ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

এম আর মাহবুব

স্মরণ ॥ আলাউদ্দিন আল আজাদ

প্রকাশিত: ০৩:৫৩, ৬ মে ২০১৬

স্মরণ ॥ আলাউদ্দিন আল আজাদ

১৯৫২ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি এক রাতের মধ্যে গড়ে ওঠে ১০ ফুট উঁচু ও ৬ ফুট চওড়া ‘শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ।’ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হোস্টেলের ছাত্রদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় হোস্টেল প্রাঙ্গণে নির্মিত প্রথম শহীদ মিনারটি ২৪ ফেব্রুয়ারি সকালে শহীদ শফিউরের পিতা আর ২৬ ফেব্রুয়ারি সকালে আবুল কালাম শামসুদ্দীন উদ্বোধন করেন। ২৬ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় নাজিমুদ্দিন নুরুল আমীন মুসলিম লীগ সরকারের সশস্ত্র বাহিনী বাঙালীর প্রথম শহীদ মিনারটি ধ্বংস করে দিয়েছিল। প্রথম শহীদ মিনারের আয়ু ছিল মাত্র আড়াই দিন। এই স্বল্প সময়ের মধ্যে শহীদ মিনার হয়ে ওঠে বাঙালী জাতির প্রাণকেন্দ্র। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির রক্তাক্ত ঘটনার দিনে বিক্ষোভকারীদের একজন হিসেবে আলাউদ্দিন আল আজাদ প্রত্যক্ষ করেন একুশের প্রথম শহীদ রফিকউদ্দিনের নির্মম মৃত্যু। প্রত্যক্ষ করেন আবদুল জব্বার ও আবদুল বরকতের গুলিবিদ্ধ হওয়ার দৃশ্য। এই অমানবিক মৃত্যুর দৃশ্য দেখে আলাউদ্দিন আল আজাদ খুবই মর্মাহত হন। ২৩ ফেব্রুয়ারি রাতে শহীদদের স্মরণে প্রথম শহীদ মিনার নির্মাণে সম্পৃক্ত ছিলেন আলাউদ্দিন আল আজাদ। ২৬ তারিখে প্রথম শহীদ মিনার ভাঙ্গার দৃশ্যও তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন। এ প্রসঙ্গে তার ভাষ্যÑ ‘একদল পুলিশ এসেছিল। প্রথম দিনে অনেক মানুষের জমায়েত এটাকে ঘিরে আছে দেখে আর সাহস করলো না। এভাবেই রেখে চলে যায়। পরদিন সফিকুর রহমানের পিতাকে দিয়ে মিনারটি উদ্বোধন করা হয়। পরে আবার আজাদ সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দীন এটি আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন। যাই হোক, পুলিশ বরাবরই মিনারটি ভাঙতে আসে এবং না পেরে ফিরে যায়। আমি মনে মনে এদের প্রতি ক্ষোভ, ঘৃণা বর্ষণ করি। ২৬ তারিখ পরিস্থিতি অবনতি ঘটে। সলিমুুল্লাহ মুসলিম হল রেইড করে পুলিশ মেডিকেল ব্যারাকে ঢোকে। পুলিশ শহীদ মিনার ভাঙ্গতে যাচ্ছে শুনে দুপুর ২টার দিকে সবাই সেখানে হাজির হই। আমিও কাছাকাছি ছিলাম। পুলিশ ছাত্রদের ধাওয়া করে। আমরা ধারণা করতে পারিনি ঐদিনও পুলিশ গুলি চালাবে। পুলিশের সশস্ত্র আক্রমণের মুখে সেদিন ছাত্ররা কোন প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি। এক সময় জায়গাটা ফাঁকা হয়ে যায়। ভারী অস্ত্রসজ্জিত পুলিশ স্মৃতিস্তম্ভটি ভাঙতে থাকে। আমি কাছে দাঁড়িয়ে দেখলাম। দুঃখ পেলাম। প্রতি আক্রমণের ইচ্ছা হয়নি। চোখের সামনে মিনারটি গুঁড়িয়ে যায়। চারদিক আবছা হয়ে আসছে। আমি দুহাতে মাথা চেপে ধরে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বসে পড়লাম।’ (সূত্র : একুশের সংকলন, মারুফ রায়হান সম্পাদিত, বইমেলা ২০০৭, পৃ. ২৯-৩০) এ প্রসঙ্গে তার আরও স্মৃতিচারণÑ ‘স্মৃতিস্তম্ভ’ রচনার তারিখ ২৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২। সময় প্রায় সারারাত। স্থান ইকবাল হল। তখন আমার বয়স কুড়ি বছর আট মাস কুড়ি দিন।... হঠাৎ ওঠে সুইচ টিপে বাতি জ্বালাই। আমি সে সময় যদিও ভবঘুরে, কখন আসি কখন যাই ঠিক নেই। তবু বাঁ পাশের দেরাজে একটা দুটো বই, লেখাপড়ার আরও কিছু। বুক পকেটে ঝর্ণা কলমটা সারাক্ষণ গাঁথা থাকত। দোর ভেজানো রেখেছি; চেয়ারটা টেনে বসে গেলাম। তখন আমার মনে গুঞ্জন চলছে নিঃশব্দে, মৃদু আলোড়ন। প্রশ্নের আকারে কেমন করে জাগছে বুঝতে পারিনি। ‘স্মৃতির মিনার ভেঙেছে তোমার?...এ আমার সারাজীবনে কণ্ঠরব।’ কবিতাটির কয়েকটি চরণ নিম্নে দেয়া হলো- “স্মৃতির মিনার ভেঙেছে তোমার? ভয় কি বন্ধু আমরা এখনো চারকোটি পরিবার খাড়া রয়েছি তো। যে-ভিৎ কখনো কোনো রাজন্য পারেনি ভাঙতে হীরার মুকুট নীল পরোয়ানা খোলা তলোয়ার খুরের ঝটিকা ধুলায় চূর্ণ যে পদপ্রান্তে যারা বুনি ধান গুন টানি, আর তুলি হাতিয়ার হাপর চালাই সরল নায়ক আমরা জনতা সেই অনন্য ইটের মিনার ভেঙেছে ভাঙুক। ভয় কি বন্ধু, দেখ একবার আমরা জাগরী চারকোটি পরিবার।” শহীদ মিনার নিয়ে রচিত প্রথম কবিতা প্রসঙ্গে বায়ান্নর ভাষা সংগ্রামী রফিকুল ইসলাম বলেন- “ছাব্বিশ ফেব্রুয়ারি দুপুর ও অপরাহ্ণের মধ্যে নাজিমুদ্দিন নুরুল আমীন মুসলিম লীগ সরকারের সশস্ত্র বাহিনী বাঙালীর প্রথম শহীদ মিনারটি আক্ষরিক অর্থে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিল। কিন্তু তারা জানত না যে, ইতিমধ্যেই বাঙালীর হৃদয়ে যে স্মৃতির মিনার গাঁথা হয়েছিল তা নিশ্চিহ্ন করার শক্তি কোন শাসকের নেই, আলাউদ্দিন আল আজাদের ভাষায়, ‘স্মৃতির মিনার ভেঙেছে তোমার?...ইটের মিনার ভেঙেছে ভাঙুক। একটি মিনার গড়েছি আমরা চার কোটি কারিগর...রাঙা হৃদয়ের বর্ণলেখায়। ‘শহীদ মিনার নিয়ে প্রথম কবিতা।” (সূত্র : বাংলাভাষা, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন-সেড, ফেব্রুয়ারি ২০০৬, পৃ. ৪২) এই অবিস্মরণীয় ঐতিহাসিক কবিতার জনক আলাউদ্দিন আল আজাদের আজ ৮৪তম জন্মদিন। জন্মদিনে তাকে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা। লেখক : ভাষা আন্দোলন বিষয়ক গবেষক
×