(খ) তে মৌলিক স্তম্ভ পরিবর্তন করে আইন করার বিধান নেই। তা সত্ত্বে¡ও ১৬ তম সংশোধনী মাধ্যমে বিচারপতিদের অপসারণ করা সংসদের হাতে নেয়া একটি ঐতিহাসিক দুর্ঘটনা । আইনজীবী মনজিল মোরশেদ সাংবাদিকদের বলেন, আদালত পর্যবেক্ষণে বলেছে যুক্তরাজ্য যুক্তরাষ্ট্র, ভারতসহ বিভিন্ন দেশে সংসদের হাতে এ ক্ষমতা থাকলেও সেখানকার সামাজিক রাজনৈতিক কালচার ভিন্ন রকম। এমন কি অনেক অনেক দেশে আমাদের দেশের মতো আর্টিক্যাল ৭০ অনুচ্ছেদ থাকলেও সেখানকার আইন দুটি পর্যায়ে নিরীক্ষা করা হয়। ওদের রাজনীতিবিদরা আমাদের দেশের মতো প্রশাসনিক কর্মকা-ে ওতপ্রোতভাবে জড়িত নয়। আদালত তার রায়ে আরও বলে, কমনওয়েলথ দেশগুলো ৬৩ ভাগ ক্ষেত্রে বিচারক অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে নয়। এ ছাড়া শ্রীলঙ্কা ভারতে দুটি ক্ষেত্রে এ অপসারণের ক্ষমতা সুখকর নয়। এ ছাড়া এ আইনে সংসদের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যদের সমর্থন পেলে একজন বিচারককে সে অদক্ষ হলেও অপসারণ করা যাবে না। তা হবে বিচার বিভাগের জন্য লজ্জাকর। এ ছাড়া এ আইন প্রণয়নের ফলে জনগণের মনে একটি ধারণা হলো বিচার বিভাগের ওপর খড়্গ সৃষ্টি করা হয়েছে। সুতরাং বিচার শুধু করলেও হবে না বিচার করার মাধ্যমে জনগণের মাঝেও ধারণা সৃষ্টি করতে হবে ন্যায় বিচার হয়েছে। কিন্ত জনগণের এ ধরনের ধারণা থাকলে স্বাধীনভাবে বিচার পরিচর্যা হলেও জনগণের সঙ্গে বিচার বিভাগের সম্পর্ক বিরূপ ধারণার সৃষ্টি হবে। এদিকে রাষ্ট্রপক্ষ এই রায়ের বিরুদ্ধে আপীল করবে বলে এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম জানিয়েছেন। রায়ের পর তিনি বলেন, ‘আমরা এই রায় স্থগিতের জন্য রবিবারই চেম্বার আদালতে আবেদন করব।’ উচ্চ আদালতের বিচারক অপসারণের ক্ষমতা সংসদের কাছে ফিরিয়ে নিতে ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী আনা হয়। বিলটি পাসের পর একই বছরের ২২ সেপ্টেম্বর তা গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়। অসদাচরণের জন্য উচ্চ আদালতের কোন বিচারককে কীভাবে অপসারণ করা যাবে, সে প্রক্রিয়া নির্ধারণে আরেকটি আইনের খসড়ায় ইতোমধ্যে সম্মতি দিয়েছে মন্ত্রিসভা। ওই সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ৫ নবেম্বর হাইকোর্টে এই রিট আবেদন হয়। প্রাথমিক শুনানির পর হাইকোর্ট ২০১৪ সালের ৯ নবেম্বর রুল দেয়। রুলে ওই সংশোধনী কেন অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হবে না তা জানতে চাওয়া হয়। মন্ত্রিপরিষদ সচিব, রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ের সচিব, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব, আইন সচিব, সংসদ সচিবালয়ের সচিবকে দুই সপ্তাহের মধ্যে রুলের জবাব দিতে বলা হয়। এই রুলের ওপর গত বছর ২১ মে শুনানি শুরু হয়। ওইদিন আদালত মতামত দিতে অ্যামিচি কিউরি হিসেবে জ্যেষ্ঠ পাঁচ আইনজীবীর নাম ঘোষণা করেন। এর মধ্যে ড. কামাল হোসেন, ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম, ব্যারিস্টার রোকনউদ্দিন মাহমুদ ও আজমালুল হোসেন কিউসি এই শুনানিতে অ্যামিচি কিউরি হিসেবে নিজেদের মতামত তুলে ধরেন। ১৭ দিন শুনানির পর গত ১০ মার্চ আদালত এ বিষয়ে রায়ের দিন ঠিক করে দিয়েছিল। ওই দিন রাষ্ট্রপক্ষে এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম ও রিট আবেদনকারী পক্ষে আইনজীবী মনজিল মোরশেদ শুনানিতে অংশ নেন। এ্যামিকাস কিউরি ড. কামাল হোসেন শুনানিতে বলেন, সংবিধানের ১৬তম সংশোধনীর মাধ্যমে বিচারক অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে দেয়ার কারণে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা খর্ব হবে। তিনি আরও বলেন , ’৭২-এর সংবিধান প্রণয়নের সময় এ সংক্রান্ত বিষয় আইন প্রণেতাদের তেমন কোন অভিজ্ঞতা ছিল না। যার কারণে অন্য কোন বিকল্প ব্যবস্থা নেয়ার সুয়োগ ছিল না। তবে ৪০ বছরের অভিজ্ঞতার আলোকে বর্তমান সংসদের হাতে এ ক্ষমতা দেয়াটা সমীচীন নয়। সংবিধানের আর্টিক্যাল ৭খ বহাল থাকা অবস্থায় এ ধরনের সংশোধনীর কোন সুযোগ নেই। কারণ বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সংবিধানের একটি মূল স্তম্ভ। এ্যামিকাস কিউরি ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম শুনানিতে বলেন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সংবিধানের মূল স্তম্ভ। আমাদের উচ্চ আদালতে সিদ্ধান্তে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সংবিধানের মূল স্তম্ভ হিসেবে স্বীকৃত দেয়া হয়েছে। তিনি আরও বলেন, যদিও সংশোধনীর মাধ্যমে ’৭২-এর সংবিধানে ফিরে যাওয়া হয়েছে। কিন্তু এশিয়ার বিভিন্ন দেশে বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে থাকার বিষয় আমাদের অভিজ্ঞতা সুখকর নয়। রাষ্ট্রপক্ষে এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম শুনানিতে বলেছিলেন, বিচারপতিদের অপসারণের প্রক্রিয়া আগে ছিল সুপ্রীম জুডিশিয়াল কাউন্সিলে। ষোড়শ সংশোধনীতে বলা হয়েছে, সংসদের প্রস্তাবের ভিত্তিতে রাষ্ট্রপতি এই অপসারণ করবেন। আর সংসদ তদন্ত কমিটির সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে রাষ্ট্রপতিকে সুপারিশ দেবে। ওই তদন্ত কমিটি কীভাবে গঠিত হবে সে বিষয়ে একটি বিল এখন পর্যন্ত বিবেচনাধীন জানিয়ে তিনি শুনানিতে বলেন, ‘এটি আইনে পরিণত হলেই কিন্তু এ বিষয়ে কারণ (কজ অব এ্যাকশন) উদ্ভব হবে। কাজেই আমার বক্তব্য হলো, জনস্বার্থ মামলা হিসেবে যারা মামলাটি করেছেন- তাদের মামলা করার সময় আসেনি।’ ‘আইন হওয়ার পরে আইনে যদি কোন রকম ব্যত্যয় হয়, দেখা যায় সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক- তখনই কারণ উদ্ভব ঘটবে এটা চ্যালেঞ্জ করার।’ এ কারণে রিট আবেদনটি ‘মেনটেইনেবল না’ (গ্রহণযোগ্য নয়) বলে যুক্তি দেখান তিনি। অন্যদিকে রিট আবেদনকারী পক্ষের আইনজীবী মনজিল মোরশেদ শুনানিতে বলেছিলেন, সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদে বিচারকের অপসারণের বিধানটি ছিল। পঞ্চম সংশোধনী মামলার রায়ে আপীল বিভাগও সুপ্রীম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের ওই বিধানটি সুরক্ষা দিয়েছিল। এই সুরক্ষার পর পঞ্চদশ সংশোধনী যখন পাস হয়, তখন সংসদ ওই ৯৬ অনুচ্ছেদকে সংরক্ষিত করেছিল। ‘হঠাৎ করে কিছুদিন পরে ৯৬ অনুচ্ছেদ পরিবর্তন করে এই ক্ষমতা সংসদের হাতে নিয়ে যাওয়া হয়। এই পরিবর্তন হয়েছে সংবিধানের মৌল কাঠামোকে পরিবর্তন করে। কারণ সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে থাকা ৭(বি) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে মৌল কাঠামো পরিবর্তন করা যাবে না।’ আনোয়ার হোসেন মামলায় সুপ্রীমকোর্ট রায়ের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সংবিধানের মূল কাঠামো। যেহেতু ‘মূল কাঠামো পরিবর্তন করা হয়েছে’, সেহেতু ষোড়শ সংশোধনী সংবিধান পরিপন্থী। ‘এই ক্ষমতাটা যদি সংসদের হাতে দেয়া হয়, তাহলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার ওপর এক ধরনের বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি ও হস্তক্ষেপ হতে পারে। তাই এই ক্ষমতাটা সংসদের হাতে ফিরিয়ে দেয়াটা যৌক্তিক হবে না।’ ১৯৭২ সালে প্রণীত মূল সংবিধানে উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা জাতীয় সংসদের কাছে ছিল। ১৯৭৫ সালের ২৪ জানুয়ারি সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে এ ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে অর্পণ করা হয়। পরে জিয়াউর রহমানের শাসনামলে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা দেয়া হয় সুপ্রীম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের কাছে। মার্শাল প্রক্লামেশনে করা পঞ্চম সংশোধনীতে এক্ষেত্রে ৯৬ অনুচ্ছেদে পরিবর্তন আনা হয়েছিল। ষোড়শ সংশোধনীতে সেটা বাতিল করে বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা ফিরিয়ে দেয়া হয় সংসদকে। ষোড়শ সংশোধনীর ৯৬(২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘প্রমাণিত অসদাচরণ বা অসামর্থ্যরে কারণে সংসদের মোট সদস্য সংখ্যার অন্যূন দুই-তৃতীয়াংশ গরিষ্ঠতার দ্বারা সমর্থিত সংসদের প্রস্তাবক্রমে প্রদত্ত রাষ্ট্রপতির আদেশ ছাড়া কোন বিচারককে অপসারিত করা যাবে না।’ ৯৬(৩) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, দফা (২) এর অধীন প্রস্তাব সম্পর্কিত পদ্ধতি এবং কোন বিচারকের অসদাচরণ বা অসামর্থ্য সম্পর্কে তদন্ত ও প্রমাণের পদ্ধতি সংসদ আইনের দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। সেই তদন্ত ও প্রমাণের পদ্ধতি এবং অপসারণের প্রক্রিয়া ঠিক করে তৈরি একটি আইনের খসড়ায় গত ২৫ এপ্রিল নীতিগত অনুমোদ দেয় মন্ত্রিসভা।
×